নারীবাদ বনাম পুরুষ বিদ্বেষ প্রসঙ্গে
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০১৬, ১৭:৪৪
নারীবাদ (ইংরেজি: Feminism) কথাটি নারীদের অধিকার আদায়, সমতা অর্জন এবং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংগঠিত বিভিন্ন মতবাদ ও আন্দোলনকে নির্দেশ করে। এখানে অধিকার আদায় এবং অংশগ্রহণ বলতে ভোটাধিকার, রাজনীতি, ব্যবসা, শিক্ষা, সমান কাজে সমান বেতন, সম্পত্তির অধিকার, শিক্ষার অধিকার, বিবাহে সমানাধিকার, মাতৃত্ব-অবসর ইত্যাদির স্বীকৃতি প্রদান তথা নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নকে বোঝায়। Olive Banks তার Faces of Feminism গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘যে গোষ্ঠী নারীর অবস্থান কিংবা নারী সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনে প্রয়াসী তাদের নারীবাদী বলে আখ্যা দেয়া হয়’’।
আমরা যদি নারীবাদের শুরুর দিকে তাকাই তবে দেখতে পাই বিভিন্ন মতবাদ অনুযায়ী নারীবাদী হতে পারেন যে কোন লিঙ্গের বা শুধুমাত্র কোনো নারী (এই ক্ষেত্রে নারীবাদী পুরুষরা হবেন উপনারীবাদী বা 'প্রোফেমিনিস্ট') যিনি নারী অধিকারে বিশ্বাস করেন। সেই ধারাবাহিকতায় নারীবাদী আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় অনেক পুরুষ উপনারীবাদী দেখা যায়। জন স্টুয়ার্ট মিল, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সহ অনেকেই।
নারীবাদী আন্দোলনের রয়েছে ভিন্নমত অনুযায়ী ভিন্নপথ। আমাদের দেশের অনলাইন ভিত্তিক নারীবাদী বা নারী অধিকারের পক্ষে যারা লিখছেন তাদের মধ্যেও রয়েছে আন্দোলনের ভিন্নভিন্ন মতাদর্শ। সম্প্রতি তসলিমা নাসরিনের একটা লেখার সূত্র ধরে শুরু হয়েছে নারীবাদীদের ভেতর কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি। যা নারী অধিকার আন্দোলন বা নারীবাদী আন্দোলনকেই হাস্যকর করে তুলেছে সাধারণ মানুষের কাছে। ওলিম্প ফাঁসির কাষ্ঠে যাওয়ার আগে দুরন্ত সাহস নিয়ে বলেছিলেন, ‘নারীর যদি ফাঁসি কাষ্ঠে যাবার অধিকার থাকে, তবে পার্লামেন্টে যাবার অধিকার থাকবে না কেন’? ওলিম্পকে হত্যা করার পরেও কেটে গেছে ৩০০ বছর। কিন্তু পাল্টায়নি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ধ্যান ধারণা। নারী আংশিক ভাবে সাফল্য পেলেও আসেনি সার্বিক স্বাধীনতা। এই দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারীবাদের ক্ষেত্রেও তৈরি হয়েছে নানান মত। এখানে আমার আলোচনার মূল বিষয় নারীবাদ আর পুরুষ বিদ্বেষ। নারীবাদের মূল উদ্দেশ্য এক তথা নারীমুক্তি হলেও এদের নীতি ও কার্যক্রমে ভিন্নতা রয়েছে। এই মতাদর্শগত পার্থক্য থেকে বিভিন্ন নারীবাদের উৎপত্তি হয়েছে।
কয়েকটি প্রভাবশালী ও আলোচিত নারীবাদ হল- উদারনৈতিক নারীবাদ, আমূল নারীবাদ, মার্ক্সীয় নারীবাদ, পরিবেশ নারীবাদ ইত্যাদি। কিন্তু যেই সমাজ এখনো উদারনৈতিক নারীবাদকেই মেনে নিতে পারছেনা সেখানে আমূল নারীবাদ কতোটা প্রাসঙ্গিক? অনলাইনে অনেককেই দেখা যায় তারা নিজেদেরকে আমূল নারীবাদী দাবী করে দুনিয়া থেকে পুরুষের বিলুপ্তি ঘোষণা করছে! অর্থাৎ আমূল নারীবাদীদের দাবী হচ্ছে এতকাল পুরুষ যেই চাবুক চালিয়েছে নারীর উপর সেই চাবুকটাই এবার তারা দাবী করছে পুরুষকে নির্যাতন করতে। এমন কিছু নারীবাদীদের পোস্ট দেখে আমরা যারা দুনিয়া থেকে সকল চাবুকের বিলুপ্তির দাবীতে আন্দোলন করছি তারা যারপর নাই বিস্মিত হই। আমূল নারীবাদ কি বলে? মিটেল ফায়ারস্টোন, কেট মিলেট, মারিয়েন ফ্রেঞ্চ আমূল নারীবাদের প্রবক্তা। অনেকেই তসলিমা নাসরিনকে এদেশীয় আমূল নারীবাদী আন্দোলনের অগ্রদ্রুত ভাবলেও এই বিষয়ে রয়েছে বিতর্ক। আমূল নারীবাদকে যদি সংজ্ঞায়িত করতে যাই তবে মোটা দাগে বলা যায়,
‘আমূল নারীবাদের মুলকথা হল পুরুষ নারীকে শোষন করে যৌন নিগ্রহের মাধ্যমে। এরা নারী-পুরুষের বিচ্ছেদে বিশ্বাসী। পিতৃতন্ত্রের বিলুপ্তি ও পুরুষের সঙ্গে নারীর যে কোন রকম সম্পর্ককে অস্বীকার করে নারীর একক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই নারীবাদীরা। আমূল নারীবাদীরা পুরুষকে প্রতিপক্ষরূপে চিহ্নিত করে প্রচলিত বিবাহ রীতিকে অস্বীকার করে। এরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাতৃগর্ভের বাইরে সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী যাতে রাষ্ট্র ও পুরুষদেরও মানব প্রজাতি টিকিয়ে রাখার দায় সমানভাবে বহন করতে হয়। এরা সমকামে বিশ্বাসী ও মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। নারী-পুরুষে সমতা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এরা মূলতঃ পুরুষতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে পুরুষতন্ত্রেরই উল্টোপিঠ নারীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় আর পুরুষকে অবদমিত করতে চায়’
এই যদি হয় আমূল নারীবাদ তবে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে এদেশে যারা নিজেকে আমূল নারীবাদী বলে গলা ফাটাচ্ছেন তারা কি নিজেদেরকে পুরুষ বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছেন? পারেন নি। তসলিমা নাসরিনকেও একাধিকবার বিয়ে প্রেম ও যৌন সম্পর্কে জড়াতে হয়েছে বিভিন্ন পুরুষের সাথে। এভাবে জড়িয়ে থেকে আমূল নারীবাদ চর্চা হয়না। বর্তমান প্রজন্মের দুই চারজন বিভ্রান্ত কিশোরীকেও দেখা যাচ্ছে অনলাইন পুরুষ বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। নারীবাদ নিয়ে আদৌ তাদের কোন ধারণা রয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু তাদের মূল লক্ষ্য বিতর্ক তৈরি করে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা। অবশ্য এতে আরেকটা লাভ হবার সম্ভাবনা থাকে সেটা হচ্ছে উন্নত দেশে নিজেকে নারীবাদী বা হিসেবে জাহির করে অ্যাসাইলাম পাবার চেষ্টা। যারাই অনলাইনে পুরুষ বিদ্বেষ ছড়িয়ে নিজেকে নারীবাদের দেব দেবী প্রমান করতে চাচ্ছেন তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে তাদের কাঙ্ক্ষিত অ্যাসাইলাম পেয়ে পগার পার। এখন তারা বিদেশে বসে গর্ভে সন্তান নিয়ে পুরুষের গলা জড়িয়ে শুয়ে শুয়ে ‘দুনিয়ার সব পুরুষ খারাপ’ বলে নাটক করলে সেটা হাস্যকর করে তোলে নারীবাদী ভাবনাকেই।
যেই পুরুষ আপনাকে সুখ দেবেন তিনিই একমাত্র আসল পুরুষ আর দুনিয়ার বাকি পুরুষ বদমাশ ধর্ষক এই ধরনের নোংরামি বন্ধ করুন। আগে বিছানায় আপনার পাশে পুরুষের জায়গায় আপনার মতো আরেকজন নারীকে নিয়ে আসুন তারপর আমূল নারীবাদী দাবী করুন নিজেকে। কারণ আমূল নারীবাদ এটাই বলে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের উগ্রতা এতোটাই হিংস্র যে প্রকৃত নারী অধিকারের আন্দোলন কর্মীরাও লজ্জায় পড়ে যায়। এরা ভিনদেশে নিরাপদে বসে ভার্চুয়াল বাতাসের মাধ্যমে এদেশে ছড়াচ্ছে ঘৃণার বিষ। আর সেই বিষে আক্রান্ত হচ্ছে এখানে রাজপথে আন্দোলনকারী নারীরা। আসলে এইসব পুরুষ বিদ্বেষীরা কাদেরকে লাভবান করছে? এরা লাভবান করছে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমটাকে কারণ যেখানে দাবী তোলা উচিত সমতা আর অধিকার রক্ষার সেখানে তাদের অযৌক্তিক অসভ্যতার কারনে নারীবাদ বিরোধী পুরুষ চক্র এদের কার্যকালাপের দিকে আঙ্গুল তুলে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ পাচ্ছে সত্যিকার নারীবাদী ধারাকে।
সম্প্রতি একজন নারী অধিকার কর্মী যিনি নিজেও একজন প্রতিবাদী নারী তাকেও পতিতা হিসেবে অনলাইনে প্রচার করেছে কিছু উগ্র বিভ্রান্ত আমূল নারীবাদী কারণ সেই উদারনৈতিক নারীবাদী বলেছিলো ‘পুরুষ বিদ্বেষ ছড়িয়ে নারী অধিকার আন্দোলন সফল করা যাবে না’। এই যদি হয় একজন নারীর প্রতি এদের আক্রমনের ধরণ বা ভাষার ব্যাবহার তবে সহজেই অনুমেয় যে তাদের কথা বা মতের সাথে না মিললে এরা কতোটা হিংস্র হয়ে ওঠে।
এদের পারিবারিক, সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত শিক্ষার ঘাটতি আছে বলেই মনে করি। কারণ যেই কিশোরীটি মাত্র ১৬/১৭ বছর বয়সেই কেবল ভাঙ্গার নেশায় আক্রান্ত হয়ে সবকিছু ভাঙ্গতে চেষ্টা করছে, সে অবশ্য অবশ্যই মানসিকভাবে অসুস্থ। কারণ সে জানেই না যে ভেঙে ফেলার পর সেই ভাঙা স্থানে সে নতুন কি স্থাপন করবে। কিন্তু এদের ধারণা সবকিছু ভেঙে ফেলার নাম আধুনিকতা, সবকিছু অস্বীকার করার নাম প্রগতিশীলতা। ইসলামী জঙ্গিদের মতোই এদেরকে মগজ ধোলাই করে মাথায় ভাঙার আফিম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু ভেঙে ফেলার নাম প্রগতিশীলতা নয়, বরং ভাঙার পড়ে নতুন উন্নত কিছু সৃষ্টি করার নাম প্রগতিশীলতা।
আসলে সবকিছুর আগে খুঁজে দেখা উচিত এদের বিদেশ গমন ও বিদেশে এদের অর্থের যোগান কারা দিচ্ছে। কারণ এমনও হতে পারে সর্ষের ভেতরেই ভূত! এদের আচরণ পর্যবেক্ষন করলে জোড়ালো ভাবেই সন্দেহ জাগে যে ‘এরা আসলে নারীবাদী আন্দোলনকেই বিতর্কিত করতে পুরুষতন্ত্রের গোপন চর হিসেবেই কাজ করছে কিনা?’’।
এইসব পুরুষ বিদ্বেষীরা সুস্থ হোক। মানবিক পৃথিবী নির্মাণের আন্দোলনে এরাও শরিক হোক। নারী অধিকার আন্দোলন সফল হোক। নারী অথবা পুরুষ নয়, পৃথিবীটা মানুষের হোক।
লেখক: পরিচালক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট