আম্মা কখন কোথায় হারিয়ে গেলো?
প্রকাশ : ১৭ জুন ২০১৭, ২০:৩৮
“দূরত্ব জানে আজ একদিন বড়ো বেশী নিকটে ছিলাম”
আম্মার সাথে কথা বলি না কয়েকদিন। অনেক কিছু নিয়ে অনেক দিন ধরে আম্মার উপর অনেক রাগ জমা হয়েছে। বাচ্চাদের পরীক্ষার পড়া না পড়িয়ে ধর্ষণ বিরোধী সমাবেশে গিয়েছি বলে ক’দিন আগেই খুব বকেছিলো আম্মা। টিপ পড়ে গিয়েছি বলে বাড়তি বকা খেয়েছি। বেশ কিছুদিন ধরেই আম্মা আমার কোন টিভি প্রোগ্রাম দেখেন না। কারণ, আমি বেপর্দা হয়ে টেলিভিশনে যাই, আমাকে অমুসলিমের মতো লাগে!!
আমার এই আম্মাকে মেলাতে পারি না। কৈশোরে আম্মা ছিল আমার কাছে এক মরা দুপুরের নির্জনতায় আশ্রয়। আম্মা আমাদের দুই বোনকে দুই পাশে নিয়ে বড় বড় গল্পের বই পড়ে শোনাতো। শিউলি মালা, রিক্তের বেদন, নৌকাডুবি, মেজদিদি, বড়দিদি, নন্দিত নরকে, বিশের বাঁশি, দেবদাস আম্মার মুখেই শুনে শেষ করেছি কোন ছোটবেলায়! শঙ্খনীল কারাগারের রাবেয়াকে চিনেছি আম্মার মুখে মুখেই। কোন কোন বিষন্ন দুপুরে আম্মা গান শোনাতো। কি অদ্ভুত মন উদাস করা কন্ঠ ছিলো আম্মার! আম্মা চাঁদের আলোয় বাঁকখালির পাড়ে হাঁটতে নিয়ে যায়। কতো কথা, কতো গল্প, কতো স্বপ্ন!!
আম্মা ছিল আমার কাছে এক দুর্মুল্য আকাশ। আম্মার গায়ে কি সুন্দর একটা গন্ধ! এমন কি আম্মার শাড়িগুলো পাড়ার সবার চাইতে সুন্দর। আম্মা সারদিন কাজ করে, কিন্তু আম্মার শাড়ির ভাঁজ একই রকম থাকে। সবচেয়ে সাধারণ কাপড় দিয়ে অসাধারণ ডিজাইনের জামা শুধু আম্মাই বানিয়ে দিতে পারে। আম্মা তার জীবনের সমস্ত স্বপ্ন দিয়ে আমাদের সাজাতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন আমরা যেনো অন্য দশজনের মতো না হয়ে দশজনের একজন হই। তাই উদায়স্ত খাটুনির ভেতরেও তার নির্দিষ্ট সময় ছিলো আমাদেরকে শ্রুতলিপি করানোর জন্য। পাড়ার সব বাচ্চারা যখন মাঠে খেলছে তখন আমরা দুই বোন সেজে গুজে চুলে ঝঁটি বেঁধে আম্মার দুপাশে বসে কবিতা শিখছি। নজরুলের ‘বাতায়ন পাশের গোবাক তরুর সারি’, মুখস্থ করেছি আম্মার মুখে মুখেই। ওইতো সেবার, ক্লাস সিক্সে আমি একটা সাহিত্য সংগঠনের আয়োজনে আবৃত্তিতে প্রথম পুরষ্কার পেলাম, সেদিন আম্মা বলেছিলেন, “একদিন তোর কবিতাও কেউ আবৃত্তি করবে”।
আম্মা সারাজীবন বুঝিয়েছে, মা ছাড়া কেউ নাকি বন্ধু হয় না। সেই ফাঁদে পা দিয়ে আমি আম্মাকে বন্ধু ভেবে সব বলা শুরু করেছি। বারো বছরের আমি, জীবনে প্রথম পাওয়া প্রেমপত্রটি এনে আম্মার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আম্মা বলেছিলেন, “স্মৃতির পাথর অনেক ভারী। পাথর জমাসনে”। আহারে, আম্মার সেই কথা বিশ্বাস করে স্মৃতি জমে যাওয়ার ভয়ে জীবনে একটা প্রেম পর্যন্ত করলাম না যুত করে। আম্মা, সত্যি আপনি আমার অনেক ক্ষতি করেছেন।
আম্মা, ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইয়ের বাড়িতে মানুষ হয়েছে। যে বাড়িতে আম্মা বড় হয়েছে সে বাড়িতে শিক্ষা, রুচি আর আভিজাত্য ছিল দেয়ালে দেয়ালে। সেই রুচি আর আভিজাত্য আম্মা সাথে করে নিয়ে এসেছিলো আমাদের গেরস্থ পরিবারের বউ হয়ে আসার সময়। কিন্তু আমাদের নোনচা ধরা ঝাড় জঙ্গলের বিশাল যৌথ পরিবার আম্মার রুচি আর আভিজাত্যকে গ্রহণ করতে পারেনি। তাই আম্মাকে বিসর্জন দিতে হয়েছিলো অনেকটুকুই।
তার বদলে কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিলো নয়জন দেবর ননদের বিশাল পঙ্গপাল মানুষ করার দায়িত্ব। নাকের সর্দি, গায়ের ময়লা পরিষ্কার করে, শার্টের বোতাম, জামার হেম সেলাই করে দিতে দিতে সব শেষ হয়ে যাওয়ার মুহুর্তে আমাকে পেলেন। এবং খড়খুড়োর মতো করে আমাকে আকঁড়ে ধরে বাঁচলেন। আজ বুঝি, ওই ঘেসঘেসে বিশাল বাড়িতে আসলে আমিই ছিলাম আম্মার একমাত্র খোলা জানালা। একে একে আমার অন্য ভাইবোনেরা এলো। আম্মার আকাশ বড়ো হলো।
আম্মার একাডেমিক শিক্ষা খুব বেশী ছিল না। কিন্তু মননের সমৃদ্ধি আম্মা তার পরিবার থেকেই পেয়েছিলেন। তাই আম্মা আমাদের সব সময় যৌথ পরিবারের ঘেষাঘেষি, ঠেসাঠেসির মাঝে একদম আলাদা একটা বৃত্ত তৈরী করে আগলে রেখেছেন সব রকমের হোম পলিটিক্স, নোংরামী আর ক্ষুদ্রতা থেকে। শিখিয়েছেন ক্ষমা করো, উদার হও। ভালোবাসো, ভালোবাসা ফেরত আসবে বহুগুণ হয়ে। আজ আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ভালোবেসে যে পঙ্গপাল বড়ো করেছেন, তারা কি ফেরত দিয়েছে আপনাকে? প্রাণীগুলোকে মানুষ বানাতে পেরেছিলেন তো শেষ পর্যন্ত?
আমাদের বাড়িতে যে কতো অদ্ভুত রকমের নিপীড়ন আম্মার উপর চলতো তা বলে বোঝানো যাবে না। একে তো, আব্বা ছিলো আম্মার একদম বিপরীত রুচির মানুষ, তার উপর দাদার সাতকাহন সামলানোর চাপ। একদিকে বিশাল গুষ্ঠির হাঁড়ি সামলানো, অন্যদিকে মামলা মোকদ্দমার তদবিরের দৌড়। আম্মা একা একা কাঁদেন। কিন্তু আব্বা আসার সাথে সাথে চোখ মুছে স্বাভাবিক হাসি নিয়ে দাঁড়াতেন। আম্মা চাইতেন না, বাড়িতে কোন অশান্তি হোক। তখন থেকেই আম্মা আমাদের শেখাতেন আমাকে কিভাবে দুঃখ সহ্য করে সামনের দিন গুণতে হয়, অন্যের দুঃখকে বুঝতে হয়। মানবিকতা কতো সুন্দর হতে পারে, তা আম্মা ছাড়া আর কেউ বোঝাতে পারতো না।
আমার সেই আম্মা এখন তুমুল বদলে গেছে। কতযুগ ধরে বই পড়ে না! সত্তরের দশকে মঞ্চ নাটক দেখে বেড়ানো আম্মা, নজরুলের কবিতা মুখস্থ বলা আম্মা, কক্সবাজারের সবচেয়ে অগ্রসর সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠা আম্মা, কখন কিভাবে কোন যাঁতাকলে হারিয়ে গেলো? আম্মা এখন শুধু ‘বোখারী শরিফ’ আর ‘মরণের পরে’ পড়ে। আম্মার এখন শুধু কবরের আযাবের চিন্তা। সারাক্ষন বুক ধুপধুপ করে আম্মার এখন। এপারের হিসাব মিলাতে না পারা আম্মা এখন ওপারের হিসেব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেমন করে এতো বদলে গেলেন আম্মা?
আজ অনেকদিন পর অনেকক্ষণ আম্মার সাথে কথা বললাম। খুব কাঁদলাম ছোট বেলার মতো। অনেকদিন তো হয়ে গেলো কাঁদি না। আজকাল খুব কান্না পায়। একসময় কথায় কথায় কাঁদতাম বলে ওয়াটার ট্যাঙ্ক বলে ডাকতো আমাকে। সব সময় কাঁদার জন্য বকা খাই। কিন্তু আজকে যখন কাঁদলাম আম্মা বললেন, “কাঁদিস না। কান্না জমিয়ে রেখে দে। জীবন এরকমই। এখানে তোর কান্নার দাম কেউ দিবে না। কান্নাকাটি না করে নিজের কাজটুকু করে যা। বাচ্চাগুলো বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে পারলে সব শূন্যতা দূর হয়ে যাবে। তোদের বুকের ভেতরে এভাবে নিতে পেরেছিলাম বলে এই জীবন আনন্দ-বেদনায় কাটাতে পেরেছি। মনে রাখিস, ভেঙ্গে দেওয়াটা খুব সহজ। ধরে রাখাটা কঠিন। সেই কঠিন কাজটা ধৈর্য ধরে করেছিলাম বলেই আজ তোরা নিজের আকাশে ডানা মেলে উড়তে পারছিস”। এই তো আমার সেই আম্মা, বাঁচতে শেখানো আম্মা !!
আম্মা মানে সিম্পলি মুশকিল আসান। আজ আমার কতো স্বাধীনতা, কতো কাজ, ব্যস্ততা !! এখন আম্মার শাসন ভালো লাগে না। আম্মা সারাক্ষণ নামাজের হিসাব নেয়, মৃত্যুর কথা বলে, বাসায় ফিরতে রাত হলে বকা দেয়। বিরক্ত হই, ফোন কেটে দিই। তবু হঠাৎ করে সুতোয় টান পড়ে। আম্মার গায়ের গন্ধের জন্য আকুল ব্যকুল হয়ে ওঠে মন। মনে হয়, কত দূরে বাঁকখালি নদীর তীরে আম্মা ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে একটি কলের অপেক্ষায়। আজ যখন আম্মা বললেন, কাঁদিস না, কান্না জমিয়ে রেখে দে, তখন হঠাৎ মনে হলো, আম্মার বুকে কি অনেক কান্না জমানো আছে?
কখনো খুঁড়ে দেখিনি আম্মার বুকের ভেতরটা। জানি সে বেদনার তল খুঁড়ে বের করা আর হবে না এ জীবনে। তবু আজকের দিনে আমি শুধু চাই, আপনি আবার বাচেঁন। প্রাণে বাঁচেন আম্মা, মনে বাঁচেন। জীবনেও তো আযাবই পেলেন আম্মা...মরার আগে কেন মরছেন তবে? সেই অন্ধ বদ্ধ বাড়িতেই আপনি আমাকে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। আর আজ আপনার চারপাশে এতো আলো! কি নেই আজ আপনার? চারপাশে আলোর হাট রেখে কেন অকারণ বুক ধুপধাপ? দেখেন আম্মা, অনেক সুন্দর কিছু আপনার দরোজায় কড়া নাড়ছে। দরজাটা খুলেন আম্মা, বাঁচেন! আম্মা, আবার বাঁচেন...!!
লেখক: কলামিস্ট ও প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