সালমা সোবহান: বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার

প্রকাশ : ১১ আগস্ট ২০১৮, ১২:১৭

আবদুল্লাহ আল মোহন

১.
সালমা সোবহান, মানুষ হিসেবে যিনি কর্মক্ষেত্রে এবং পরিচিতজনের কাছে ছিলেন অসামান্য, মানবিক, দয়ালু, প্রেমময়ী এবং স্বদেশপ্রেমিক। তাঁর ক্ষেত্রে এরকম আরো অনেক বিশেষণ ব্যবহার করা হলে সেসব যথার্থই হয় বলে তাঁকে, চেনা-জানা সুধীজনেরা অস্বীকার করেন না। সেই আলোকিত, অসাম্প্রদায়িক এবং অনুসরণযোগ্য মহিয়সী নারী সালমা সোবহান ১৯৩৭ সালের ১১ আগস্ট লন্ডনের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এই মহৎপ্রাণের জন্মদিনে তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। অনেক গুণের অধিকারিণী ছিলেন সালমা সোবহান। তিনি ছিলেন একজন গবেষক, একজন শিক্ষক, বাংলাদেশের প্রথম নারী ব্যারিস্টার, সমাজসেবী, জনদরদি অথচ ছিলেন ভীষণভাবে একজন নিভৃতচারী মানুষ। কোনো কাজ করে তার প্রচার একদম পছন্দ করতেন না। 

২.
মানবহিতৈষী সালমা সোবহান (জন্ম: আগস্ট ১১, ১৯৩৭ - মৃত্যু: ডিসেম্বর ৩০, ২০০৩) ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ব্যারিস্টার, মানবাধিকার কর্মী, নারী সমাধিকার আন্দোলনের সংগঠক। তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জেন্ডার এবং সামাজিক ন্যায়বিচার মূল্যবোধের স্বপক্ষে বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রদূত ব্যারিস্টার সালমা সোবহানের জীবন এক কথায় ছিল বর্ণাঢ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে দীর্ঘ ১৯ বছর শিক্ষকতা এবং মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সালমা সোবহান এদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন কাজ করে গেছেন, তেমনি মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনেও রেখে গেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ১৯৮৬ সালে আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিনা পারিশ্রমিকে তিনি পালন করে যান নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব। 

৩.
সালমা সোবহান স্মারক বক্তৃতা দিতে ঢাকা এসেছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন। বক্তৃতায় তিনি যথার্থই বলছেন, ‘Salma was born into the top layer of Pakistani aristocracy and political elite. Liberal and broad-minded as her own family was, she still had to take a huge leap when she chose to identify with the cause of the freedom of Bangladesh. Reasoning and reflected choice were central to her life, not passive acceptance of societal "unfreedoms" that the politics of confusion imposes on less courageous and less clear-headed human beings. Also, as someone who was a devout Muslim (when she was staying with my mother for a few days in our home, Pratichi, in Santiniketan, my mother wrote to me in England to say how admirable and inspiring she found Salma's gentle religiosity), Salma also showed with great clarity that religious identity -- important as it can be on its own -- does not obliterate every other affiliation and attachment that we have, related to class, gender, culture, citizenship, political commitment, or personal friendship, nor eclipse our ability to be guided by reason, if we so choose.’

৪.
সালমা সোবহান, পুরো নাম সালমা রাশেদা আক্তার বানু। তাঁর পিতা মোহাম্মদ ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। তাঁর মাতা বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় পরিষদের সদস্য। চিন্তা-চেতনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক এবং অনুসরণযোগ্য একজন মানুষ। তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে তাৎপর্যময় দিকটি ছিল তৎকালীন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও এমন একটি অনাড়ম্বর জীবন তিনি যাপন করতেন, যেখানে অহঙ্কার তাকে স্পর্শ করার সুযোগ পায়নি। অত্যন্ত রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে বড় হয়েও সালমা সোবহান ছিলেন একজন প্রগতিশীল ও আধুনিকমনস্ক মানুষ। কোনো রকম সংস্কার তাঁর মধ্যে ছিল না। সালমা সোবহান ছিলেন একাধারে একজন কৃতি সংগঠক এবং উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। কর্মী সালমা সোবহান এবং মানুষ সালমা সোবহান উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন অনন্য অনুসরণীয় এবং অনুকরণীয়।

৫.
উপমহাদেশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৩৭ সালের ১১ আগস্ট সালমা সোবহান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁরা ছিলেন তিন বোন এবং এক ভাই। তাঁর বাবা মো. ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন। মা শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম মহিলা সংসদ সদস্যদের অন্যতম। এছাড়া শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ মরোক্কোয় পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ মা-বাবা দু'জনই রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয়, সালমা সোবহানের শ্বশুরও পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরকম নজির ইতিহাসে বিরল। সালমা সোবহানের স্বামী বাংলাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান। সালমা সোবহানের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল অতুলনীয়। উপমহাদেশের অবিসংবাদিত নেতা ও তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর মামা। চাচা বিচারপতি হেদায়েত উল্লাহ ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি। সালমা সোবহানের পূর্ব পুরুষরা প্রথমে ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং পরে মধ্য প্রদেশের অধিবাসী ছিলেন। 

৬.
সালমা সোবহানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ইংল্যান্ডের ওয়েস্টনবার্ট স্কুলে। পরবর্তীকালে ১৯৫৮ সালে কেমব্রিজের গির্টন কলেজ থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে লিংকন'স ইন থেকে বার এট' ল সনদপ্রাপ্ত হন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬২ সালে। ১৯৫৮ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ব্যারিস্টার ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি করাচিতে ফিরে এসে হাইকোর্টে আইন ব্যবসায়ে নিয়োজিত হন। রেহমান সোবহানের সাথে বিয়ের পর ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষকতা পেশা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং পুনরায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালে দুইবার বাধাগ্রস্ত হয়। এ সময়ে তিনি এবং তাঁর পরিবার অক্সফোর্ডে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ল’ অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে রিসার্চ ফেলো নিযুক্ত হন। রিসার্চ ফেলো হিসেবে তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল সুপ্রিম কোর্ট ল’ রিপোর্ট সম্পাদনা করা। 

৭.
১৯৬২ সালে তিনি প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সাথে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর বড় ছেলে তৈমুর সোবহান ১৯৮১ সালে আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। মেজো ছেলে বাবর সোবহান অর্থনীতিবিদ। কনিষ্ঠ ছেলে জাফর সোবহান সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় দায়িত্বরত আছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠরা জানান, সালমা সোবহান মূলত চেয়েছিলেন স্বামী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটি সুখের নীড় গড়ে তুলবেন। তিনি রেহমান সোবহান এবং ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল, একটি সুন্দর সংসার গড়ে তোলা এবং লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করা। কারণ তিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন, কিছু অমর উপন্যাস রচনা করা ছিল তাঁর জীবনের লক্ষ্য৷ সালমা সোবহান স্মারক বক্তৃতায় ঘনিষ্ঠ স্বজন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যেমনটি বলছেন, ‘Salma's determination to lead an "examined life" (that great Socratic virtue), based on reflected choices, constituted an emphatic assertion of the power of humanity and reasoned action, rather than blind -- or imposed -- passivity. We have to follow Salma's lead in refusing to be drawn into the destructive fury of assigned -- and unreasoned -- identities in which "confused armies," to use Matthew Arnold's graphic phrase, "clash by night."

৮.
সালমা সোবহান ব্রাকের গ্রামীণ মহিলা সদস্যদের মধ্যে অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি এবং বিরোধ নিষ্পত্তির কাজে আধা-আইনজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি আইনি সাক্ষরতা কর্মসূচির পরিকল্পনা করেন। তিনি ও তাঁর আটজন সহকর্মী মিলে ১৯৮৬ সালে গঠন করেন মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। দীর্ঘ পনের বছর (১৯৮৬-২০০১) তিনি এই সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে এই সংস্থা একটি নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থায় পরিণত হয়। শুরুতে আসক ঢাকা শহরের সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র নারী, কর্মজীবী শিশু এবং শ্রমিকদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান করে। এরপর বিগত বছরগুলোতে প্রতিষ্ঠানটি মানবাধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নে অনেক কর্মকৌশল রচনা করে। এই কর্মকৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি, সালিশ ও মামলার মাধ্যমে আইনি সহায়তা প্রদান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মানবাধিকার গবেষণা, জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলার সাহায্যে আইন ও নীতি সংস্কারের প্রয়াস এবং গণমাধ্যম ও নিজস্ব প্রকাশনার মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য প্রদান। বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার, বিচারের অপেক্ষায় কারাবাস, রাষ্ট্রীয় হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা, বস্তি উচ্ছেদ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, পুলিশী নির্যাতন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ও রাষ্ট্রের উপর চাপ সৃষ্টি করা আসক-এর কাজ। এছাড়া আসক মানবাধিকার লঙ্ঘন-এর শিকার ব্যক্তিদের সহায়তা প্রদান করে থাকে। সমানাধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার এবং লিঙ্গভিত্তিক সমতার ভিত্তিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই আসক-এর লক্ষ্য। আসক-এর কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই এবং আসক সবসময় দলনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখে। আসক জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা এবং প্রচারাভিযানের মাধ্যমে জাতীয়ভাবে গুরুত্ব অর্জন করেছে।

৯.
সমাজ সেবার জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। নারী অধিকার রক্ষায় তাঁর অবদানের জন্য তিনি ২০০০ সালে ঢাকা ‘অনন্যা’ ম্যাগাজিন পুরস্কার এবং ২০০১ সালে নিউইয়র্কে ‘ল’ইয়ার্স কমিটি ফর হিউম্যান রাইট্স পুরস্কার লাভ করেন। সালমা সোবহান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড, ব্রাক, নিজেরা করি প্রভৃতি সংস্থার পরিচালনা বোর্ডের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। তিনি ২০০১ সালে ইউএন ইন্সটিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (ইউএনআরআইডি)-এর বোর্ড সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দ্য এশিয়া প্যাসিফিক উইমেন ল’ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, উইমেন লিভিং আন্ডার দ্য মুসলিম ওয়ার্ল্ড এবং ম্যাচ্ কানাডা এই তিনটি আন্তর্জাতিক নারী সংস্থার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। 

১০.
নারীদের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর নামে 'সালমা সোবহান সাংবাদিকতা ফেলোশিপ' প্রদান করা হয়।সালমা সোবহান রচিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Legal Status of Women in Bangladesh (১৯৭৫), Peasants’ Perception of Law (১৯৮১), No Better Options? Women Industrial Workers (সহ লেখক, ১৯৮৮)। 
এছাড়াও তিনি একটি উপন্যাস এবং তিনটি ছোট গল্প রচনা করেছিলেন।

১১.
সালমা সোবহান ২০০৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে (৩০ ডিসেম্বর) ৬৬ বছর বয়সে তাঁর গুলশানের বাসভবনে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর এই মৃত্যুতে বাংলাদেশের যে ক্ষতি হলো তা এক কথায় অপূরণীয়। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তাঁর আলোকিত কর্মের মধ্য দিয়ে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নারীমুক্তি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয় তাঁর অবদানকে। মাত্র ৬৬ বছর আয়ুষ্কাল; মৃত্যুর জন্য এমন কোন উপযুক্ত বয়স না, সমাজকে আরও বহু কিছু দেয়ার ছিল তাঁর। তাঁর মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এ দেশ জাতি তথা গোটা বিশ্বেরই। কারণ এদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন সালমা সোবহান। তিনি শুধু একজন সমাজকর্মীই ছিলেন না, তিনি সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছেন। সব ধরনের সামপ্রদায়িকতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে, একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে, ফতোয়ার বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই সোচ্চার ছিলেন। দেশের নারী অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান মানবাধিকার সংগঠনগুলো তথা সচেতন নাগরিক সমাজ স্মরণ করে যাবে যুগের পর যুগ ধরে।
 
১২.
সালমা সোবহান ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী এবং অন্যের কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি নিজের অবদানকে কখনো বড় করে দেখতেন না বরং অন্যকে সকল কাজের স্বীকৃতি দিয়ে দিতেন। সম্মিলিতবোধ ছিল তাঁর স্বভাবজাত। তিনি দলীয় কাজে সকলকে উত্সাহিত করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং বলতেন, ' আমরা একসঙ্গে কাজ করছি। একা কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। আমরা যদি হাতে হাত ধরে একসঙ্গে কাজ করি, তবেই একটি ভালো কাজ করা সম্ভব।' কোনো কাজের কৃতিত্ব তিনি নিজে নিতেন না। তিনি সবসময় বলতেন, 'এটাতো আমার একার কাজ না, এটা আমরা সবাই করেছি।' তিনি নিউইয়র্কের Lawyers for Human Rights এর দেওয়া পুরস্কার নিতে গিয়ে বলেছেন, 'এটি কিন্তু আমার অবদান না, আমরা যারা আইন ও সালিশে আছি, এতে সবারই অবদান রয়েছে। শুধু আইন সালিশের কর্মীই নয়, যারা মানবাধিকারকর্মী সবারই এতে অবদান আছে। আমি সবার পক্ষে এই পুরস্কারটা নিচ্ছি। নিজের পক্ষে আমি নিচ্ছি না।' সালমা সোবহান স্মারক বক্তৃতায় ঘনিষ্ঠজন নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেন, ‘Her life had a message also for the confused cultural theorists who try to confine us into little closed boxes of extraordinarily gross identities of civilizational categories, and also for anthropological reductionists who insist that we are the creatures of singular identities that are not subject to reasoning and choice but which we "discover" -- that magic word of identity politics and of rigidly communitarian philosophy.’

১৩.
সালমা সোবহান সকল পর্যায়ে মানবাধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর বহুমাত্রিক কর্মজীবনের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। তিনি বলতেন, 'অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের ধারণ করতে হবে ক্রোধ- সেই ক্রোধই আমাদের চালিত করবে মানবাধিকার রক্ষার নিরলস অভিযাত্রায়। মানবাধিকারের কাজ শুধুমাত্র নয়টা-পাঁচটায় শেষ হয় না, একাজ চালাতে হয় প্রতিনিয়ত, প্রতিটি মহূর্তে, ঘরে-বাইরে, অন্তরে-বাহিরে।' তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে একবার প্রশ্ন করেছিলেন, 'আপা, আমরাতো তথ্যানুসন্ধান করি, মানবাধিকার বিষয়ে কাজ করি। ধরুন, ক্রুদ্ধ জনতা একটি মানুষকে ধাওয়া করেছে, লোকটি আমার ঘরে ঢুকে পড়লো। জনতা এসে বললো, লোকটি ডাকাত। ওকে আমাদের হাতে তুলে দাও। তখন আমার করণীয় কী? তিনি বললেন, 'ওই মুহূর্তে কাজ হচ্ছে, তাকে রক্ষা করে বিচারের ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ লোকটির জীবন রক্ষা করা এবং বিচারের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া।'

১৪.
মানবাধিকার ও বঞ্চিত নারীদের আইনি সহায়তা কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনের বিস্তার লাভে তিনি মানবাধিকারকর্মীদের জন্য রেখে গিয়েছেন উজ্জ্বল পথ নির্দেশনা। তাঁর কর্মময় জীবনে বিভিন্ন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ নানা সময় তিনি দেশে-বিদেশের বিভিন্ন সম্মাননা ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু তিনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজের ভূমিকার প্রতি আলোকপাত করার চেয়ে সবার সমন্বিত প্রচেষ্টাকেই সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি সব সময় বলতেন, 'এটা তো আমার একার না। এটা আমরা সবাই করছি।' আইনি শিক্ষা প্রসারে সালমা সোবহানের অবদান ছিল অসাধারণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের বঞ্চিত নারীদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে সালমা সোবহান ছিলেন পথিকৃত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইন শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে সালমা সোবহান ব্র্যাকের হয়ে একটি প্যারালিগ্যাল প্রকল্প প্রণয়ন করেন এবং এর বাস্তবায়ন সরাসরি তদারক করেন। সমাজের বিভিন্ন স্তর এবং বিভিন্ন মতাদর্শ ও চিন্তাধারার মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে পারার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিনি সবার কথা শুনে সবার সঙ্গে মিলে কাজ করতেন। তিনি তাঁর কর্মময় জীবনে দেখিয়েছেন আইন কীভাবে ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হয়। সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি কাজ করতেন। গ্রাম-গঞ্জে পায়ে হেঁটে তিনি নারীদের কাছে গিয়ে বসতেন বা আইন সম্পর্কে ধারণা দিতেন; কেউ বুঝতেই পারতো না, সকলের পরিচিত, সহজ ও সাদাসিধে মানুষ এই সালমা আপা একজন ব্যারিস্টার। 

১৫.
সালমা সোবহানের স্মৃতিচারণ করে আসক-এর নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ‘সালমা আপার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসম্মানবোধ ছিল, যিনি দাতার কাছে সমস্ত জীবন সঁপে দেওয়ার বিরোধিতা করতে পারতেন, শক্তভাবে দাঁড়িয়ে বলতে পারতেন, 'না, আমার জীবন আমি নিয়ন্ত্রণ করবো।' সালমা আপা জানতেন, দাতাদের সাথে আমাদের কী সম্পর্ক। একবার সালমা আপা নিউইয়র্কে দাওয়াত পেয়েছেন, তিনি যাবেন কি যাবেন না চিন্তা করছেন। বললাম, 'আপা আপনার বোধহয় যাওয়া উচিত কারণ ওরা আন্তরিকভাবে আপনাকে চাইছে।' সালমা আপা বলেছিলেন,' অবশ্যই ওরা আমাকে চাইবে। কেননা আমরাই ওদের Project Proposal.' সালমা আপার অসাধারণ দূরদর্শিতা ছিল। এত সুন্দর করে বর্ণনা দিতে পারতেন! এত সুন্দর করে বলতে পারতেন! তিনি নিজের আত্মসম্মানবোধ দিয়ে, আত্মবিশ্বাস দিয়ে দাতাদের সঙ্গে সংস্থার সম্পর্কটিকে সম্মানজনক করে রাখতেন।’

১৬.
সালমা সোবহান শিশুদের অত্যন্ত ভালবাসতেন। দীর্ঘদিন তিনি আইন ও সালিশ কেন্দ্রে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন এবং অনেক সময় তিনি যা উপার্জন করেছেন, তা বাচ্চাদের জন্যে ব্যয় করেছেন। তিনি বাচ্চাদের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন। দরিদ্র, ছিন্নমূল ও শ্রমজীবী শিশুদের জন্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে তিনি গড়ে তুলেছেন আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে শ্রমজীবী শিশুরা হেসে খেলে সঙ্গীদের সাথে সময় কাটানোর সুযোগ পায়। সেখানে তারা গান গায়, ছবি আঁকে এবং অভিনয় করে নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। সালমা সোবহান মনে করতেন, শুধু নারীদের বিষয় নিয়ে কাজ করলেই চলবে না, সেই সাথে পথশিশু, শিশু শ্রমিক এবং নানাভাবে নির্যাতিত শিশুদের সহায়তার জন্যে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি বলতেন, শিশুদের ভাবতে শেখাতে হবে, তাদের নিজেদের পছন্দ বেছে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। নারী ও শিশু সংশ্লিষ্ট এক বক্তৃতায় তিনি শিশুদের নিরাপত্তাহীনতা এবং নিজেদের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, "রুক্ষ শোনালেও এগুলোই সত্য কথা। আমরা শিশুদের নিরাপত্তা দিতে পারি না, কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র চালাই মাত্র। যদি কোনো শিশু আমাদের কাছে আসে আমরা তার দেখাশোনা করি, যদি সে অসুস্থ হয় এবং তার মা আমাদের কাছে আসে, তখন আমরা তার জন্যে কিছু করার চেষ্টা করি; কিন্তু আমরা যা করি, তা সামান্য। যতক্ষণ না আমরা আমাদের কর্মসমূহ পরস্পরের সাথে যুক্ত করছি, এই সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছি, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা দরিদ্র শিশুদের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিতে পারবো না'৷ 

১৭.
সালমা সোবহানের সুক্ষ্ম রসবোধ ছিল অসাধারণ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এরকম একটি ঘটনার উল্লেখ করেন৷ 'সালমা আপার একটি বিরাট গুণ ছিল, তিনি অনেক ছোট ঘটনায় উদ্বেলিত হতে পারতেন। অনেক ছোট ছোট বিষয় থাকে, যেগুলো তাঁর চোখে পড়তো এবং সেসবের মধ্য দিয়ে মানুষকে আনন্দ দিতে পারতেন। কীভাবে মানুষকে একটু খুশিতে রাখা যায়, সেই চেষ্টা করতেন এবং সেটি করতে গিয়ে সালমা আপা অনেক সময় এমন ভাষা ব্যবহার করতেন, যেটি কখনো কখনো হিতে বিপরীত হতে পারতো। কারণ তিনি ভালো বাংলা বলতে পারতেন না। এ কারণে মানুষের কাছে তার রসিকতা অন্যরকম ব্যঞ্জনাও তৈরি করতো। সালমা আপা নিজেকে নিয়েও হাসতে পারতেন। একবার গাড়িতে উঠতে গিয়ে হাতে ব্যথা পেলেন। ডাক্তারের কাছে নেয়ার পর ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো 'আপনি কি ভারি কিছু তুলেছেন'? সালমা আপা তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে একটুখানি চুপ করে থেকে বললেন, 'হ্যাঁ তুললাম তো'! - 'কী তুললেন'?- 'আমার নিজের শরীরটাই। নিজের শরীরটাকে বাসে তুলতে গিয়ে...' এভাবে অনেকের সাথে তিনি কথা বলতেন, যাতে সুন্দর একটা রসবোধ ছিল। নিজেকে নিয়ে হাসতে, অন্যকে হাসাতে পারতেন।'

(তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, সালমা সোবহান : স্মারক গ্রন্থ, আসক, দৈনিক সংবাদ, প্রথম আলো, জনকণ্ঠ, সমকাল, Salma Sohan Memorial Lecture by Amartya Sen, ASK, ইন্টারনেট)

  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত