নিজেকে নারীবাদী বলতে লজ্জা পাবেন না
প্রকাশ : ২৫ জুলাই ২০১৬, ২২:৪৫
বাংলাদেশের (এবং উপমহাদেশের) পুরুষদের দেখছি উনারা নিজেদের গায়ের লগে ‘নারীবাদী’ ট্যাগ লাগাইতে ডরান। উনাদের ‘আপনি কি নারীবাদী’ জিগাইলে উত্তর দেন, উনারা মানবতাবাদী।
হাহা।
বাংলাদেশের মানবতাবাদী পুরুষরা ভাবেন, নারীবাদী মাত্রই তসলিমা নাসরিন, নারীবাদী মাত্রই নাস্তিক, বিয়া ঘৃণা করা, বাচ্চা ঘৃণা করা, পুরুষ ঘৃণা করা, ব্রা পুড়ানো, রাস্তায় চিল্লানো, রিক্সাওয়ালাদের সাথে মারামারি করা, মেয়েলি কাজ (অর্থাৎ সাজগোজ, রান্নাবান্না) ঘৃণা করা পুরুষ হইতে চাওয়া বা পুরুষের সমকক্ষ হইয়া বিড়ি খাওয়া গাঞ্জা খাওয়া পঞ্চাশজনের লগে শোওয়া মেয়েদের দল- যাদের খাইয়া কাজ নাই, যারা স্বামী বা বাপের পয়সায় খাইয়া ‘আহ্লাদী’ সমাজসেবা করতে নামছেন।
অনেকে বলেন, ‘বাদ’ দিয়া ক্যানো দুনিয়ারে দেখতে হবে? নারীরে মানুষ ও পুরুষরে মানুষ হিসাবে ক্যানো দেখা হয় না? নারীরা নারী হিসাবে ক্যানো আলাদা ট্রিটমেন্ট চান? নারীরা নিজেদের ক্যানো শুধু মানুষ হিসাবে দেখতে পারেন না?
প্রথমতঃ- নারী ও পুরুষের শারীরিক ও মানসিক পার্থক্য দিনের আলোর মতই সত্য। ক্ষমতা দখলের মারামারিতে মেয়েরা পিছাইয়া পড়ছেন যখন থিকা মেয়েদের পেটে জন্ম নেওয়া সন্তানদের এবং সন্তানওয়ালা পেটদের পুরুষরা নিজেদের সম্পত্তি বইলা ভাবা শুরু করছেন। নারী পুরুষের বৈষম্য দূর হবে তখন- যখন মেয়েদের পেটের উপর পুরুষের একচ্ছত্র অধিকাররে সরায়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থিকা বাইর হইয়া নারী ও পুরুষ নিজ বুদ্ধিবৃত্তিতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের উর্ধ্বে গিয়া সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠা করতেছেন বা দুনিয়ার সকল নারী সকল প্রকার বৈষম্যর অবসান না হওয়ার আগ পর্যন্ত সন্তান জন্ম দিবেন না এমন বিপ্লবী পণ করতেছেন। দুনিয়া টিকাইয়া রাখার জন্যই মেয়েদের নিজেদের পেটে সন্তান জন্ম দিতে হবে, অন্ততঃ যতদিন না পর্যন্ত আর্টিফিশিয়াল এবং ইকোনমিক্যাল পদ্ধতিতে বংশবিস্তারের পদ্ধতি বিজ্ঞান আবিষ্কার করতেছেন। বিজ্ঞান যতদিন না ঐ পর্যায়ে আমাদের নিয়া যাইতেছেন, ততদিন- সন্তান জন্মদানের মত স্বাভাবিক ও মানবিক প্রক্রিয়ায় মেয়েদের বন্দী কইরা রাখার নামে যে ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক পদ্ধতি চলতেছে, তার প্রতিবাদই মূলতঃ নারীবাদ। পুরুষ শুধু বীর্যই সাপ্লাই দিতেছেন এবং নারী সেই বীর্য মারফত সন্তান জন্ম দিতেছেন এবং সেই সন্তানের উত্তরাধিকার (অর্থাৎ সম্পত্তি) নিয়া কোনো মারামারি কাটাকাটি হইতেছে না এমন ইউটোপিয়ান সমাজের চিন্তায় ‘নারীরে’ নারী এবং ‘পুরুষরে’ পুরুষ হিসাবে না ভাইবা তাদের উভয়রেই মানুষ হিসাবে ভাবা সম্ভবপরঃ হয় হয়তো। কিন্তু আমরা তো ইউটোপিয়ান সমাজে থাকি না, নাকি?
দুনিয়ার সকল ‘বাদ’ এক না। পুঁজি‘বাদ’এর জন্য আপনারে সংগ্রাম করতে হয় না, মানুষের স্বভাবজাত ক্ষমতাদখল এবং সম্পদ কুক্ষীগত করার বাসনায় মানুষ আপনা-আপনিই পুঁজিবাদী স্ট্রাকচারের ফ্রি মার্কেটের ভিতর ঢুইকা পুঁজিবাদী হইয়া পড়েন। কিন্তু সমাজবাদী (সমাজতন্ত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদের বিপরীত ‘বাদ’ না বাই দ্যা ওয়ে, অন্ততঃ আমি যতটুক বুঝি) বা এ্যান্টি-পুঁজিবাদী হইতে গেলে আপনার স্রোতের বিপরীতে বা এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে হয়। ঠিক একইভাবে মানবতাবাদী হইতে গেলে আপনার বিপ্লব করতে হয় না। দুনিয়ার সকল ধর্ম “আপাতঃ” মানবতার হা-বিতং গান গাইয়া গেছেন, কিন্তু নারী‘বাদ’ হইলো বিপ্লবের সেই রাস্তা যেই রাস্তায় মানবতাবাদ নারীদের সমান মর্যাদা দিতে পারেন নাই, বা দিতে চান নাই, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
তাই আপনি যখন বলেন, আপনি নারীবাদী না, তখন আপনি দুনিয়ার সকল নারীদের উপর সকল প্রকার বৈষম্যর পক্ষে অবস্থান নিতেছেন- ব্যক্তিগত জীবনে আপনি আপনার বৌরে সোনা রূপা হীরা দিয়া মুড়াইয়া রাখলেও, নিজের কন্যারে কান্ধে উঠাইয়া ভূমধ্যসাগর ঘুইরা আসলেও।
আপনি নারীবাদী না হইলে- আপনার অবস্থান দুনিয়ার সর্বহারাদের সর্বহারাশ্রেষ্ঠদের বিপক্ষে, আপনার অবস্থান প্রতিটা নামহীন পদবীহীন নারীর বিপক্ষে, আপনার অবস্থান প্রতিটা ধর্ষিত মেয়ের বিপক্ষে, আপনার অবস্থান নিজের পেটে জন্ম দেওয়া সন্তানের উপর অধিকার দাবী করতে না পারা প্রতিটা মায়ের বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থান বাপের বাড়িতে ও স্বামীর বাড়িতে লাত্থি খাইয়া নিজের বাড়ি খুঁজতে থাকা প্রতিটা বিবাহিত মেয়ের বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থান অফিসে শুধু নারী বইলা প্রমোশান আটকায়া থাকা প্রতিটা পরিশ্রমী মেয়ের সংগ্রামের বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থান শুধু মেয়ে বইলা একলা বাড়ির বাইরে যাইতে না পারা প্রতিটা স্বপ্ন দেখা মেয়ের বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থান বেশ্যাবৃত্তিতে নামতে হওয়া ১৩ বছরের মেয়ের বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থান সৌদি বাদশাহর হারেমে সেবা দেওয়া যৌনদাসীদের কান্নার বিরুদ্ধে, আপনার অবস্থান শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিকভাবে নির্যাতিত হওয়া প্রতিটা নারীর রক্তক্ষরণের বিরুদ্ধে। আপনার অবস্থান মানবতার বিরুদ্ধে।
ডিয়ার চাচা- আপনি মানবতাবাদী হইলে, আপনারে নারীবাদী হইতেই হবে। এরমাঝখানে আর কোনো ফার্স্ট ওয়েভ, সেকেন্ড ওয়েভ, নিও-লিবারেল, ক্ল্যাসিকাল, এ্যানার্কিস্ট, রাডিকাল, মার্ক্সিস্ট সংজ্ঞা নাই যা আপনারে নারীবাদী হইতে আটকায়। নারীবাদ অর্থ শুধু নারীর সমান অধিকার আদায়ের আন্দোলন। নারীবাদ মানে বিড়ি খাওয়া- পুরুষ ঘৃণা করা- ঠ্যাং ফাঁক কইরা বসা মেয়েদের আহ্লাদী দল না। আপনি নিজেরে “শিক্ষিত” এবং “মানুষ” ভাবলে নিজেরে নারীবাদী বলতে লজ্জা পাবেন না।
আপনি যদি কাশ্মীরের আযাদীর পক্ষে থাকেন, আপনি যদি ‘ইসলামোফোবিয়া’র বিরুদ্ধে থাকেন, আপনি যদি জাতিবিদ্বেষরে ঘৃণা করেন, আপনি যদি দুনিয়ার সকল সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারে কান্দেন, আপনার যদি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের উপর নির্যাতনে মন খারাপ হয়, তাইলে নারীদের সমান অধিকার আদায়ের বিপ্লবে শরিক হন। এ্যাকটিভিজমরে ক্ষ্যাত এবং হাস্যকর বানায়েন না। এ্যাকটিভিজম ছিলো বইলাই দুনিয়াতে এখন শ্রমিক ইউনিয়ন আছে, এ্যাকটিভিজম ছিলো বইলাই আফ্রিকান কালো মানুষরা এখন ভোট দিতে পারেন, আপনাদের সাদা চামড়াদের পাশে বসতে পারেন। এ্যাকটিভিজম ছিলো বইলাই বাংলাদেশ পাকিস্তান থিকা স্বাধীন হইতে পারছিলো। এ্যাকটিভিজম ছিলো বইলাই আপনার গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আছে ফেইসবুকে বইসা চিল্লাইতে পারার। এ্যাকটিভিজম “আছে” বইলাই দুনিয়া এখনো মগের মুল্লুক হইয়া যায় নাই। এ্যাকটিভিজমরে খাটো কইরা দেইখা নিজেরে স্মার্ট বানানোর নিমিত্তে নিজেরে হাস্যকর, অশিক্ষিত, অমানবিক এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পিয় ঘাসখাওয়া মূর্খ ছাগল প্রমাণ করবেন না।
প্লিজ।
নাদিয়া ইসলাম এর ফেসবুক থেকে