মেরুদন্ডযুক্ত মানুষ চাই
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০১৬, ০১:১৬
পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় সহযোগীরা '৭১-এ বাঙালির বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল। এখন আমরা সাঁওতালদের বাড়িঘরে আগুন দেই। দেড় হাজার ঘর পোড়ানো চারটিখানি কথা নয়। সেটা আমরা সফলভাবে করতে পেরেছি। আমরা বলতে, আমাদের লোকেরা করেছে আরকি! দায় আমিও এড়াচ্ছি না; কারণ নিজের পিঠ হাতরিয়ে ঠাওর করতে পারছি না সেখানে মানুষের মেরুদন্ড সংযুক্ত কিনা।
যে কথাটি আমি বলতে চেয়েছিলাম তা আগেই বলে দিয়েছেন লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লী জ্বালিয়ে দেয়া ও মানুষ হত্যার প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন: “গত কয়েক বছরে যে কোনো হামলার একটি নতুন আলামত দেখা যাচ্ছে। পুলিশ যেখানে যাচ্ছে, সেখানে তাদের সঙ্গে একটি অক্সিলারি (সাহায্যকারী) বাহিনী থাকছে।
যেভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যের সঙ্গে আলবদর ও রাজাকার বাহিনীরা থাকত। ঠিক সেভাবে কিছু ছাত্র ও যুবক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যাচ্ছে, প্রতিটি জায়গায়। তারা লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ সবকিছু করছে।”
গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ও বাগদা ফার্ম এলাকায় হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যার ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে কারা নেতৃত্ব দিয়েছে? আমি ছয়টি নাম বলে দেই। ১. আওয়ামী লীগের (গাইবান্ধা-৪) সংসদ সদস্য আলহাজ্ব অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, ২. রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল, ৩. গোবিন্দগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল হান্নান, ৪. সাহেবগঞ্জ থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার, ৫. সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি (এমপি মহোদয়ের শ্যালক) শাকিল আলম বুলবুল এবং ৬. কাটাবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক। মিডিয়ায় এদের নাম এসেছে। প্রত্যক্ষ্যদর্শী ও আক্রান্তরা এদের কথা বলেছে। যদি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ থেকে থাকে, যদি সেই বাংলাদেশকে পরিচালনার জন্য কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকে এবং সেই সরকারের কর্মকান্ডের উপর জাতীয় জনবিবেকের প্রহরা থাকে তবে এই ছয়জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, নির্যাতন ও মানুষ হত্যার অপরাধের জন্য আইনে যে ব্যবস্থা নির্ধারিত আছে সেই ব্যবস্থা দেখতে চাই। আসলেই সে ব্যবস্থা নেয়া হবে কি? আমি পেছনে মানুষের মেরুদন্ড খুঁজে পাচ্ছি না।
১৯৬২ সালে রংপুর চিনিকলের প্রয়োজনে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকার ২০ গ্রামের (১৫টি সাঁওতাল পল্লী এবং ৫টি বাঙালি পল্লী) এক হাজার ৮৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। শর্ত ছিল আখচাষ না হলে ঐ জমি পূর্বের মালিকরা ফেরত পাবে। চিনিকল বহুদিন যাবত বন্ধ। কলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল দীর্ঘদিন থেকে সাঁওতালদের অধিকৃত জমি ভোগ দখল করে আসছেন। স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান ও অন্যান্য শক্তিমানদের ভাগ দিয়েই তিনি ঐ সম্পদ ভোগ করছিলেন। জমিতে আবাদ হচ্ছিল। কিন্তু সরকারের খাতায় জমা হচ্ছিল প্রায় শুন্য। ঐ ভোগদখলের ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষমতাধরদের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল। এমপি’র শ্যালক তথা ছাত্রলীগ নেতা তথা ইউপি চেয়ারম্যান বুলবুল তার নিজের সার্থে সাঁওতালদের নেতা সেজেছেন এবং নিজের স্বার্থেই তাদের উপর হামলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। সাঁওতাল পল্লীতে হামলার জন্য কয়েকটি গ্রাম থেকে মানুষ জড়ো করা হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব উপস্থিত থেকে হামলার তদারকি করেছে, হামলায় অংশ নিয়েছে এবং এলোপাথারি গুলি করে মানুষ মেরেছে। আত্মরক্ষার জন্য সাঁওতালরা তীর ছুড়েছে। নির্বোধ ভূমিপুত্ররা করাপ্ট রাষ্ট্রশক্তি কি জিনিস তা বোঝেনি।
কিছুকাল আগে শাহজান আলী নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি মামলায় জয়ী হয়ে অধিগ্রহণকৃত জমি ফেরত পান। এরপর সাঁওতালদের মধ্যে নতুন আশাবাদ সঞ্চার হয়। দুই বছর আগে সাঁওতালরা পূর্বপুরুষের জমি ফেরত পেতে আন্দোলন শুরু করে। তাদের আশাবাদী করে সংগঠিত করা এবং নতুন বসতি স্থাপনে সহায়তার কাজও স্থানীয় নেতারা করেছে। এরপর তাদের একাংশ স্বার্থের অপরপ্রান্তের কাছে ধরা দিয়েছে। ভূমি বিরোধ যাই হোক; ধরে নিলাম সাঁওতালদের দাবি অন্যায্য এবং ঐ ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করাটা ন্যায্য। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযানের আদেশ সরকারের কোন কর্তৃপক্ষ দিল? ডিসি বলছেন, তিনি এরকম কোনো আদেশ দেননি। ইউএনও কি এরকম আদেশ দিতে পারেন? আদালতের আদেশ ছাড়া এরকম ক্ষমতা (ক্ষেত্র বিশেষে জেলা প্রশাসকের থাকলেও) ইউএনও’র নেই। অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করার অধিকার? সেটা কারও নেই। আইন প্রয়োগ হয়েছে, নাকি জুলুম হয়েছে? কাদের উপর? যারা সংখ্যালঘুদের সংখালঘু তাদের উপর!
ধরে নিলাম ঐ জমির উপর তাদের অধিকার নেই। সেজন্য তাদের উপর রাষ্ট্রশক্তির ভয়ানক প্রয়োগ কেন করতে হবে? তারা দরিদ্র ও ভূমীহীন নয়? আবাসন তাদের অধিকার নয়? তাদের বাসস্থানের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কি করেছে? এটাতো রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। দেশে রাষ্ট্রীয় জমির অবৈধ দখলদার কত? তারা কারা? ভুমি দস্যু উপাধি কারা পেয়েছে? রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবশালীদের বাদ দিয়ে শুধু কয়েকটি ডেভলপার কোম্পানির দখলদারিত্বের চিত্র তুলে ধরতে চাইলে একটা বই হয়ে যাবে। তাহলে সাঁওতাল উচ্ছেদে এত উৎসাহ কেন?
সাঁওতাল নামের এই নৃগোষ্ঠী বাংলা-ভারতের ইতিহাসে এক অমোচনীয় অধ্যায়। বীরত্ব, সাহসীকতা ও আত্মত্যাগের জন্য সহজ সরল এই ভুমিপুত্ররা লড়াকু মানুষের নমস্য। ইংরেজ শাসনামল থেকে সবচেয়ে বেশি নির্যাতন যাদের উপর হয়েছে। সংখ্যায় আজ তারা নগন্য। ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর হামলা হলে অন্তত: দেড় কোটি মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়। হিন্দুদের সামাজিক বন্ধু ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মানুষ মিলে আক্রান্তদের সাথে সমব্যথি মানুষের সংখ্যাটা বেশ বড় হয়ে যায়। কিন্তু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠি সাঁওতালদের উপর হামলা হলে আক্রান্ত ও সমব্যথির সংখ্যা কত হতে পারে? ভোটের অংকে খুব একটা বোধ হয় বিবেচ্য নয়। প্রতিবাদও সামান্য। বিশেষ করে আমরা যখন মানুষের মেরুদন্ড হারিয়ে ফেলি।
আমাদের মেরুদন্ড কোথায় গেল? আমরাও তো সোজা মেরুদন্ড নিয়ে বহুবার দাঁড়িয়েছি। বেশি অতীতে যাবনা। ১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের আমলে গাইবান্ধায় সারের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষকদের এক মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ কৃষককে হত্যা করা হয়। প্রতিবাদে উত্তাল হয় সারাদেশ। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন দমনের জন্য ১৭ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রবল প্রতিবাদ ছড়িয়ে পরে। ২০০৬ সালের ২৬শে আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে আদীবাসী কৃষকদের উপর গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করা গেছে, কিন্তু কৃষকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের জমির উপর উন্মুক্ত কয়লা খনি প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। গণপ্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে হয়েছে সরকারকে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হত্যা, ধর্ষন, নির্যাতনের মহামারি শুরু হলে সুধীজনের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। এখন সুধীজনের কন্ঠে জোর নেই কেন?
সেসময় বিরোধী দলীয় নেতা আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা জনতার আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় তিনি নিজেই ঘটনাস্থলে ছুটে গেছেন। আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী। বিএনপি’র কতিপয় স্থানীয় কর্মী রাজশাহীর গ্রাম এলাকায় মহিমা নামে একটি মেয়েকে ধর্ষনের পর অনলাইনে ছবি ছড়িয়ে দিলে নির্যাতিতা মেয়েটি আত্মহত্যা করেছিল। শেখ হাসিনা মহিমাদের বাড়ি পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলেন। দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত ছুটে বেরিয়েছেন তিনি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনেক সাংবাদিকের সঙ্গে আমিও সেসময় তার গাড়িবহরে ছিলাম। এখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। এখন পাঁচ বছরের পুজা ধর্ষিত হলে, হিন্দুপল্লীতে হামলা হলে কিংবা সাওতাল পল্লীতে আগুন দেয়া হলে নির্যাতিত মানুষের পাসে দাঁড়ানোর জন্য অতবড় কোনো নেতা নেই। তিনি ক্ষমতায় গেছেন। তার দলের নেতাকর্মীরা খাচ্ছেদাচ্ছে আর মানুষের উপর ক্ষমতার চর্চা করছে। অন্যদিকে ক্ষমতা হারিয়ে কাতর আর এক নেত্রী অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য আরও ভয়াবহ হিংস্রতা অবলম্বন করছেন। পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পোড়ানোর একের পর এক ঘটনা দেখে মানুষের অনুভুতি ভোতা হয়ে গেছে। নিরুপায় আমরা মেরুদন্ড বাকিয়ে মাটি থেকে খাবার খুটছি। প্রাপ্তির সন্ধানে আমাদের বিশিষ্টজনরাও উপরের গাছপাতা কিংবা নিচের ঘাষ চাটছেন। কারও সামনে তাকানোর সময় নেই। ঘার আর সোজা হয়না। মন্ত্রী হতে হবে, উপদেষ্টা হতে হবে, উপাচার্য হতে হবে, বোর্ড/কমিশনের চেয়ারম্যান বা মেম্বার হতে হবে, সরকারী কমিটিতে জায়গা পেতে হবে, ফায়দা নিতে হবে। সরকারী জমির লীজ নিতে হবে। অতএব বিবেকে তালা। সুধীজনের মেরুদন্ড বেঁকে গেছে; বদলে গেছে। তাই মানুষের মেরুদন্ড বিশিষ্ট নতুন মানুষ খুঁজছি।
#নোটঃ আমার লেখায় ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি অতি অনুগত যেসব বন্ধু ক্ষুহ্ণ হচ্ছেন তাদের বলছি: আমি আমার এই লেখাটি প্রত্যাহার করতে চাই। ঘরবাড়িতে আগুন দেয়ার অপরাধ যারা করেছে, যারা মানুষ হত্যা করেছে এবং যারা সরকারী দায়িত্বে থেকে জুলুমে যুক্ত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হোক। আমি লেখাটি প্রত্যাহার করব। এরকম কিছু লিখতে চাইনা। যতক্ষণ “প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে” কেঁদে ফিরবে ততক্ষণ কম্পিউটারের কিবোর্ড সচল থাকবে।
পুলক ঘটক এর ফেসবুক থেকে