হার মানবো না

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০১৮, ১৪:৪০

নাঈমাহ তানজিম

শুরুটা ঠিক কীভাবে হয়েছিলো জানি না, কিন্তু ভিড়ের সুযোগে দলবেঁধে মেয়েদেরকে মোলেস্ট করা নতুন কিছু না। বাঁধন এর কথা মনে আছে? ১৯৯৯ সালে ৩১শে ডিসেম্বর সবাই যখন নতুন শতাব্দীকে বরণ করতে ব্যস্ত, বাঁধনকে প্রকাশ্যে মোলেস্ট করা হয়েছিলো। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই।

২০১১ সালে বাংলাদেশে হলো ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আর সবার কাছে খুব গর্বের হলেও, মিরপুরের মেয়েদের জন্য আতংকের। বিশেষ করে যদি বাংলাদেশ এর খেলা থাকে। একে তো রোকেয়া সরণী থেকে রাস্তাঘাট বন্ধ, এতটা রাস্তা হেঁটে যাওয়ার সময় উত্যক্ত হওয়া তো বোনাস। আর বাংলাদেশ জিতে গেলেই কিছু বখাটে নিজেদের ক্রিকেটপ্রেম এর দোহাই দিয়ে, ভিড়ের মধ্যে গায়ে ধাক্কা দিয়ে, বাজে কথা বলা আরম্ভ করেছিলো। সেবছরই আগারগাঁওতে একটা মেয়ে চরম অপমানিত হয়েছিলো। তার অপরাধ ছিলো সে, আয়ারল্যান্ড এর সাথে বাংলাদেশ জিতে যাওয়ার পর উদযাপন দেখতে বের হয়েছিলো বন্ধুদের সাথে। আমি এখন ক্রিকেট খেলা থাকলে বাসা থেকে বের হই না। ২০১৬ তে এই মার্চেই এশিয়া কাপ এর সময়, টিউশনি থেকে ফেরার পথে কয়েকটা ছেলে আমাকে সনি হল এর সামনে থেকে স্টেডিয়াম পর্যন্ত ফলো করেছিলো। শেষ পর্যন্ত একটা দোকানে ঢুকে বাসায় কল দিয়ে সেবার বিপদ কাটিয়েছি।

ঈদের শপিং এর সময় ভিড়ের মধ্যে গায়ে হাত দেওয়ার কথা আর নাইই বা বললাম। এই লোকগুলো রোজা থাকে কি না জানি না। ইচ্ছা করে মেয়েদের ভিড়ে ঢুকে ধাক্কাধাক্কি করা এদের আরেকটা পদ্ধতি। ২০১৪ এর পর আমি আর ঈদের শপিং এ যাই নি। কেনাকাটা কিছু করার থাকলে অনলাইনে, আর নাহয় ঈদের পর। এমনিতেও ঈদের জামার বিশেষ প্রয়োজন হয় না। কারণ ঈদের দিন বাইরে যাওয়া মানে আরেকদফা উত্যক্ত হওয়া। সেদিন এই মোলেস্টাররা খুব জোশে থাকে।

আরেকটা দিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। ২০১৫ এর পরে আর সেইদিনটাও নেই। যারা ভুলে গেছেন মনে করিয়ে দেই, ২০১৫ সালের ১৪ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দলবেঁধে কিছু লোক মেয়েদের শাড়ি টেনে টেনে খোলে। ১২ বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে সাথে স্বামী-সন্তান থাকা নারী, কেউ বাদ যায় নি। অতএব, ইংরেজির সাথে বাংলা বর্ষবরণও বাদ।

৭ মার্চ কোন সরকারি ছুটি ছিলো না। অফিস আদালত, স্কুলকলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সবই খোলা ছিলো। বাসায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা সম্ভব ছিলো না তাই ঢাকা শহরের মেয়েরা ভুল করে কাজে চলে গিয়েছিলো, কেউ গিয়েছিলো ডাক্তার দেখাতে, কেউ ইউনিফরম পরে ক্লাস করতে।

এখন এইটাও অপরাধ। দৈনন্দিন কাজ করার এই অপরাধে সেদিন অনেকে উত্যক্ত হয়েছে, কেউ গায়ে ধাক্কা খেয়েছে, কাউকে কয়েকজন মিলে অত্যাচার করেছে। এই মেয়েগুলোর মধ্যে সবার ফেসবুক নেই, থাকলেও সবাই নিজেদের জঘন্য অভিজ্ঞতার কথা লিখেনি, কয়েকজন লিখেও অনলাইন মোলেস্টারদের যন্ত্রণায় সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে, কাউকে প্রশ্ন করা হয়েছে বাইরে গিয়েছিলো কেন? কাউকে বলা হয়েছে বিখ্যাত হওয়ার জন্য বানোয়াট গল্প বলছে।

আমার নিজের সাথে এরকম একটা বাজে ঘটনা ঘটে গেছে কিছুদিন আগে। টিউশনিতে যাওয়ার সময় একলোক আমার গায়ে হাত দেওয়ার পর আমি চুপচাপ চলে না এসে পিছু পিছু ধাওয়া করি। তারপর সেই লোকের চোখে পিপার স্প্রে করি, এরপর আশেপাশের আরো কিছু লোক আমাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় মোলেস্ট করে। এরপর পুলিশ আসে, আমাকে লক আপে রাখে, আমার বাসায় খবর যায়, রাত ২টার সময় মায়ের হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ঢুকেছিলাম। পরদিন ঘটনাটা ফেসবুকে দেওয়ার পর আরেকদফা উত্যক্ত হওয়া, যেন পাবলিক মোলেস্টেশন এরই ভার্চুয়াল রূপ। ভিডিও দেখার পরেও অনেক ছাগল এসে বলেছিলো আমি মিথ্যা বলছি অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য। যারা এইকথা বলছে, সেইসব বুদ্ধিহীন এর অ্যাটেনশন দিয়ে যে কী করবো, সেটা আজ ৬ মাস পরেও বুঝে উঠতে পারি নি। তখন অনেকেই বলেছিলো পোস্ট রিমুভ করে সবকিছু ভুলে যেতে। যা হওয়ার হয়েছে, বাদ দাও।

কেন বাদ দিবো? আর কতকিছু একটা একটা করে বাদ দিতে থাকবে এই শহরের মেয়েরা? থার্টিফার্স্ট-বর্ষবরণ-ক্রিকেটপ্রেম সবই তো বাদ হয়ে গেছে, ঈদও বাদ। কর্মদিবসে অফিস, স্কুল, কলেজও বাদ? একদিনের বেতনও বাদ? একদিনের ক্লাস এবং ক্লাসের পড়াও বাদ? ফেসবুকে এইসব শেয়ার করাও বাদ? এরপর কী? এই নোংরা দেশে শ্বাস নেওয়াও বাদ?

দয়া করে ভণ্ডামি করবেন না। আপনার সুশীল চোখে আমার পোস্ট দেখতে খারাপ লাগলে সুইজারল্যান্ড চলে যান, গিয়ে বরফওয়ালা পাহাড় দেখতে দেখতে মেঘনাদবধকাব্য পড়েন। আমার সাথে, আমাদের সাথে যা হয়েছে বিশ্বাস না হলে বসে বসে কনজুরিং মুভি দেখেন, ওটা তো খুব বিশ্বাসযোগ্য। রাস্তায় একটা মেয়েকে হয়রানি হতে দেখলে, মেয়েটাকে সাহায্য করতে না পারেন, উলটা মেয়েটাকে 'আপা বাদ দেন' বলতে যাবেন না, আপনার বিচ্ছিরি নাকটা অন্য জায়গায় গলান। দিনশেষে আমাদের লড়াই আমাদেরই করতে হবে, তাই আমাদেরই বুঝতে দেন।

৮ মার্চ ছিল নারী দিবস। অনেক টাইপের শুভেচ্ছা জানানো হলো নারীদের। যদিও সেদিনও অন্যসব দিনের মতন বাসের মহিলা সিটে নির্লজ্জের মতন কিছু পুরুষ বসে ছিল, রিকশাচালক থেকে শুরু করে অফিসের বস, সবাই বুকের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, ফিল্টারড ইনবক্সে নোংরা মেসেজ আসছে যেগুলা না পড়েই ডিলিট করতে হয়েছে।

এবং আবার যদি কোনওভাবে যদি ভিড়ের মাঝে কেউ পড়ে যাই, তাহলে কয়েকশ হাত আসবে আমাকে ছিঁড়ে টুকরা করতে। কিন্তু হার মানবো না, মরে যাই, রেপড হই, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাই, জ্ঞান থাকার আগ পর্যন্ত হাত-পা ছুঁড়তে থাকবো, চিৎকার করতে থাকবো। কিছুতেই হার মানবো না, কিছুতেই না।

নাঈমাহ তানজিম এর ফেসবুক থেকে

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত