নারী আন্দোলন: এক ও অনন্য নাঙ্গেলি
প্রকাশ : ০৭ জুন ২০১৬, ১৪:১২
১৬৪৭ সালে নারী অধিকার নিয়ে সর্বপ্রথম কথা বলা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীরা জেগে উঠেন। নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হন। তেমনই একজন ছিলেন ফ্রান্সের নাট্যকার ও বিপ্লবী নারী ওলিম্পে দ্যা গগ্স। তিনি নারী অধিকার নিয়ে সক্রিয় ছিলেন। নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলন করায় ১৭৯৩ সালে এই নারী নেত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে ফ্রান্সের সরকার।
ফ্রান্সের নাট্যকার ও বিপ্লবী নারী ওলিম্পে দ্যা গগ্স’র হত্যার মধ্য দিয়েও নারী অধিকার সেভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে না পারলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নারীরা কিন্তু তাদের অধিকার নিয়ে যথেষ্ট রকম সচেতন হয়ে উঠে। এরফলে নারীরা সংগঠিত অথবা স্ব স্ব অবস্থান থেকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যান। অন্ধত্ব, দাসত্ব, পুরুষতান্ত্রিক, ধর্মীয় প্রথা ভেঙে যে সমস্ত নারী আন্দোলন সংগ্রাম করে গেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মার্গারেট ব্রেন্ট, মার্গারেট লুকাস, ওলিম্পে দ্যা গগ্স, মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট ছিলেন অগ্রজ।
এরপর ১৮৪০ সালে নারী আন্দোলন নিয়ে দারুণভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেন এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন, লুক্রেশিয়া মটো, সুশান বি অ্যান্টনি, লুসি স্টোন, অ্যাঞ্জেলিনা এম গ্রিম, সারা এম গ্রিম। তবে আলোচিত এই নারী বিপ্লবীদের সক্রিয় হয়ে উঠার ৩৭ বছর পূর্বেও ভারতের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী জেগে উঠেছিল নিজ অধিকার নিয়ে। এই বিপ্লবী নারীর নাম হচ্ছে নাঙ্গেলি (Nangeli)। এই নারী নিজের জীবনের বিনিময়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘স্তন আমার অনাবৃত রাখব নাকি আবৃত? সে নিয়ম করার তুমি কে’?
১৮০৩ সালে একটি কুস্কার প্রথা চালু ছিল ভারতের কেরল অঙ্গরাজ্যে। ত্রিবাঙ্কুর রাজা এ রাজ্যের নিচু হিন্দু জাতের মধ্যে একপ্রকার শুল্ক বা করারোপ করেছিল। এ করটির নাম ‘স্তনশুল্ক’ (Breast Tax), স্থানীয় ভাষায় নাম ‘মুলাক্করম’ (Mulakkaram)।
সে সময় ওই রাজ্যে নিয়ম ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য কোনো হিন্দু নারী তাদের স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করে রাখতে পারবে না। এখানে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ শ্রেণির হিন্দু নারীরাই তাদের স্তনকে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারত। এছাড়া বাকি হিন্দু শ্রেণির নারীদের প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখার আইন প্রচলন ছিল ত্রিবাঙ্কুর রাজার এই রাজ্যে। তবে যদি কোনো নারী যদি তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইত, তাহলে তাকে স্তনের মাপের উপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স বা কর দিতে হত।
‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’র বড় অংশই যেত ত্রিবাঙ্কুরের রাজাদের কুলদেবতা পদ্মনাভ মন্দিরে। দলিতদের আজীবন ঋণের নিগড়ে বেঁধে রাখার এই ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আলাপুঝার এঝাওয়া সম্প্রদায়ের নারী নাঙ্গেলি (Nangeli)। ১৮০৩ সালে এই সাহসিনী নারী রাজার ওই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার স্তনকে আবৃত করে রাখে।
নাঙ্গেলি তার স্তন আবৃত করে রাখায় গ্রামের শুল্ক সংগ্রাহক তার কাছ থেকে ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’ দাবি করেন। কিন্তু নাঙ্গেলি ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তবে ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’র প্রতিবাদে নাঙ্গেলি ক্ষুব্ধ হয়ে নিজের দুটি স্তন ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে কলাপাতায় মুড়ে ওই শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে তুলে দেন। কাটা স্তন দেখে শুল্ক সংগ্রাহক হতবাক হয়ে যায়।
স্তন কেটে ফেলার কিছুক্ষণ পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় নাঙ্গেলির। শেষকৃত্যের সময় নাঙ্গেলির স্বামী নিজেও ঝাঁপিয়ে পড়েন জ্বলন্ত চিতায়। এই ঘটনার পর থেকেই ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’ রোহিত হয়। তবে ‘মুলাক্করম’ বা ‘স্তনশুল্ক’ রোহিত হলেও দক্ষিণ ভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি এ নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছে।
উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে এসে কিছু হিন্দু নারী তাদের শরীরের উপরের স্তন আবৃত করার অধিকার দাবি করেন, তখন হিন্দু পুরোহিতরা স্পষ্ট করে বলে দেন, নিচু বর্ণের নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করা ধর্মবিরোধী। এ বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছিল। এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা। ভারতে এই দাঙ্গা ‘কাপড়ের দাঙ্গা’ হিসাবেও পরিচিত।
এ দিকে নারীর অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ করতে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছরই পালিত হয় নারী দিবস। ভারতের কেরালা রাজ্যে প্রতি বছর নারী দিবসে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয় নাঙ্গেলিকে। নিম্নবর্ণের নারীর আত্মমর্যাদা আদায়ের সংগ্রামে আজও নাঙ্গেলি সে রাজ্যে এক এবং অনন্য সৈনিক। নিজের জীবন দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিম্নবর্ণের নারীর সম্মান।