মেয়েটি একলা হাসে, একলাই বাঁচে
প্রকাশ : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:৩৫
ক্যাম্পাস ছেড়েছে তের বছর হয়ে গেল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানির জ্বলজ্বলে ছাত্রি মুনা। পড়ালেখায় সিরিয়াস। প্রেম প্রেম খেলে তেমন একটা সময় নষ্ট করেনি। ছাত্র জীবনের শেষটা আরো একটু সুন্দর হতে পারতো। একটু নিশ্বাস ফেলে, গুছিয়ে, থিতু হয়ে বিয়ে টিয়ের কথা ভাবতে পারতো। বিয়ের কথা ভাবাটা যদিও মোটেই জরুরি ছিলো না মুনার জন্য। কিন্তু ভাবতে হতো বৈকি। একা মেয়েদের গণিমতের মাল ভাবা হয় যে এই সমাজে!! তাই মা মরা মুনা ও নিজের বিয়ের কথা নিজেই ভাবতো একটু অবসর পেলে। কিন্তু তা হয়নি।
মুনার মা মারা গিয়েছিলো সেই বারো বছর বয়সে। ছোট দুই ভাই আর বাবাকে নিয়ে মুনা নিজের জীবনটা নিজেই টেনেছে এ যাবতকাল। মা মার যাবার সাথে সাথে সুযোগসন্ধানী আত্মিয়রা হামলে পড়েছিলো। দখল করে নিয়েছিলো মুনার মায়ের নিজের হাতে গড়া সংসারের থালা বাটি থেকে শুরু করে রেখে যাওয়া শ’চারেক গয়না। এক সময় মুনা বাধ্য হলো ক্লাস ফোরে পড়া ভাইটিকে হোস্টেলে দিয়ে নিজেও কলেজের হোস্টেলে উঠতে। সে থেকে মুনা কলেজ হোস্টেল, আর ভার্সিটির হলেই কাটিয়েছে সময়গুলো।
এক সকালে বাবার শরীর খারাপ শুনে বাড়ি ছুটে গেল। সেই যাওয়া, ফিরে এল লাশ হয়ে। নিজের কাঁধে নিজের লাশ নিয়ে। সে এমন এক লাশ, দাফন করা ও যাবে না, বয়ে যেতে হবে মরণতক। এমন তো গল্প উপন্যাসে পড়েছে। কিন্তু জীবনের পাতায় ও এমন প্লট ছিলো বুঝি! যা বলছিলাম, বাবা অসুস্থ তাই ছুটে বাড়ি গিয়েছিল মুনা। কিন্তু ঢুকতেই সব কেমন অস্বাভাবিক লাগল। এতো আত্মীয় স্বজন, বিয়ে বাড়ীর রোশনাই কেন? কিছুক্ষণের মধ্যেই সব পরিষ্কার হলো। যেহেতু মুনার মা নেই, সেহেতু খালা-ফুফু-চাচি সবাই “মা” হয়ে মুনাকে 'নরক থেকে উদ্ধার' করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিদ্ধান্ত মানে সিদ্ধান্ত !!! একেবারে পাত্র ঠিক করে, বিয়ের কাজী উপস্থিত করে তারপর ডেকে নিয়ে গেছে মুনাকে। ঘটনার আকষ্মিকতায় হত বিহবল মুনা শুধু দেখতে পেল ওর মাথার উপর একটা বেনারশি শাড়ি মেলে ধরা হয়েছে। এখুনি কবুল পড়তে হবে। পাত্র লন্ডনে থাকে। টেলিফোনে বিয়ে হবে। বাড়িতে বিয়ের সামিয়ানা, খাবার, আত্মিয়...মাথার উপর লাল শাড়ি, চোখের উপর অসুস্থ বাবার একজোড়া চোখ। মুনা খুব নরম সরম মেয়ে নয়। এভাবে একটা বিয়ের আয়োজন ও মেনে নেয়ার মেয়ে নয়। তাই সে একবার বাবার সাথে কথা বলতে চাইল। কথা হল। কি কথা হলো কে জানে, মুনা কবুল পড়ে নিল টেলিফোনের এই প্রান্ত থেকে। দুপুর নাগাদ সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ। বিকেল নাগাদ একা মুনা দোকা হয়ে গেল।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। যেহেতু বর নেই, তাই বাসর যাপনের ঝামেলা নেই। এইফাঁকে একটু ধাতস্ত হলো মেয়েটা। বন্ধু বান্ধব অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ করলো। বিয়ের খবর দিল। খবর দিতে গিয়ে অনেক কিছুই খবর হলো। খবর হলো লন্ডন প্রবাসী সোনার ছেলের সোনালী কর্মকান্ডের কথাও। তারপরের কাহিনী ‘অতঃপর সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’র মতো হয়নি। যদিও এমনই হওয়ার নিয়ম। সোনার আংটি আবার বাঁকা কি? বয়সকালে বিদেশে ছেলে পিলে অমন একটু আধটু করেই থাকে। এদিকে সব ঘটনা শুনে অসুস্থ বাবা স্ট্রোক করে বসলো। একদিকে আইসিউতে শুয়ে থাকা বাবা, আর একদিকে প্রতারণার বিয়ের ফাঁস। বাবাকে বাঁচাতে তাই মুনাকে লন্ডন যেতে হলো কাগজের বরের কাছে।
কিন্তু মেয়েটি মুনা কিনা! ঘাড়ের রগ তো সাড়ে তিনটাই বাঁকা। তাই সেই লন্ডন শহরে কাগুজে বরের ঠিকানায় পৌঁছেই চিহ্ন-প্রমাণ সমেত হাতে নাতে ধরে সোনার আংটি বাঁকা করেই ছাড়ল। কিন্তু মহান পুরুষ কি আর এতো সহজে সব ছেড়ে দেয়? সেই মহামান্য বর মুনার পাসপোর্ট, নগদ টাকা সব চুরি করে নিল। একদম একা নতুন একটা শহরে থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাড় করার মতো একটা কাজ জুটিয়ে নিলো মুনা। পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে ইমার্জেন্সি পাস বের করলো, পরে পাসপোর্ট। এর পর ওখান থেকেই খোলা তালাক নিল। পড়ালেখা শুরু করলো, 'অড জব' করলো। পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরে সরকারের পরিবেশ বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করলো।
দেশে ফিরেই মুনা এতোদিনের আত্মিয়দের হাতে বেদখল হওয়া সম্পত্তি, বাড়ি দখল নিলো। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়ির কাজে হাত দিল। একলা বাড়িতে একটা আপাতত সেড করে থাকতে শুরু করলো। এক রাতে আত্মিয়দের পাঠানো ভাড়াটে মাস্তানরা এসে আঘাত করলো। যতক্ষণ পেরেছে একাই লড়লো মাস্তানদের সাথে, পরে পাশের জজ কোয়ার্টারের জজদের সহযোগিতায় পুলিশি সহায়তা পেয়েছে। ততক্ষণে সারা শরীর ছুরির আঘাতে রক্তাক্ত। তবু মুনা বাঁচল এবং তুমুল বাঁচতে থাকলো। অফিস, ক্যারিয়ার, আড্ডা, ব্যাবসা সম্পত্তি, ঢাকার ফ্ল্যাট, চট্টগ্রামের বাড়ি এসব নিয়েই মুনা খলখল করে বেঁচে উঠতে থাকলো। মুনারা এভাবেই বেঁচে থাকে, নিজের জীবন নিজের হাতে নিয়ে।
মুনা জানে, নারীদের বাঁচা দেখলে চারপাশে পৌরুষিক বেদনায় বিকার করার লোকের অভাব নেই এই দেশে। নারীরাও করে, পুরুষরাও করে। মুনা শোনে তাদের বিকার। পুরুষতন্ত্রের এই বিকারগ্রস্ত চিৎকার থোড়াই কেয়ার করে মুনা। এই বিকারগ্রস্তদের ভিড়ে নিজের সহপাঠিদের চিৎকার শুনে মুনা রিএক্ট করে। এদের কেউ কেউ বন্ধুদের আড্ডায় ‘সিঙ্গেল’ মুনাকে দেখে সিটি বাজায়। কেউ কেউ আবার সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু মজা নেয়। মুনা বিশ্বাস করতে পারে না এরা তার সহপাঠি, কেউ কেউ বন্ধুও ছিল। যারা একসাথে ক্যম্পাসে ছিল অন্তত সাত সাতটি বছর। মুনা অবাক হয়ে দেখে শুধু ছেলেরা নয়, এই বিকারগ্রস্তদের তালিকায় যোগ দিয়েছে মেয়েরাও। এই মেয়েরা আবার মুনার একলা বাঁচা দেখে নিজের স্বামীটিকে খুব সামলে রাখে, ইনবক্সে আড়ি পাতে। এরা একই সুরে 'সিঙ্গেল নারীরা' সমাজের জন্য কত ভয়ঙ্কর সেই ফাতরা উড়ায়, সেই ফাতরা ইনবক্সে সীমাবদ্ধ থাকে না, চলে আসে টাইমলাইনের খোলা পাতায়। ফেসবুকের খোলা পাতা জুড়ে চলতে থাকে পুরুষতান্ত্রিক বিকৃত চর্চা...নারী পুরুষ উভয়ে মিলে মিশে একাকার সেই চর্চায়।
না, মুনা খুব বেশি সময় এদের পেছনে নষ্ট করেনি। মুনা জানে, কাছে ভিড়তে দিলে এই যৌন হতাশা এবং বিকৃতিতে ভোগা নারী-পুরুষরা একলা মেয়েদের জীবনটাকে লাল পিঁপড়ের মতোই কুট কুট করে পুরো জীবনটা খুবলে খায়। তাই ওদেরকে পুরুষতান্ত্রিকতার লালা চাটতে দিয়ে সে দিব্যি ফিরে আসে জীবনে। সে জীবনে মুনা একাই তার সাম্রাজ্য চালায়। চট্টগ্রামে নিজে দাঁড়িয়ে চারতলা বাড়ির কাজ শেষ করে। ঢাকায় মস্ত এক ফ্ল্যাট ভাড়া করে হাত পা ছড়িয়ে থাকে। মুনা সারাদিন কলকল করে, কাজ করে, এক হাতে রোজগার করে, আর এক হাতে উড়ায়, এ দেশ-ও দেশ দৌড়ায়, গান গায়, মাস্তি করে, লড়াই করে। মুনা একলা হাসে, একলাই বাঁচে।
পুরুষতন্ত্রের লালা চাটা পার্ভার্টগুলোর মুখে ঝামা ঘসে দিয়ে মুনা সদর্পে বলে, “ইয়েস, আই এম হ্যাপিলি সিঙ্গেল। লীডিং আ সিঙ্গেল লাইফ ইস জাস্ট আ ক্যালিভার। এন্ড আই হ্যাভ দিস ক্যালিভার, ডু ইয়ু?”
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী সংযোগ বাংলাদেশ