নারীবাদের আসলে কোন বাউন্ডারি নেই
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৬, ২২:১১
নারীবাদ বা ফেমিনিজম সম্পর্কে যে প্রশ্ন/মন্তব্যগুলো প্রায়ই শুনতে পাই
>> ফেমিনিজিম শুধু নারী অধিকারের কথা বলে। কিন্তু সমাজে আরো অনেক ধরণের অধিকার বঞ্চিত মানুষ আছে।
একটা সময় ধরে ফেমিনিজম শুধু নারীর কথা বলে এসেছে। পাশ্চাত্যে নারীবাদের ইতিহাসকে মোটা দাগে ফার্স্ট ওয়েভ, সেকেন্ড ওয়েভ, থার্ড ওয়েভ এই তিনভাবে ভাগ করা হয় (এই শ্রেণীবিভাগের কিছু সমালোচনাও আছে)। ফার্স্ট ওয়েভ ও সেকেন্ড ওয়েভের ফেমিনিস্টরা নারীর ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, কাজের অধিকার এই ধরণের বিষয়ের ওপর লিখেছেন ও আন্দোলন করেছেন। তখনকার সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিষয়গুলোর ওপরে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি ছিলো।
ফার্স্ট ও সেকেন্ড ওয়েভের ফেমিনিস্টরা সমালোচনার মুখোমুখি হন কারণ তাদের কাজ মোটামুটি শ্বেতাঙ্গ মধ্যবিত্ত নারীদের ওপরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। তারা কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের কথা বলেননি, দরিদ্র নারীদের কথা বলেননি, খেটে খাওয়া নারীদের কথা বলেননি।
Kimberle Crenshaw নামে একজন ব্ল্যাক ফেমিনিস্ট প্রথম Intersectionality বলে একটা ধারণার কথা বলেন ১৯৮৯ সালে। এই ধারণার মূল বক্তব্য হলো নারীকে শুধু “নারী” হিসেবে গণ্য করলে সে নারী হওয়া ছাড়াও অন্যান্য যেসব কারণে বৈষম্যের শিকার হয়, সেগুলো ইগনোর করা হয়। যেমন বাংলাদেশের একজন হিন্দু শ্রমিক নারী হিন্দু হওয়ার কারণে, শ্রমিক হওয়ার কারণে, এবং নারী হওয়ার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে পারে। Crenshow বললেল যে, এই বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যগুলো কীভাবে নারীর অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করে সেটা আমদের বুঝতে হবে।
সুতরাং, ফেমিনিজম যে নারী ছাড়া আর কোন অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা বলে না, এই ধারণা মনে হয় পুরোপুরি ঠিক না। ফেমিজিম ধনী নারীর কথা বলে, দরিদ্র নারীর কথা বলে। প্রথম বিশ্বের নারীর কথা বলে, তৃতীয় বিশ্বের নারীর কথা বলে। এমনকি শুধু নারীর কথা নয়। যারা নিজেকে নারী হিসেবে আইডেন্টিফাই করেন না, তাদের অধিকারের কথাও বলে। কীভাবে? বলছি পরের পয়েন্টে।
>> পুরুষেরাও অধিকার বঞ্চিত হয়, তাদের কথা কে বলবে?
ফেমিনিজমকে জেন্ডার স্টাডিজ থেকে আলাদা করে দেখার খুব বেশি উপায় নেই। একজন নারী কীভাবে নারী হয়ে ওঠে, একজন পুরুষ কীভাবে পুরুষ হয়ে ওঠে, কী কী কারণে সমাজ তাদের কাছ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা আশা করে সেটা ফেমিনিজমের আলোচ্য বস্তু। সে হিসেবে একটি ছেলে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে কীভাবে অনেক সময় স্বকীয়তা হারিয়ে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে breadwinner, aggressive, macho man হয়ে ওঠে অথবা মা-স্ত্রীর দ্বন্দ্বের মাঝে একজন ছেলের ভূমিকা কী সেটিও ফেমিনিজমের আলোচ্য বস্তু হতে পারে।
নারীবাদ যে শুধু নারী ও পুরুষের কথা বলে, তা নয়। Judith Butler ১৯৯০ সালে তার Gender Trouble বইয়ে বলেছেন নারীবাদ শুধু নারী ও পুরুষ নিয়ে আলোচনা করলে কী কী সমস্যা তৈরি পারে। সমাজে অনেকে আছেন যারা প্রচলিত অর্থের “নারী” বা “পুরুষ” নন – যেমন আমরা যাদের বলি “হিজড়া” বা “মেয়েলি পুরুষ” বা “পুরুষালি মেয়ে” বা “সমকামী।” নব্বইয়ের দশক থেকে এদের অভিজ্ঞতাও নারীবাদের আলোচ্য বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
>> আলাদা করে নারীবাদের কথা বললে অন্যান্য অধিকার বঞ্চিত মানুষ যারা নারী নয় – তাদের কথা বাদ পরে যায়।
নারীবাদী অনেক ভালো ভালো স্টাডি critical race theory, disability studies, queer studies, ethnic studies – এই ধরণের ফিল্ডগুলোর intersection এ কাজ করে। মনে করুন আপনি বাংলাদেশের জাহাজভাঙা শিল্পের একজন শ্রমিকের জীবন নিয়ে গবেষণা করতে চান। নারীবাদী ফ্রেম (যদি চান তবে অন্যান্য ফ্রেমের সাথে সমন্বয় করে) ব্যবহার করে আপনি এই গবেষণায় ওই শ্রমিক তার জেন্ডার, শ্রেণী, ধর্ম, গোত্র, পেশা ইত্যাদির কারণে কীভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তা আলোচনা করতে পারেন। শ্রমিক যদি পুরুষও হয়, তাতেও কোন সমস্যা নেই। কারণ জেন্ডার রোল (নারী বা পুরুষ হওয়ার কারণে আমরা কী কী করি) নারীবাদের অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আবারো বলছি intersectionality (অনেকে এখন intersectionalityর বদলে assemblage সহ অন্যান্য কিছু ধারণার কথা বলেন। সেই তাত্ত্বিক আলোচনায় যাচ্ছি না) নারীবাদের অন্যতম প্রধান একটা টুল। নারীবাদ বুঝতে চায় আমাদের জেন্ডার, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদির intersection এ কীভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা প্রভাবিত হয়।
>> নারীবাদ একটি পশ্চিমা ধারণা।আমাদের সমাজে এই ধারণা অচল।
নারীবাদী অনেক ধারণায় পাশ্চাত্য ভাবধারার প্রবল প্রভাব আছে কথাটি সত্য। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিক ও অ্যাক্টিভিস্ট এর প্রতিবাদ করেছেন। Chandra Mohanty তার Under the Western Eyes প্রবন্ধে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী নারীবাদ তৃতীয় বিশ্বের নারীদের কথা বলতে গিয়ে কী ধরণের সমস্যা তৈরি করে এবং কীভাবে এই সীমাবদ্ধতাগুলো এড়ানো যায় সে ব্যাপারে খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন। Mohanty সহ সারা পৃথিবীর আরো অনেক নারীবাদী তাত্ত্বিক ও অ্যাক্টিভিস্ট নারীবাদের “পাশ্চাত্যকরণের” প্রতিবাদে কাজ করে যাচ্ছেন।
>> নারীবাদ একটি সংকীর্ণ ভাবধারা। আমি নারীবাদী নই, মানবতাবাদী।
মানবতাবাদ বা হিউম্যানিজমের অনেক ধরণের সংজ্ঞা আছে। আপনি কোন সংজ্ঞায় নিজেকে মানবতাবাদী দাবী করছেন সেটি জানা প্রয়োজন।
আঠারো এবং উনিশ শতকের এনলাইটেনমেন্ট ফিলসফির “হিউম্যানিজম”এর সংজ্ঞার অনেক সংকীর্ণতা আছে। Nietzsche, Freud, Marx সহ অনেকে বিভিন্ন পার্সপেক্টিভ থেকে হিউম্যানিজমের সমালোচনা করেছেন। খুব সহজ ভাষায় (খানিকটা ওভার সিমপ্লিফাই করেই বলছি) আঠারো ও উনিশ শতকের হিউম্যানিজম “সব মানুষ সমান ও স্বাধীন” দাবী করতে গিয়ে ভুলে গিয়েছে যে প্রতিটি মানুষের ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবস্থানের কারণে তার অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন ভিন্ন।
সমাজে একজন রিক্সাওয়ালা ও একজন প্রাইম মিনিস্টারের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন এক নয়। একজন আদিবাসী ও একজন বাঙালির অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন এক নয়। এদের ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োজন ও অভিজ্ঞতা বোঝার জন্য খুব বেশি টুল “হিউম্যানিজম” (এনলাইটেনমেন্ট ফিলসফি থেকে যার উদ্ভব) এর কাছে নেই। আপনি যদি এদের সার্বিক অভিজ্ঞতা বুঝতে চান তাহলে তাদের জেন্ডার, শ্রেণী, পেশা, বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা ইত্যাদির আলোকে আপনাকে এদের অভিজ্ঞতা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এবং আপনাকে এই বিষয়ে “হিউম্যানিস্ট’ (সহজ ভাষায় “সব মানুষ অধিকার সমান”) ফিলসফির চেয়ে অনেক বেশি সাহায্য করবে feminist studies, critical race studies, disability studies, Marxist class analysis, queer studies, ethnic studies এর মত ফিল্ডগুলো। কারণ এই ফিল্ডগুলো বোঝার চেষ্টা করে কেন সমাজে সব মানুষের অবস্থান সমান নয়, বিশেষ কনটেক্সে “অধিকার” বলতে কী বোঝায়, এবং কীভাবে মানুষ social stratification কে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।
ফেমিনিজম কিন্তু হিউম্যানিজমের এক ধরণের সমালোচনা। আঠারো/উনিশ শতকে সবাই যখন humanistic approach এর কথা বলছিলো, তখন ফেমিনিস্ট চিন্তা-ধারার কিছু মানুষ বলা শুরু করলো (যেমন Mary Wollstonecraft) – তোমরা যে human এর যে বলছো, তোমরা কি চিন্তা করে দেখেছো যে এই human বলতে তোমরা আসলে “man” কে বোঝাচ্ছো? সব মানুষ সমান বলতে গিয়ে তোমরা আসলে বলছো “সব পুরুষ সমান।" তোমাদের “মানুষ” এর বর্ণনায় কিন্তু নারীর অভিজ্ঞতা বাদ পড়ে যাচ্ছে।“
>> কোন ফেমিনিস্ট গ্রুপকে কখনো নারী ছাড়া অন্য কারো কথা বলতে শুনিনি।
নারীবাদ বলে আসলে এক ধরণের কোন মতবাদ নেই। এটা ক্রমাগত বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হচ্ছে। এটাই নারীবাদের সৌন্দর্য। নারীবাদের সংজ্ঞা হলো “XYZ” বা নারীবাদের মূল বিষয়গুলো হলো “XYZ” এভাবে বলা খুব কঠিন।
আমরা যদি বলি “ফেমিনিস্ট গ্রুপরা নারী ছাড়া অন্য কারো কথা বলে না, সুতরাং নারীবাদ একটি সংকীর্ণ ধারণা” – তাহলে মনে হয় নারীবাদের ওপর একটু অবিচার করা হয়ে যায়। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের যেমন একটা খুব অসাধারণ ইতিহাস আছে, তেমনি এখনকার এনজিও কেন্দ্রিক নারীবাদী আন্দোলনের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। আমি যেমন আমার পিএইচডি ফিল্ড ওয়ার্কের কাজের সময় অনেক শ্রমিক অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের বলতে শুনেছি “নারী আন্দোলন যে এত violence against women এর কথা বলে, কই গার্মেন্টেসের মেয়েদের ওপর ঘরে-বাইরে এত নির্যাতন হয়, সেটা নিয়েতো কোন নারী সংগঠনকে আন্দোলন করতে দেখলাম না।“ এটা বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের একটা সমস্যা। অনেক নারী সংগঠন “ফেমিনিজম”কে যেভাবে ফ্রেম করছে, সেই ফ্রেমকে আরো এক্সপান্ড করা সম্ভব। এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু পুরো “নারীবাদ”কে বাতিল করে দেয়া মনে হয় খুব একটা কাজের কথা না।
নারীবাদের আসলে কোন বাউন্ডারি নেই। ব্ল্যাক ফেমিনিজম, থার্ড ওয়ার্ল্ড ফেমিনিজম, ইকো ফেমিনিজম, ইসলামিক ফেমিনিজম, লেসবিয়ান ফেমিনিজম, ফ্যাট ফেমিনিজম, ট্রান্সন্যাশনাল ফেমিনিজম – এমন হাজারো ধরণের ফেমিনিজম আছে। প্রতিটা ধারার কিছু possibility আছে, কিছু limitation আছে। এক ধরণের ফেমিনিজম আবার আরেক ধরণের ফেমিনিজমের সীমাবদ্ধতাগুলোকে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করেছে। কোন বিশেষ ধারার ফেমিনিজিমের সীমাবদ্ধতা দিয়ে আসলে পুরো “নারীবাদ”কে বিচার করা সম্ভব না।
নারীবাদের সীমাবদ্ধতা নেই তা কখনো বলবো না। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতাগুলো অ্যাড্রেস করাও এক ধরণের নারীবাদী approach. নারীবাদ একটা ever evolving open কনসেপ্ট। ১০০ বছর আগেকার নারীবাদ আর এখনকার নারীবাদ এক ধরণের নয়, বাংলাদেশের নারীবাদ আর আমেরিকার নারীবাদ এক ধরণের নয়, আমার নারীবাদ আর আপনার নারীবাদ হয়তো এক ধরণের নয়।
এই ভিন্নতা নিয়েই নারীবাদ প্রান্তিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করে যায়।
প্রথম প্রকাশ: জাগরণীয়া ২০১৪