রামপালের কালো ধোঁয়া
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০১৬, ০১:৩৪
কয়লা নিয়ে আমার স্মৃতি ভালো নয়। শৈশবে আমাদের দেশে গ্যাস ছিল না, রান্না-বান্না হত কেরোসিনের চুলায় কিংবা কাঠের লাকড়ি দিয়ে এবং কোথাও কোথাও কয়লা দিয়ে। বাজারে দুই রকম কয়লা পাওয়া যেত। একটা পাথুরে কয়লা, অন্যটা কাঠ কয়লা। কাঠ কয়লা দিয়ে সহজেই আগুন ধরানো যেত। কিন্তু পাথুরে কয়লা জ্বালাতে সবার জান বের হয়ে যেত।
রেস্টুরেন্টগুলোতে পাথুরে কয়লা জ্বালাতে গিয়ে কর্মচারীরা গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছে এবং গল গল করে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হয়ে আকাশ কালো করে ফেলছে এরকম একটা দৃশ্য মনের মাঝে গেঁথে আছে।
যেদিন থেকে খবর পেয়েছি রামপালে কয়লা ব্যবহার করে একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি হবে সেই দিন থেকে শৈশবের সেই স্মৃতিটা ফিরে এসেছে এবং চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে বড় বড় চিমলি এবং সেখান থেকে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে এরকম একটা দৃশ্য দেখতে পাই। শুধু যে কল্পনায় দেখতে পাই তা নয়, ঢাকা সিলেট যাতায়াত করার সময় রাস্তার পাশে অসংখ্য ইটের ভাটায় সত্যি সত্যি কুচকুচে কালো র্ধোয়া গলগল করে বের হচ্ছে সেই দৃশ্য দেখতে হয়।
পৃথিবীতে ইটের ভাটার চেয়ে অসুন্দর কোনো দৃশ্য হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
বর্ষাকাল আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু এবং তার অনেকগুলো কারণের সাথে নুতন এই কারণটি যোগ হয়েছে যে, এই সময়ে ইটের ভাটাগুলো বন্ধ থাকে, চিমনি দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হতে পারে না। ইটের ভাটাতে ইট তৈরি হয়, সেই ইট দিয়ে দেশের দালান-কোঠা তৈরি হয়। তাই ইটের ভাটার উপর আমার যত আক্রোশই থাকুক তার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কখনও কিছু লিখিনি।
(আমার কিশোর উপন্যাসে ইটের ভাটার মালিকদের ভিলেন হিসেবে দেখিয়েই আমার ক্ষোভটুকু মিটাতে হয়েছে।)
দেশের জন্যে ইলেকট্রিসিটি দরকার, কাজেই দেশে কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে হবে, কাজেই চিমনি দিয়ে কুচকুচে কালো ধোঁয়া বের হলেও সেটা মেনে নিতে হবে এরকম একটা যুক্তি দেখানো যায়। কিশোর উপন্যাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালিকদের ভিলেন এবং যে সব আমলারা এর যুক্তি তৈরি করে দিয়েছেন তাদেরকে সুপার ভিলেন হিসেবে দেখিয়ে আমার ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্যেও কেউ কেউ আমাকে বুদ্ধি দিতে পারেন।
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।
আমি যখনই কল্পনায় রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দেখার চেষ্টা করি তখনই শুধু যে কয়েকটি উঁচু চিমনি দিয়ে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হতে দেখি তা নয়, আমি কল্পনায় দেখতে পাই সেই চিমনি আমার অতিপ্রিয় সুন্দরবনের ঘন সবুজ বনের সারি সারি গাছ আড়াল করে রেখেছে– দৃশ্যটি আমি কোনোমতে মানতে পারি না। সুন্দরবনের ভেতর থেকে উপরের দিকে তাকালে আমি দেখব উঁচু চিমনি থেকে গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে, আমি সেই দৃশ্য চোখের সামনে থেকে সরাতে পারি না।
আমি জানি, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা রীতিমত হা হা করে আমার কাছে ছুটে এসে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে মোটেই গলগল করে কালো ধোঁয়া বের হবে না। স্টকিয়োমেট্টিক এয়ার ফুয়েল, স্বল্পমাত্রার কমবাশন, ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশান ওয়েট লাইমস্টোন ট্রিটমেন্ট, কুলিং ওয়াটার রিসারকুলেশান পিএইচ সেভেন এই ধরনের কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে আমাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন যে, সুন্দরবন থেকে দশ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে থেকেও এটা সুন্দরবনের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করবে না।
এই গালভরা শব্দচয়ন এবং বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড তাদের ওয়েবসাইটে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের রিপোর্ট জনসাধারণের জন্যে উম্মুক্ত করে রেখেছে এই তথ্য জানার পরও এই দেশের কোনো মানুষেরই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যে বিন্দুমাত্র ভালোবাসা জন্ম নেয়নি। তার প্রধান কারণ, ভারত তাদের নিজের দেশে এরকম কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার অনুমতি দেয়নি। সেই ভারত বাংলাদেশে সুন্দরবনের এত কাছে এরকম একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছে সেটি কার কাছে একটি মহৎ উদ্যোগ বলে মনে হবে?
কোম্পানিটির নামে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ কথাটি থাকলেও খুবই সঙ্গত কারণে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে এই দেশের মানুষ এটাকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষকে দোষ দেওয়া যায় না। একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্ট লিখেছে, ’’ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকনমিক্স এন্ড ফাইনান্সিয়াল এনালিস্ট সন্দেহ করছে এই প্রজেক্টটি দাঁড় করানো হয়েছে বাংলাদেশে ভারতের কয়লা বিক্রি করার জন্যে …” ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নই, অর্থনীতির মানুষ নই, পরিবেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান কমন সেন্সের একটু বেশি। কাজেই রামপালের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে আমার মতামতের কোনো বিশেষজ্ঞ মূল্য নেই, আমি নিজেও সেটা খুব ভালো করে জানি। কিন্তু রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে সাধারণ মানুষেরা কী ভাবছে আমার মনে হয় সরকারের সেটা জানার দরকার আছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সমমনা বেশ কয়েকজন শিক্ষক অনেক বছর থেকে সপ্তাহের একটি দিন বসে কোনো একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। এই সপ্তাহে আমাদের আলোচনায় বিষয় ছিল, ’’বিদ্যুৎ নাকি সুন্দরবন? নাকি দুটোই?” নানা বিষয়ের নানা বয়সের অনেক শিক্ষকের মাঝে আমি একজন শিক্ষককেও খুঁজে পাইনি যে, রামপালের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মেনে নিতে রাজি আছে। এই শিক্ষকেরা আবেগ-নির্ভর যুক্তিহীন মানুষ নয়। দেশের জন্যে তাদের ভালোবাসা আছে, সরকারের জন্যে মমতা আছে, তারপরও তাদের কারও কাছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র একটি গ্রহণযোগ্য প্রজেক্ট নয়।
পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি বের হয়েছে। তার মাঝে কোনো লেখাতেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে কাউকে কিছু লিখতে দেখিনি। শুনেছি টেলিভিশনের টক শোতে সরকারের পক্ষের কিছু মানুষ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন, কিন্তু কয়লা-নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পক্ষে কাউকে নরম করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
পৃথিবীর সামনে গর্ব করার মতো আমাদের খুব বেশি কিছু নেই, সুন্দরবন এর মাঝে ব্যতিক্রম। যারা সুন্দরবন দেখেছে তারা এটাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। সেই সুন্দরবনের ক্ষতি হয়ে যাবে সেটি এই দেশের কেউ মেনে নেবে না। দেশের একেবারে সাধারণ মানুষও এত দিনে জেনে গেছে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াটের অর্ধেকও পাওয়া সম্ভব নয়, দ্বিগুন দামে এই ইলেকট্রিসিটি কিনতে হবে, লাভের টাকা চলে যাবে ভারতে, পরিবেশ নষ্ট হবে বলে দুই দুইটি ব্যাংক এই প্রজেক্ট থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। আমার মনে হয়, এরপরও জোর করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করার চেষ্টা করলে সরকার তার অর্জনের অনেকটুকুই স্লান করে ফেলবে।
আমি বারবার বলেছি আমি এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নই, কমন সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি এই দেশের জন্যে আমাদের ইলেকট্রিসিটির দরকার। শুধু ঘরের আলো জ্বালানোর জন্যে কিংবা গরমে ফ্যানের বাতাস খাবার জন্যে নয়, এই দেশটাকে এগিয়ে নেবার জন্যে। আমার ধারণা কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও এই দেশের মানুষ গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যাবে যদি এটিকে আরও দশ থেকে পনেরো কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে নেওয়া হয়।
একটি দেশের জন্যে সেটি কী এতই দু:সাধ্য একটি কাজ?
আমাদের প্রিয় সুন্দরবনটাকে অক্ষত রেখে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হবে সেই ঘোষণা দিলে দেশের সব মানুষের বুকের ভেতর থেকে চাপা নিংশ্বাসটি বের হয়ে সবার মুখে যে হাসি ফুটে উঠবে সরকার সেটি কি একবারও দেখতে পায় না?
লেখক: লেখক ও অধ্যাপক, কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট।