নারী হাতবদলের সামগ্রী মাত্র!
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০১৮, ২৩:৪৪
[এই ভিডিওর সাথে হয়ত এই লেখার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই, অথবা আছে। এই ভয়াবহ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের এইটুকুই মূল্য। পুরুষ তাকে বিয়ে দেয় কারণ তার ঘরে খাওয়ানোর জন্য একটি পেট কম হবে, পুরুষ তাকে ঘরে নিয়ে যায় কারণ আর চারটি পেট চালাতে তার এই নারীকে দরকার। ভারতীয় বিবাহে নারীর প্রয়োজন এইটুকুই। এর সাথে সম্পর্কিত নয় সরাসরি, তবু এমনিই মনে এল দুচারটি কথা। লিখে ফেলি।]
হিন্দু মহিলার মুসলিম স্বামী হিন্দু রীতিতে তার শেষকৃত্য করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন হিন্দু মন্দিরে। কিছুদিন আগে এক পারসি মহিলা, যিনি হিন্দু বিবাহ করেছেন, তাকে তার পিতার শেষকৃত্য করতে না দেওয়ায় তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন। আদালত পারসি সম্প্রদায়কে অবিলম্বে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে আদেশ দেয়। সম্প্রতি রাজস্থানে চার মেয়ে মিলে বাপের শেষকৃত্য করায় খাপ তাদের সমাজচ্যুত করে।
আমরা শহুরে এলিটরা অনেক রকম যুক্তি দিই। মেয়ে যখন ধর্মের নিয়ম ভেঙে বিয়ে করার সাহস করেছে, কেন পুরোটা করবে না? কেন তার ধর্মীয় শেষকৃত্য করা প্রয়োজন? সে যখন ধর্মীয় বিবাহবিধান মেনে গোত্রান্তরিত হতে রাজি হয়েছে, তখন তার বাবার শেষকৃত্য করার অধিকার থাকবে কেন? অর্থাৎ মানলে সবটা মানো, না হলে মোটেই মেনো না।
আমার নিজের মনে হয়, সম্পূর্ণ ধর্মহীন হওয়াটা একটা বড় প্রক্রিয়া। যে সমাজে, যে পরিবেশে, যে আবহে আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়, তাতে একদিনে একেবারে সম্পূর্ণ ধর্মত্যাগ করা তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবুও যখন তারা ভিন্নধর্মী বিয়ে করে, এবং ধর্ম না বদলেই, তখন তারা একটা চেইন ভাঙে। যে সমাজে মেয়ে দু'বালতি জল আনার জন্য হাতবদল হয়, সেখানে এই চেইন ভাঙাটাও আমার কাছে বড় পদক্ষেপ বলে মনে হয়। যে মুসলিম পুরুষ হিন্দু স্ত্রীর হিন্দুমতে শেষকৃত্য করতে রাজি হন নিজ ধর্মমত অনুযায়ী শিরক করে, বা যে মেয়ে হিন্দু জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেও পিতার শেষকৃত্য করতে চায় জরাথ্রুস্টিয়ান মতে, তারা প্রথম শিকলটা ভেঙেছে অলরেডি। তাদের জন্য টুপি খুলবো বৈকি।
আর একটা জরুরী কথা। এই যে পিতৃতন্ত্রের "নারী হাতবদলের সামগ্রী মাত্র" ধারণা, যা সব ধর্ম প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে এনডোর্স করে, এই ধারণা ভাঙার জন্যও অন্তত ধর্মের ওপর এইসব স্টিরিওটাইপ ভাঙা মানুষজনকে স্বীকার করার জন্য চাপ দেওয়া উচিত। হিন্দু মেয়ে মুসলিম বিয়ে করলে মুসলিম হয়ে যায় না, বা পারসি মেয়ে হিন্দু বিয়ে করলে হিন্দু, এটা সব ধর্মকে বোঝানো জরুরি। দরকার হলে আইনি পথে। আমি নিজে নাস্তিকতার পক্ষে, কিন্তু হতে হলে লোকজন কেন পুরো নাস্তিক হবে না, এই প্রশ্নের আড়ালে আমরা ধর্মকে সহনশীল হতে বাধা দিচ্ছি না তো? এই প্রশ্নের আড়ালে ধর্মের পুরুষতান্ত্রিক নখদাঁত "মেয়ে সম্পত্তিমাত্র, হাতবদলে তার পরিচয় বদল হয়"কে সমর্থন করে বসছি না তো?
নন-এলিটরা দু'বালতি জল আনার জন্য মেয়ে আনে কারণ তারা জানে মেয়ে সম্পত্তিবিশেষ, ক্রয়যোগ্য। আমরা এলিটরা যদি ভেবে বসি যেহেতু মেয়ে ঈশ্বরবিশ্বাসী, সুতরাং তার বিবাহ মানেই, এমনকি তা যদি বিশেষ বিবাহ আইনেও হয়, তা মেয়ের হাতবদল হওয়ার ছাড়পত্র, তাহলে তো খুবই সমস্যার কথা! মেয়ে প্রথম শিকলটা ছিঁড়তে চাইলে তাকে সাহায্য না করি, অন্তত তাকে আরো কষে বেঁধে না দিই যেন।
দেবশ্রী মিত্রের ফেসবুক থেকে