ধর্ষিতার নারী দিবস!

প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০১৯, ১৫:০৪

ফারজানা কাজী

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। যার আদি নাম আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস। সারা বিশ্বব্যাপী নারীরা একটি প্রধান উপলক্ষ হিসেবে এই দিবসটি উদযাপন করে থাকেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীদিবস উদযাপনের প্রধান লক্ষ্য এক এক প্রকার হয়। কোথাও নারীর প্রতি সাধারণ সম্মান ও শ্রদ্ধা উদযাপনের মুখ্য বিষয় হয়, আবার কোথাও মহিলাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা বেশি গুরুত্ব পায়।

এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ এবং কর্মক্ষেত্রে বৈরী পরিবেশের প্রতিবাদ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুতা কারখানার একদল শ্রমজীবী নারী। তাদের উপরে দমন-পীড়ন চালায় মালিকপক্ষ। নানা ঘটনার পরে ১৯০৮ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ও রাজনীতিবিদ ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম নারী সম্মেলন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি নারী দিবস হিসেবে পালন করছে। তখন থেকেই বিভিন্ন দেশে নারীর সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করে দিবসটি পালন শুরু হয়। 

প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিপাদ্য সামনে রেখে বিশ্বে নারী দিবস পালিত হয়। প্রতিপাদ্যগুলোর মূল কথা থাকে নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়ন দূর করা। সেই সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয় নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আর নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিতে। কিন্তু আজও আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। এখনো নারীর প্রতি বৈষম্য ও অন্যায়ের ভয়াবহ চিত্র নারীর অগ্রযাত্রাকে যেন মন্থর করে দিচ্ছে। আমাদের দেশে নারীর বিভিন্ন অর্জন একদিকে যেমন আমাদের আশাবাদী করছে, অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের নানা উদাহরণ এই অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে কিংবা করছে প্রশ্নবিদ্ধ।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৯ এর প্রতিপাদ্য বিষয়: 
"সবাই মিলে ভাবো, নতুন কিছু করো
নারী-পুরুষ সমতার, নতুন বিশ্ব গড়ো।"

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, রাজনীতি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে তার বিচরণ যেমন বিস্মিত করে সারা বিশ্বকে, তেমনি স্তম্ভিত হতে হয় এ দেশের নারী নির্যাতনের ব্যাপকতায়। প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশে নারীরা আসলে কতখানি অগ্রগতির আস্বাদ পেয়েছেন?

প্রাচীনকাল থেকেই নারীর ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন, ধর্ষণ একরকম অনিবার্য হিসেবেই চলে আসছে। বাংলাদেশে এখন নারী নির্যাতন প্রতিদিনকার ঘটনা। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে ধর্ষণ অন্যতম। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে ও পদে পদে নির্যাতিত হচ্ছেন নারী। বর্তমানে বাংলাদেশে নারী ও শিশুকন্যা নির্যাতনের ভয়াবহ দিকটি কতো প্রকট হয়ে উঠছে তা প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়।

প্রতিনিয়ত নারীরা ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন এমনকি হত্যার শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণের পাশাপাশি হত্যা ও আত্মহত্যার প্রবনতাও বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাপক মাত্রায় পারিবারিক নির্যাতন। ওর্য়াল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের এক রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রতি ঘন্টায় একজন করে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশের সংবিধানে সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে এবং দেশে বিদ্যমান আইন, নীতি ও কৌশলেও নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এদেশে মাত্র ৩৬ শতাংশ নারী কর্মশক্তিতে নিয়োজিত। এখনো ৭০ শতাংশের বেশি নারী বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন। সমাজে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, নারী নির্যাতন, ধর্ষণের মতো নৃশংস, ক্ষতিকর ও বৈষম্যমূলক আচরণ চলমান রয়েছে। প্রতিদিন ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পরে হত্যা করা হচ্ছে নারী ও শিশুকে। পাঁচ বছর থেকে পাঁচ মাসের শিশুও রেহাই পায় না পুরুষের লালসা থেকে। তবে এখানে হয় না কোনো বিচার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ বিবাহিত নারী তাদের জীবনে স্বামীর দ্বারা এক বা একাধিক ধরণের সহিংসতার শিকার হন। ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এই নারীদের মধ্যে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন। বাংলাদেশে স্বামীর নির্যাতনের কারণে ৭ দশমিক ১ শতাংশ নারী আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। বিষ্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায় আমাদের দেশের নারী নির্যাতনের ব্যাপকতা ও নৃশংসতায়।

ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, যৌন পীড়ন, আত্মহত্যায় প্ররোচনা-এসব অত্যন্ত গর্হিত, ভয়ানক অপরাধের জন্য যতটা মামলা হয়েছে, তার ৩ শতাংশেরও কম ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। ৫০ শতাংশের অধিক অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পেয়েছেন বলে তথ্য রয়েছে।

নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বা প্রথাগত ধর্মীয়-সামাজিক রীতি-নীতির কারণে অনেক সময় রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও কিছুটা প্রভাব ফেলে।

কখনো যৌন নির্যাতন, কখনো মেয়ে হিসেবে জন্মানোর জন্যে চূড়ান্ত নিপীড়ন, আবার কখনো ধর্ষণ। নারীরা ভালো নেই। বিশ্ব, সমাজ, যুগ যতো তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে, ততোই এগিয়ে চলার চেষ্টা চালাচ্ছেন মেয়েরা। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের স্বার্থ আর লালসা নারীদের পিছনে টেনে ধরে রেখেছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে এখনো বন্দী করে রাখতে চায় পুরুষতন্ত্র। এখনো নারীকে দেখা হয় শুধুই যৌনবস্তু হিসেবেই, মানুষ হিসেবে নয়। তবে ইতিহাসের পাতা কিন্তু বলে মেয়েরা পারবেন এই পুরুষতন্ত্রের শক্তিকে ভেঙে ফেলে অনেক অনেক দূর এগিয়ে যেতে। 

এখন কথা হচ্ছে, শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই যে দেশে ৫২টি ধর্ষণ, ২২টি গণধর্ষণ আর ধর্ষণশেষে ৫ জন খুন হয়, সে দেশে ধর্ষিতারা কি করে নারী দিবস পালন করবেন? এতোশত ধর্ষিতার দেশে নারী দিবস কেমন হাস্যকর, বেমানান লাগে না? তবে এদেশের বাঙালি ভণ্ড-ইতর পুরুষেরা (যারা ঘরে নির্যাতনকারী আর বাইরে মানবতাবাদী) ঠোঁট বাঁকিয়ে, মুখ ভেঙিয়ে Happy Womens' Day বলে Wish করবেন আর পুরুষের প্রিয় কিছু পরগাছা নারী শুভেচ্ছা বিনিময় করে ভাববেন আহা! 'বিরাট কিছু অর্জন করে ফেলেছি আমরা'। তারপর নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের জন্যে নারীকেই দায়ী করবেন।

একবার ভাবুন তো- যে নারী শৈশবে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যে নারী কৈশোরে ধর্ষিতা হয়েছেন, যে নারী দিনের পর দিন স্বামীর হাতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন সেই সকল নারীর কাছে ‘নারী দিবস’ এর কী অর্থ দাঁড়ায়? কিংবা যে দেশে প্রতিদিন ধর্ষিত হয় একাধিক নারী, সে দেশ কি করে, কাদের নিয়ে উদযাপন করে ‘নারী দিবস’? কেউ কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে অন্তত এই দিনটিতেও এদেশে কিংবা পৃথিবীর কোথাও, কোনো কোণেও একটি নারী বা শিশুকন্যা পুরুষের লালসার শিকার হবেন না?

৩৬৫ দিন সহিংসতার ভিতরে পার করে এই ধর্ষণের দেশে নারীর জন্য শুধু একটি দিন বা নারী দিবস পালন আদৌ জরুরি কিনা সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। বরং মেয়েরা বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যেয়ে বুঝিয়ে দিক তাদের ফেলে এগোনো যায় না। তাদের চুপ করিয়ে রাখা যায় না। তাদের ইচ্ছেকে আর মাটি চাপা দেওয়া সম্ভব নয়। যোগ্যতায়, মর্যাদায়, অর্জনে, উপার্জনে, সুখে, সম্পদে নারী হয়ে উঠুক অনন্যা, অপরাজিতা।

এই শতশত ধর্ষিতার দেশে, বিচারহীনতার দেশে, পুরুষ বান্ধব এই দেশে Happy Womens' Day বলাটা প্রচণ্ড কৌতুকময় এবং হাস্যকর। Womens' Day সেদিনই Happy হয়ে উঠবে, যেদিন পৃথিবীর কোথাও একটি নারীও আর নির্যাতিত হবেন না, অসম্মানিত হবেন না, নারী তার ন্যায্য অধিকার পেয়ে যাবেন এবং নারীর মৌলিক অধিকারের জন্য আর লড়াই করতে হবে না।

জাগরণীয়ার ইমেইল থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত