নাসিরনগর: দ্বিতীয় রামু?

প্রকাশ : ১৮ নভেম্বর ২০১৬, ০১:৪৪

বহুদিন থেকে আমি প্রতি দুই সপ্তাহ পরপর লিখে আসছি। এবারে কী লিখব আমি বেশ আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম এবং সেটি নিয়ে আমার ভেতরে একধরনের আনন্দ ছিল। কীভাবে কীভাবে জানি আজকালকার প্রায় লেখাগুলোতেই একধরনের ক্ষোভ কিংবা সমস্যার কথা চলে এসেছে। এবারের লেখাটার মাঝে আমার আনন্দ এবং আশার কথা লেখার কথা ছিল, কিন্তু যখন লিখছি তখন মনটি ভারাক্রান্ত। কারণ, আমি বুঝতে পারছি আজকে আমি আমার আনন্দের কথা, আশার কথা লিখতে পারব না। আজকে আমার কষ্টের কথা ক্ষোভের কথা লিখতে হবে।

হঠাৎ করে আমরা সবাই আবিষ্কার করেছি ৩০ অক্টোবর রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে একেবারে ঘোষণা দিয়ে এবং প্রস্তুতি নিয়ে অনেকগুলো মন্দির ভাঙচুর করা হয়েছে। শুধু তাই নয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়িতে হামলা হয়েছে, সেগুলো তছনছ করা হয়েছে, লুট করা হয়েছে এবং সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার একেবারে সম্পূর্ণ নিরপরাধ শ খানেক মানুষের গায়ে হাত তোলা হয়েছে।

বাংলাদেশের মাটিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়ে বসবাস করা ছাড়া তাদের আর কোনো দোষ নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকার এই মানুষগুলোর কাছে ক্ষমা চাইবার ভাষা আমার জানা নেই। আমি আমার হিন্দু ধর্মাবলম্বী সহকর্মী কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের সামনেও অপরাধী হয়ে আছি।

আমরা সবাই জানি, এই দেশে ধর্মান্ধ মানুষ আছে, কীভাবে কীভাবে জানি তাদের কাছে ধর্ম একটা বিচিত্র রূপ নিয়ে এসেছে। ধর্মের অবমাননা হয়েছে এই ধরনের একটা কথা ছড়িয়ে দিয়ে এই ধর্মান্ধ মানুষগুলো অবলীলায় অন্য ধর্মের মানুষের উপাসনালয় তছনছ করে ফেলতে পারে। শুধু তাই নয়, অন্য ধর্মের একেবারে নিরপরাধ মানুষটিকে নির্যাতন করতে পারে, অপমান করতে পারে।

রামুতে যে ঘটনাটি ঘটেছিল আমরা কেউ সেটা ভুলিনি, এবং সেটা কীভাবে ঘটানো হয়েছিল সেই ইতিহাসটুকুও আমাদের সবার স্পষ্ট মনে আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এলাকার ঘটনাটি হুবহু রামুর ঘটনার একটি পুরনাবৃত্তি ছাড়া কিছুই নয়। শুরু হয়েছে ফেসবুকে একটি আপত্তিকর পোস্ট দিয়ে, যার অ্যাকাউন্ট থেকে এটি এসেছে সে পরিস্কারভাবে জানিয়েছে, সে নিজে এটি করেনি, অন্য কেউ তার হয়ে করেছে। সে আপত্তিকর ছবিটি সরিয়ে দিয়েছে এবং সবার কাছে এ রকম একটি ঘটনার জন্যে ক্ষমা চেয়েছে। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেটি শেষ হয়নি।

স্থানীয় মানুষজন তাকে ধরে পুলিশে দিয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে একটা মামলাও হয়ে গেছে। এই পর্যায়ে অবশ্যই পুরো ব্যাপারটা পুরোপুরি নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার কথা, যে অপরাধটি করেছে তাকে ধরে পুলিশে দিয়ে মামলা হয়ে গেছে, এরপরে আর কিছু কী করার আছে?

