নারীমুক্তির জন্য লড়াকু ব্যক্তিত্ব ফজিলতুন্নেসা

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:১১

জাগরণীয়া ডেস্ক

ফজিলতুন্নেসা বা ফজিলতুন্নেসা জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ও ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন (১৯৪৮-৫৭)। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে যান। ফজিলতুন্নেসা সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায় কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে-

‘ফজিলতুন্নেসা অসামান্য সুন্দরীও ছিলেন না অথবা বীনানিন্দিত মঞ্জুভাষিণীও ছিলেন না। ছিলেন অঙ্কের এম এ এবং একজন উচুঁদরের বাক্‌পটু মেয়ে’।

জন্ম
ফজিলতুন্নেসার জন্ম ১৮৯৯ সালে টাঙ্গাইল জেলার টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে। পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, মাতা হালিমা খাতুন।। ওয়াজেদ আলী খাঁ মাইনর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।

শিক্ষা
মাত্র ৬ বছর বয়সে ওয়াজেদ আলী খাঁ ফজিলতুন্নেসাকে করটিয়ার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। তিনি ১৯২১ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক ও ১৯২৩ সালে প্রথম বিভাগে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। ফজিলাতুন্নেছা ১৯২৫ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে গণিত শাস্ত্রে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি ১৯২৮ সালে বিলেতে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য গমন করেন। নিখিল বঙ্গে তিনিই প্রথম মুসলিম নারী গ্র্যাজুয়েট। উপমহাদেশে মুসলিম নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম বিলাত থেকে ডিগ্রি এনেছিলেন। তাঁর পড়াশোনার ব্যাপারে করটিয়ার জমিদার মরহুম ওয়াজেদ আলী খান পন্নী (চাঁদ মিয়া) বিশেষ উৎসাহ ও অর্থ সাহায্য করেন। বিলেতে তাঁর অবস্থান কালীন সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে প্রথম ডিপিআই (ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন)।

পরিবার
বিদেশে পড়ার সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে খুলনা নিবাসী আহসান উল্ল্যাহর পুত্র জোহা সাহেবের সাথে ফজিলাতুন্নেছার পরিচয় হয়। পরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

কর্মজিবনে তাঁর অসামান্য অবদান
লন্ডন থেকে ফিরে ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান করেন। ১৯৩০ সালের আগস্টে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইল ফলক হয়ে আছে। এই অধিবেশনে তিনি বলেন ‘নারী-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন ও বলেন। নারী সমাজের অর্ধাঙ্গ, সমাজের পূর্ণতালাভ কোনোদিনই নারীকে বাদ দিয়ে সম্ভব হতে পারে না। সেই জন্যেই আজ এ সমাজ এতোটা পঙ্গু হয়ে পড়েছে। তিনি আরো বলেন,

The highest form of society is one in which every man and woman is free to develop his or her individuality and to enrich the society what is more characteristic of himself or herself.

কাজেই এ সমাজের অবনতির প্রধান কারণ নারীকে ঘরে বন্দি করে রেখে তার Individuality বিকাশের পথ রুদ্ধ করে রাখা। নারী-শিক্ষা সম্বন্ধে এতোটা কথা আজ বলছি তার কারণ সমাজের গোড়ায় যে-গলদ রয়েছে সেটাকে দূরীভূত করতে না-পারলে সমাজকে কখনই সুন্দর করে গড়ে তুলতে পারা যাবে না।’ তিনি ১৯৩৫ সালে বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। বেথুন কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় দেশবিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে এসে ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন ১৯৪৮ সালে। বেগম ফজিলাতুন্নেছা ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিল বের করার প্রস্তুতি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করার এক পর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজে এসে তার বিনানুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য দারোগাকে ভৎসনা করে হোস্টেল থেকে বের করে দেন নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে। নারীশিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়।

প্রকাশিত লেখা
মুসলিম নারীর মুক্তির জন্য যে লেখা ‘সওগাত’ ও ‘শিখা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন তা-

মুসলিম নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
নারী জীবনে আধুনিক শিক্ষার আস্বাদ
মুসলিম নারীর মুক্তি ইত্যাদি প্রবন্ধ

নজরুল ও ফজিলতুনন্নেসা
১৯২৮ সালে কাজী নজরুল ইসলাম নজরুলের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে। ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন এবং ফজিলতুন্নেসারও তার হাত নজরুলকে দেখাবার ইচ্ছা হয়। এভাবে ফজিলতুন্নেসা ও তার বোন সফীকুননেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে ফজিলতুন্নেসার বাসায়। কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায়, সেই দিন রাতেই নজরুল ফজিলতুন্নেসার ঘরে যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে “বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)। কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, “ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়”।

মৃত্যু
এই বিদুষী নারী ১৯৭৭ সালে ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। এই মহীয়সী নারীর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ সালে ফজিলাতুন্নেছার নামে হল নির্মাণ করা হয়।

সূত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি বছরের ইতিহাস; রফিকুল ইসলাম; পৃষ্ঠা: ৭২-৭৩
সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৪৩৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
স্মৃতিপটে নজরুল-স্মৃতিকথা; কাজী মোতাহার হোসেন; পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯
আমার বন্ধু নজরুল: তার গান-স্মৃতিকথা; কাজী মোতাহার হোসেন

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত