রোহিঙ্গা বিদ্বেষে একাট্টা সেনাবাহিনী ও সু চির দল
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:০২
মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ, গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চির দল এনএলডি এবং দেশটির সেনাবাহিনী যদি প্রথমবারের মত কোনো একটি বিষয়ে ঐক্যে পৌঁছে থাকে, তবে তা ঘটেছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণার ক্ষেত্রে।
তিন পক্ষই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ‘হুমকি’ হিসেবে দেখছে। রাখাইন রাজ্যের মুসলমান ওই জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে সেনাবাহিনীর যে অভিযান চলছে, তাতে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে অন্যরা।
দীর্ঘ সেনাশাসনের দিনগুলোতে সু চির দলকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। অন্য অনেকের মত এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতা নিয়ান উইনকেও বছর তিনেক জেলে কাটাতে হয়েছে সে সময়।
সেই নিয়ান উইন বলছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব তারা কোনোভাবেই লংঘিত হতে দিতে পারেন না। রোহিঙ্গা প্রশ্নে এই জায়গাতেই তারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে একজোট। আমরা সেনাবাহিনীকে পছন্দ করি না। কিন্তু এই বিষয়ে আমরা এক।
প্রায় পাঁচ দশক সেনাশাসনের পর মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসা এনএলডির মিডিয়া টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ৭৫ বছর বয়সী নিয়ান উইন। তিনি বলেন, এরা (রোহিঙ্গা) অবৈধ অভিবাসী, এটা নিশ্চিত। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনও সেটা বলে না। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের গ্রামে সেনা অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূলের’ চেষ্টা হিসেবে চিহ্নিত করলেও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের কূটনীতিরা বলছেন, সু চির পক্ষ ত্যাগ করে মিয়ানমারের ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপের রাস্তায় গেলে দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফেরার প্রক্রিয়া ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে এলেও রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, চলাচলের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।
গত ২৫ আগস্ট রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর থেকে শুরু হওয়া সেনা অভিযানে সরকারি ভাষ্যেই চারশর বেশি নিহত হয়েছে; ধ্বংস হয়েছে ছয় হাজার ৮০০ বাড়ি-ঘর।
এই দমন-পীড়নের মুখে চার লাখের মত রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এই সংখ্যা দশ লাখে পৌঁছাতে পারে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে।
বিদেশি নাগরিককে বিয়ে করায় সংবিধান অনুযায়ী মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি সু চি। তবে নতুন সৃষ্ট ‘স্টেট কাউন্সেলর’ পদের অধিকারী হিসেবে কার্যত তিনিই সরকার চালাচ্ছেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যাই আসুক, সু চির ভাষ্য হল- রাখাইনে বেসামরিকদের হত্যা ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) দায়ী। রাখাইন অভিযান নিয়ে ‘বড় পরিসরে ভুয়া তথ্য’ প্রচার করা হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন।
সেনা শাসকদের হাতে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দিত্বে কাটানো সু চি পরিণত হয়েছিলেন মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আইকনে; ছিলেন সবার কাছে সম্মানের আসনে। গণতন্ত্রের পক্ষে অহিংস আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন নোবেল শান্তি পুরস্কার।
কিন্তু রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে বর্তমান অবস্থানের কারণে এখন তিনি অনেক নোবেলবিজয়ী এবং বিশ্ব নেতাদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এমনকি তার নোবেল কেড়ে নেওয়ার দাবিও উঠেছে।
রোহিঙ্গাদের উপর যে নির্যাতন চলছে, তার নিন্দা জানানোর জন্য সু চির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই।
তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি নীরবতা ভাঙবেন- পুরো বিশ্ব সেই অপেক্ষায় আছে।
মালালার ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নান উইন্ট নামে মিয়ানমারের এক নাগরিক টুইটে লিখেছেন, তোমার প্রতি ধিক্কার মালালা! আমাদের দেশের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না। কোনো রোহিঙ্গা নেই, রাখাইনে শুধু বাঙালি সন্ত্রাসী আছে।
চলমান সেনা অভিযানের পক্ষে জনসমর্থন বাড়াতে বিভিন্নভাবে প্রচার চালাচ্ছে সু চির সরকার। অনেক ফেইসবুক ও টুইটার পোস্টে সহিংসতার কারণে বাস্তুচ্যুত অমুসলিমদের প্রতি সমর্থন দেখানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মানবাধিকার লংঘনের ‘ভুয়া খবর’ প্রচারের জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
গেল সপ্তাহে বিবিসির এক প্রতিবেদনে রাখাইনে রোহিঙ্গা গ্রামে বৌদ্ধ মগদের আগুন দেওয়া নিয়ে যে খবর এসেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় সু চির মুখপাত্র জ তাই এক টুইটে লিখেছেন, দয়া করে স্পষ্ট প্রমাণ দিন। আপনি লিখেছেন আপনি এটা দেখেছেন, আপনার সেই প্রমাণ আমাদের দিন।
অং শিন নামে এনএলডির একজন মুখপাত্র বলেন, বিদেশিরা রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করছেন, তা তৈরি হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্যের ভিত্তিতে। রাখাইনের আসল পরিস্থিতি কেবল মিয়ানমারের নাগরিকরাই বুঝতে পারছে।
মিয়ানমারের অনেকেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপস্থিতিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য হুমকি বলে মনে করেন।
সূত্র: বিডিনিউজ২৪