অথচ আমরা দেখলাম মূল ঘটনাটি শুরু হল এর পর থেকে। মসজিদে মসজিদে মাইকে করে পরদিন একটা বিক্ষোভ মিছিলে সবাইকে যোগ দিতে বলা হল, এবং দুপুর বারোটার ভেতরে অনেক মানুষকে একত্র করে সবাই মিলে মন্দিরে মন্দিরে হামলা করতে শুরু করল, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাসা লুট করতে শুরু করা হল এবং একেবারে পুরোপুরি নিরাপরাধ মানুষকে শুধুমাত্র হিন্দু হওয়ার অপরাধে মারধর করা হতে লাগল।

স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভেতরে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে হতাশা এবং ক্ষোভ জন্ম নেওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই দেশের সবাই রামুর ঘটনাটি জানে, কীভাবে এই ধরনের একটা ঘটনা তৈরি করে ভিন্ন ধর্মের মানুষের উপর অত্যাচার করা হয়, তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করা হয় সেটিও সবাই জানে। সেই একই ব্যাপার ঘটতে শুরু করেছে দেখার পরও প্রশাসন কিংবা পুলিশ সেদিকে থামানোর চেষ্টা করল না– সেটি দেখে আমরা খুব অবাক হয়ে যাই।

আমরা বুঝতে পারি না, মনে হয়, ধর্মান্ধ মানুষগুলোর দলবেঁধে অন্য ধর্মের মানুষের মন্দির ধ্বংস করার ব্যাপারটিতে এই পুলিশ কিংবা প্রশাসনের একধরনের প্রচ্ছন্ন সায় রয়েছে। আমরা যেটা অনেক জায়গাতে দেখতে শুরু করেছি আজকাল শুধুমাত্র নিজের ধর্মের জন্যে লোক দেখানো ভালোবাসা যথেষ্ট নয়, তার সাথে অন্য ধর্মের জন্যে এক ধরনের অবহেলা দেখানো মোটামুটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২.
আমাদের দেশে সামাজিক নেটওয়ার্ক কিংবা সোজা বাংলায় ‘ফেসবুক’ নামে একটি জগৎ আছে, যে জগৎটির সাথে আমার বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। শুনতে পেয়েছি এই জগতে যারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই ঘটনাটি দেখে মর্মাহত হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে লেখালেখি করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কিন্তু মানুষ কথা বলতে শুরু করেছে। আমার যেহেতু এই জগৎটির সাথে যোগাযোগ নেই (এবং যোগাযোগের আগ্রহও নেই) তাই তারা ঠিক কোন যুক্তি দিয়ে একজন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির ‘আঘাত’ দেওয়ার অভিযোগে অন্য মানুষকে পীড়ন করতে পারে– সেটি কোনোদিন জানতে পারব না।

কিন্তু যে বিষয়টি খুব দুর্ভাবনার সেটি হচ্ছে, এই দেশে এ রকম মানুষ আছে তারা প্রকাশ্যে সুযোগ পেলেই অন্য ধর্মের মানুষের মন্দির ভেঙে ফেলা সমর্থন করে। যার অর্থ এই দেশে যারা প্রকাশ্যে ফেসবুকে সেটি নিয়ে লেখালেখি করে না, কিন্তু মনে মনে এটি সমর্থন করে সে রকম মানুষের নিশ্চয়ই অভাব নেই। এরা যে খুব দূরের মানুষ তাও নয়– আমরা আমাদের খুব কাছাকাছি এদের খুঁজে পাই।

নূতন পৃথিবীতে এদের কোনো স্থান নেই, হয়তো সে জন্যেই সারা পৃথিবীতেই এরা এত মরিয়া হয়ে উঠেছে। একজন মানুষকে ভালোবাসা কত সহজ কিন্তু সেই সহজ এবং সুন্দর কাজটি না করে ভালোবাসার বদলে তারা কত কষ্ট করে হিংসা কিংবা বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করছে, দেখে মাঝে মাঝে খুব অবাক হয়ে যাই।

আমাদের দেশের এই মানুষগুলো দেশকে সামনে এগুতে দিতে চায় না, এরা দেশটাকে পেছনে টেনে রাখতে চায়। এই মানুষগুলো নিজে নিজে ভালো হয়ে যাবে কিংবা অসাম্প্রদায়িক হয়ে যাবে, হঠাৎ একদিন অন্য ধর্মের মানুষগুলোকে সম্মান করতে শুরু করবে এবং তাদের ভালোবাসতে শুরু করবে– সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই। আমরা যদি একটা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই তাহলে তার জন্যে আমাদের কাজ করতে হবে। সাম্প্রদায়িক মানুষের সারা পৃথিবীতেই কাজ করে যাচ্ছে, আমরা যদি তাদের দেখে শুধুমাত্র বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলি তাহলে হবে না।

আমার মনে হয়, সবার আগে আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু যে পার্থিবভাবে তা নয় মানসিকভাবে এবং আত্মিকভাবে। সারা দেশের সব মানুষের এটাকে নিন্দা করতে হবে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের নিজেদের ভাষায় প্রতিবাদ করতে হবে।

আমাদের দেশে ‘সুশীল সম্প্রদায়’ কথাটি এখন ইতিবাচক কথা নয়, তারপরও যেটুকু আছে তাদেরও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে, লেখালেখি করতে হবে। সাংবাদিকদের পত্রপত্রিকা-রেডিও-টেলিভিশনে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। এবং অবশ্যই সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সরকারের। যারা ক্ষতিগ্রস্ত তাদের সাহায্য করে যারা অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে হবে যেন ভবিষ্যতে কারো মাথায় যদি এ রকম ঘটনার একটি অশুভ চিন্তা খেলা করে তারা যেন কাজটি করার আগে একশবার চিন্তার করে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি এখন উন্নয়ন করে মাধ্যম আয়ের দেশ হওয়া নয়, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেশটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলা।

এই দেশে একটা শিশু যখন বড় হয় তখন স্কুলে তাকে আমরা বিশ্লেষণ করতে শেখাই না, তাকে আমরা কোনো প্রশ্ন না করেই সব তথ্য মেনে নিতে শেখাই। যদি তাকে বিশ্লেষণ করতে শেখাতাম তাহলে তারা চারপাশের সাম্প্রদায়িক পরিবেশকে নিজেরাই প্রশ্ন করতে শিখত এবং সত্যি উত্তরটি নিজেরাই বের করে নিতে শিখত।

একেবারে শিশুদের স্কুল থেকে তাদের শিখাতে হবে– ভিন্ন মানে খারাপ নয়, ভিন্ন মানে বৈচিত্র্য আর এই পৃথিবীর পুরো সৌন্দর্যটিই আসে বৈচিত্র্য থেকে। একটি মুসলমান শিশু যখন প্রথমবার একটা হিন্দু শিশুকে দেখবে কিংবা যখন একটা হিন্দু শিশু প্রথমবার একটা মুসলমান শিশুকে দেখবে তখন দুজন দুজনের ভেতর যে পার্থক্যটুকু খুঁজে পাবে সেটাই হচ্ছে বৈচিত্র্য! সেই বৈচিত্র্যটি দোষের নয়, সেই বৈচিত্র্যটিই হচ্ছে সৌন্দর্য। সেই সৌন্দর্যটি দূরে ঠেলে রাখতে হয় না, সেই সৌন্দর্যটুকু উপভোগ করতে হয়।

দেশটিকে অসাম্প্রদায়িক আধুনিক একটা বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে একেবারে শৈশবে তাদের এই দেশের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের সাথে, তাদের উৎসবের সাথে, রীতিনীতির সাথে সংস্কারের সাথে এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে যেন তারা সকল ধর্মের জন্যে সমান শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বড় হতে শেখে।

আমরা আমাদের দেশে রামুর ঘটনা কিংবা নাসির নগরের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর দেখতে চাই না। এই দেশে মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের দেশটিকে যুতটুকু আপন বলে ভালোবাসতে শেখে অন্য ধর্মের মানুষও যেন ঠিক একইভাবে দেশটিকে সমানভাবে নিজরে দেশ বলে ভাবতে শেখে– সেটি নিশ্চিত করতেই হবে। যদি সেটি না হয় যদি তারা শুধু গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাহলে বুঝতে হবে বাংলাদেশ কিন্তু আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ হতে পারেনি।

আমরা কি দীর্ঘশ্বাসটুকু শুনতে পাচ্ছি?

লেখক: লেখক ও অধ্যাপক, কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত