গোঁড়ামি-কুসংস্কারের সাথে লড়েই খেলে যাচ্ছেন তনিমা
প্রকাশ : ১১ জুন ২০১৭, ২১:৫৩
পৃথিবীতে সেই আদিম যুগ থেকে বুদ্ধির খেলা হিসেবে পরিচিত দাবা। মানুষ নিজের বুদ্ধিকে আরও তীক্ষ্ণ করার জন্য দাবা খেলে থাকেন। বাংলাদেশও বহু বছর যাবত দাবা খেলে আসছে। খেলছে দাবার বিশ্বকাপ।
আমাদের দেশেরই রয়েছে ৫ জন গ্র্যান্ডমাস্টার এবং রানী হামিদের মত কালজয়ী নারী দাবাড়ু। তবুও আজও নানান গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের কারণে নারী দাবাড়ুরা নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।
নানান বাধা-বিপত্তি পার হয়ে অনেক নারী দাবাড়ুই আজ সফল, কিন্তু বাধা-বিপত্তি তাদের পিছু ছাড়েনি। তেমনি এক দাবাড়ু সাবিকুর রহমান তনিমা। আদ্ব-দ্বীন মহিলা মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করছেন। পড়াশুনার পাশাপাশি সেই ২০১০ সাল থেকে নিয়মিত দাবা খেলছেন। ২০১৬ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন দাবা জাতীয় দলে। প্রতিনিয়ত তিনি বিভিন্ন গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের সাথে লড়াই করে খেলে যাচ্ছেন। স্বপ্ন দেখেন দেশের হয়ে বিশ্ব দরবারে প্রতিনিধিত্ব করার। দেশের লাল-সবুজ পতাকা তুলে ধরতে চান সবার উপরে। তনিমার দাবার এবং ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন। পাঠকদের জন্য থাকছে তনিমার দাবার কোর্টে এবং সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প।
২০১০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম দাবা খেলা শুরু করেন তনিমা। ঐসময় ফেডারেশন বয়স ভিত্তিক একটি দাবা টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছিল, যেখানে প্রথম অংশগ্রহণ করেন তনিমা। তবে পরিবারের ঘোরতর আপত্তি ছিল। এই শর্তে সে খেলার সুযোগ পায়, এই একবারই সে খেলবে আর কখনও দাবা খেলতে পারবে না। এই শর্তেই রাজি হয়ে কোন কোচ ছাড়াই, অনুশীলন ছাড়া অংশগ্রহণ করেন জাতীয় দলের এই তরুণী। তার খেলায় মুগ্ধ হয়ে, সেসময় প্রসংশা করেন দেশের প্রখ্যাত নারী দাবাড়ু রানী হামিদ। কিন্তু রানী হামিদের মত দাবাড়ুর প্রশংসাতেও মন গলেনি তনিমার পরিবারের সদস্যদের। কারণ দাবা খেলাটা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম!!
কিন্তু তনিমা বদ্ধপরিকর দাবা খেলার ব্যাপারে। তাই তিনি তার পরিবারকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন এখানে হারামের কিছু নেই। তাতেও পরিবার রাজি না হলে তনিমা পরিবারকে বলেন, তিনি যদি এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করতে পারেন তাহলে তাকে খেলতে দিতে হবে। তিনি এসএসসিতে ভাল ফলাফল করে পরের বছর ফের টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে ভাল খেলে আলোচনায় চলে আসেন। কিন্তু তখনও পরিবার কোনভাবেই তনিমার দাবা খেলাটা মেনে নিতে পারছে না। এবার নতুন অভিযোগ- ছেলেদের সাথে দাবা খেলাটা কতটা সঠিক!
এত ঝড়-ঝাপ্টার মধ্যেও নিয়মিত খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন এই দাবাড়ু। আজও পরিবার মেনে নেয়নি তার এই দাবা খেলা। পরিবারের সমর্থন না পাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে তনিমা বলেন, গত বছর আমি একটা টুর্নামেন্ট খেলে বেশ বড় একটা প্রাইজমানি পেয়েছিলাম। এত টাকা প্রাইজমানি পেয়ে আমি আনন্দে বাসার সবার জন্য অনেক খাবার কিনে এনেছিলাম। এই খাবার দাবার প্রাইজমানির টাকায় কেনা বলে বাসার কেউ খায়নি। আমি মনের কষ্টে সব খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন।
প্রথম প্রাইজমানি পাওয়ার পরও সে টাকা বাসার কেউ গ্রহণ করেনি। উল্টো বলা হয়েছে, এই টাকার বড় অংশ যেন ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। সেই টাকা দিয়ে দুইটা হাদিসের বই কেনা হয় এবং একজন মানুষকে খাওয়ানো হয়। তারপরও সেই টাকা কিংবা তনিমার দাবা খেলা কোনটাই পরিবার আজও মেনে নিতে পারেনি।
তনিমার পরিবার মনে করেন, মেয়ে দাবা খেলা মানে সে বেশ কুটিল বুদ্ধির অধিকারী হবে এবং তার বিয়ে দিতেও সমস্যা হবে। পাশাপাশি তারা বিশ্বাস করেন ধর্মীয়ভাবে দাবা খেলা ও প্রাইজমানি বিষয়টা সম্পূর্ণ হারাম।
তনিমার বাসায় দাবা খেলাটাকে এতটাই ঘৃণা করা হয় যে, তিনি জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছেন সেই কথাটাই নিজ মুখে বলতে পারেননি ভয়ে। বান্ধবীদেরকে দিয়ে বলাতে হয়েছিল এমন একটি খুশির সংবাদ।
তনিমার নিজের কোন প্রশিক্ষক নেই। তিনি খেলা দেখে, পিডিএফ পড়ে, পুরাতন ডাটা দেখে দেখে খেলা শিখছেন এবং খেলছেন। তিনি মনে করেন দেশের মেয়েদের দাবাতে আরও উৎসাহিত করতে এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে নারী দাবাড়ুদের জন্য ভাল কোচ ও প্রশিক্ষকের প্রয়োজন।
তবে পরিবার ও সমাজের এত অসহযোগিতার পরও তনিমা আজ বেশ সফল। নিয়মিত টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করেন। আর তিনি বিশ্বাস করেন, মেয়েদের উচিত সাজ-গোজ, ভার্চুয়াল জগত আর প্রাচুর্যতার চিন্তা বাদ দিয়ে দাবা খেলে নিজের মেধাকে আরও বিকশিত করা।
এত কষ্টের গল্পের পাশাপাশি তিনি তার আনন্দ ও সাফল্যের গল্পও বলেছেন লাজুক হাসি দিয়ে। বলেছেন সবচেয়ে ভাল লাগে যখন সিনিয়ার দাবাড়ুরা খেলার প্রশংসা করেন। কিংবা খুব ভাল লাগে যখন বন্ধু কিংবা শিক্ষকরা বেশ সমীহ করেন সেটা দেখতে।
তবে এত কিছুর পরও খেলাটা চালিয়ে যেতে চান তিনি। আর দেশের নামকে নিজের খেলার মাধ্যমে অনেক উপরে তুলে ধরতে চান।
সূত্র: টাইমস ওয়ার্ল্ড ২৪ ডটকম