'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার' দেখে কেন কাঁদলাম?
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০১৮, ১৮:১০
'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার' দেখে কেন কাঁদলাম?
এইটা একটা বিগ কোশ্চেন হয়ে বৃহস্পতিবার থেকে ঝুলেই রইলো আমার সামনে।
সিনেমাটা রিলিজ হয় ২০০২ সালে। আমি সম্ভবত দুই হাজার তিন বা চারে দেখি প্রথম। সেইসময়ই হুমায়ুন আহমেদ এর চন্দ্রকথা বা এই টাইপের নামের একটা মুভি রিলিজ হয়। মনে আছে আমি আর আরিফ জেবতিক আলাপ করেছিলাম। আরিফ বলছিল, দ্যাখ কোলকাতায় একজন অপর্ণা সেন আছে কি দারুণ একটা মুভি বানাইছে আর আমাদের এইখানে কিসব বানায়, আধবুড়া জমিদার খাখা কইরা কাউয়া তাড়ায় কি করে না করে!
তো তখনও মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার দেখে আমি কাঁদছিলাম। তখন ক্যান কাঁদছিলাম? সম্ভবত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখে। তরুন বয়সে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বুকে দাগা দেবে এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গল্পটা কি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার? নাকি একটা সম্পর্কের? না কি আরও কোন গুঢ় ম্যাসেজ আছে? সেইসময় বুঝি নাই। তবে কাঁদছিলাম।
গল্পটাই অসাধারন। একটা বাস। তার কিছু যাত্রী। মিনাক্ষী- গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে, তামিল (কংকনা সেনশর্মা) ছোট বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর কাছে যাচ্ছে, রাজা চৌধুরী ওরফে জাহাঙ্গীর চৌধুরী (রাহুল বোস)- কোলকাতার মুসলিম তরুন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার, একজন মধ্যবিত্ত পুরুষ খিটখিটে বড়বোন আর স্ত্রীসহ, একদল ঝকঝকে তরুন-তরুনী, প্রতিবন্ধী ছেলেসহ এক মা, এক নবদম্পত্তি, মধ্য ত্রিশ বা তার কিছু বেশি বয়সের তিন বন্ধু (অঞ্জন দত্ত, রজতাভ দত্ত) এবং এক প্রাচীন দম্পত্তি। এছাড়াও আরও কয়েকজনকেও দেখা যায় ছোটছোট রোলে।
বাস গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই একটা পাহাড়ী গ্রামে এসে আটকে যায় ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা চলায়। কারণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। আগের দিন একজন হিন্দুকে মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউ খুন করেছে। প্রতিশোধ নিতে উদ্যত ধারালো অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর দর্শন হিন্দু কম্যুনিটি। এই কম্যুনাল দাঙ্গার গা ছমছমে আর ভীতিকর আবহে ছবিটা আগায়। বাসের ভেতর থেকে মুসলমান দম্পত্তিকে তুলে নিয়ে যায় দাঙ্গাবাজরা। মুসলমান রাজা চৌধুরীকে মুহুর্তের একটা আচরনে বাঁচায় মিসেস আয়ার মানে মিনাক্ষী। ক্রন্দনরত শিশুসন্তানকে ছুঁড়ে রাহুল বোসের কোলে দিয়ে সে দাঙ্গাকারীদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলে, "মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার"। তার কপালের দগদগে সিঁদুরের কারণে পাশে থাকা রাহুল বোসকে প্যান্ট খুলে আর নিজের ধর্ম পরীক্ষা দিতে হয় না। বেঁচে যায় সে। কিন্তু দাঙ্গা এই সিনেমার নায়ক বা নায়িকা বা প্রধান ক্যারেক্টার না। সম্ভবত দুজন অচেনা নরনারীর সম্পর্কই এই সিনেমার মূল চুম্বক।
কিন্তু আমি কেন কাঁদলাম?
গোঁড়া হিন্দু পরিবার থেকে আসা মিনাক্ষী আর রাজা চৌধুরী ঘটনাক্রমে যখন পৌঁছায় প্রায় পরিত্যাক্ত এক বন বাংলোয় তখনও মিনাক্ষী বিরক্ত আর নিজের উপর ক্ষুব্ধ। একটা মুসলমান ছেলের সাথে এক ঘরে থাকার আশংকায় সে মিসবিহেভও করে ফেলে রাজার সাথে।
কিন্তু সময় যাওয়ার সাথে সাথে রাজার কোঅপারেশন আর নির্মোহ ব্যবহারে মিনাক্ষী তার উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়। সে যখন ঘুমাচ্ছিল অপমানিত রাজা সেসময় তাকে আর বাচ্চাটিকে এই অচেনা বনবাংলোয় ফেলে চলে গেছে- ঘুম থেকে উঠে এই সংবাদ দারোয়ানের কাছে পেয়ে সে হতচকিত হয়ে যায়। এক ধরনের ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতায় বাথরুমে ঢুকে সে যখন কাঁদতে শুরু করে সেসময় বাথরুমের ভাঙা জানলা দিয়ে দেখতে পায় দূরে বনের ভেতর শুয়ে প্রকৃতির ছবি তুলছে রাজা। না রাজা তাকে এই বিপদের মুখে রেখে অপমান সত্ত্বেও ছেড়ে যায়নি। রাজা একজন দায়িত্ববান মানুষ। শিশু সম্তানকে কোলে নিয়ে কংকনার রাজার কাছে দৌড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি চোখে লেগে আছে। এক ধরনের স্বস্তি আর আনন্দ থাকে সেই ছুটে আসায়।
কিন্তু আমি কেন কাঁদলাম?
কারফিউ চলছে সেটা কখন উঠবে ঠিক নাই, পরের দিন গন্তব্যের ট্রেন ধরার কথা কংকনার- এইরকম অদ্ভুত ভীতিকর পরিবেশে কি প্রেমের অনুভূতি আসা সম্ভব? তাও প্রায় অচেনা একটা মানুষের প্রতি?
এইখানে নারীর মনোজগত দারুণ দেখিয়েছেন অপর্না সেন। ছোট বোন তুলি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা আপু কংকনা তো স্বামীকে নিয়ে সুখীই, তার শ্বশুড়বাড়ির সকলেও তাকে খুব ভালোবাসে, তো সে কেন আরেকজনকে ভালোবাসতে যাবে?
ওয়েল। আমি কফি খেতে খেতে তুলিকে একটা উত্তর দেই। সেই মুহূর্তে যা মনে হয়েছে তাই বলি।
অপর্না সেন এর অধিকাংশ মুভিতেই নারীর নিজেকে পুনঃআবিষ্কার করার একটা বিষয় থাকে। আর থাকে সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা।
কংকনা সেনশর্মা বিবাহিত নারী। তার স্বামীর সাথে কোন সমস্যা নেই, কেন তাহলে সে প্রায় অচেনা এক পুরুষের প্রেমে পড়বে?
রাজা চৌধুরী ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার। সম্ভবত পৃথিবীর বিভিন্ন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো এই পুরুষটি ধর্মীয় এবং নানান বিধিবিধানের ঘেরাটোপে আটকে থাকা মিনাক্ষীর জন্য একটা খোলা জানালা, একটা অন্যরকম মুক্ত পৃথিবীর ডাক নিয়ে আসে। এই মুক্ত পৃথিবীতে পাহাড় আছে, বন-জঙ্গল আছে, পাখি আছে, ট্রিহাউজ আছে অর্থাৎ কে যে আমায় ঘরের বাহির করে টাইপ একটা ব্যাপার আছে। মানুষ শেষবিচারে মুক্ত হতে চায়। চেনা পৃথিবী তখন অচেনা হতে থাকে আর অচেনা পৃথিবী ডাকে আয় আয়..
কিন্তু আমি কেন কাঁদলাম?
আর সেই অবিস্মরনীয় সংলাপ। দ্বিতীয়দিন সন্ধ্যা। বনবাংলোর অন্ধকার হয়ে আসা বারান্দায় বসে আছে দুজন। ফিজিক্সে পড়াশোনা করা মিনাক্ষী কেন কাস্টমে বিশ্বাস করে এই নিয়ে তর্কের শুরুতেই মিনাক্ষী থামিয়ে দেয় রাজাকে। ধর্মের খারাপ দিক নিয়েও কথা বলতে রাজি না সে। ধীরে ধীরে রাত নেমে আসছে। নেমে আসা রাতকে ইন্দ্রিয়ভরে পান করতে করতে হঠাৎই একটা ধীর শব্দ শুনতে পায় মিনাক্ষী।
অবাক হয়ে জানতে চায় এটা কিসের শব্দ?
রাজা উত্তর দেয়: ডিউ। ডিউ ড্রপিং ফ্রম দ্যা লিফস। দ্যা মোস্ট স্যুদিং সাউন্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড!
তো তুলি তুমি আমারে বলো তো, পৃথিবীর কোন স্বামীটা বা কয়টা প্রেমিক শিশিরের শব্দ চেনে? বোঝে?
কিন্তু আমি কেন কাঁদলাম?
সম্ভবত লুকিয়ে রাখা প্রেমের শুরু এখানেই। সিনেমার ক্লাইমেক্স অনুযায়ী এরপর আবারও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখানো হয়। খুব কাছ থেকে মানুষ খুন করতে দেখে ধর্ম বিশ্বাসী মিনাক্ষীও ধর্মের অসাড়তা বোঝে। সারাটা রাত কাটে মুসলমান রাজাকে একরকম জড়িয়ে ধরে থেকে।
খুব একটা সংলাপ আর এরপরে নেই। ট্রেনের ভেতর গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে শুধু সুখের সংসারের নিগড়ে বাঁধা মিনাক্ষী জানতে চায় এরপর রাজা কোন বনে যাচ্ছে ছবি তুলতে? একাই যাচ্ছে কি? রাজাও কি কিছু বলতে চায়? উত্তর দেয়, একাই। যদি না তুমি আমার সাথে আসো!
না মিনাক্ষীরা যেতে পারে না। জীবন একটা বাস্তব ব্যাপার। জীবন শিশিরের শব্দের মতো মসৃণ কোন ব্যাপার নয়। তাই চুপ হয়ে যাওয়া মিনাক্ষী আর জীবনতৃষ্ণা বাড়িয়ে দেওয়া রাজা দুজনেই মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে লুকিয়ে ফেলে প্রেম। ট্রেনের কামরায় লুকাতে না পারা কান্না আর অসমাপ্ত একটা চুম্বনেই গল্প শেষ।
গন্তব্যে পৌঁছে প্রতীক্ষারত স্বামীর কাছে ফিরেও মিনাক্ষী তাই চুপ করেই থাকে। বিদায়বেলায় শুধু বলে, "গুড বাই মিস্টার আয়ার"।
কিন্তু সিনেমা দেখে আমি কেন কাঁদলাম। পুরো সিনেমার রিভিউ লিখে ফেললাম, অথচ এখনও প্রশ্নটা ঝুলেই রইল। আমি কেন কাঁদলাম!
ইশরাত জাহান ঊর্মির ফেসবুক থেকে