‘সব পুরুষ এক না’
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০১৬, ০২:১২
অনলাইনে আমার লেখায় কমেন্টগুলোর মধ্যে একটা কমন কমেন্ট হল, ‘সব পুরুষ এক রকম না’। মানে হল, সব পুরুষ খারাপ না। তাদের মতে, হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষের জন্যই তাদের বদনাম হয়। হাতে গোনা কয়েকজনের জন্যই কি দেশের প্রতিটা নারী, প্রতি মুহুর্তে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে? আর পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে, যারা নিজেদেরকে পুরুষতান্ত্রিক মনে করে না, তাদের গায়ে লাগে কেন?
সব পুরুষ নারীবিদ্বেষী- লম্পট-ধর্ষক-প্রতারক এই ভয়ংকর ভাবনা আমি স্বপ্নেও ভাবতে চাই না। কিন্তু ভালো পুরুষগুলো কি কেবল ফেসবুকেই পাওয়া যায়! নাকি তারা ফেসবুকেই ভালো, বাস্তব জীবনে তারাও একেকজন চরিত্রহীন-লম্পট? ভালো খারাপ চেনার উপায়টাই বা কী?
এখন হয়তো বলবেন, ‘তোমার বাপ-ভাই ও কি খারাপ?’
-আমার বাবা-ভাই আমার জন্য ভালো, তারা আমার জন্য নিরাপদ। কিন্তু তারা আমার মত আর পাঁচজন নারীর জন্য নিরাপদ এই কথা তো আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি না। কারণ তারা ছোটবেলা থেকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা চেতনা দেখে-শিখে-চর্চা করতে করতে বড় হয়েছে। সমাজের ধর্ষক-লম্পট গুলো তো সম্পর্কে কারো না কারো বাবা-ভাই-সন্তান হয়। আর কেবল ধর্ষণ না করলেই সে ভালো পুরুষ, এমনটাও তো বলা যায় না। পরিবারে গৃহবধূ কিংবা কন্যা সন্তানের ইচ্ছাগুলোকে যেভাবে দমন করা হয়, সে তো পরিবারের কর্তাবাবুর নির্দেশেই। প্রগতিশীলদের অনেককে আবার দেখা যায়, নিজের মেয়ের বেলায় আধুনিক হলেও নিজের স্ত্রীকে ঠিকই দাসী বানিয়ে রাখতে পছন্দ করে।
বাবা দিবসে লিখেছিলাম--
‘আজকে বাবা দিবস।। ফেবু স্ট্যাটাসের ভিত্তিতে জরিপ করলে সব বাবারেই ভালো কইতে হয়। কিন্তু বাস্তব জরিপে দেখা যায়, বউ পোলাপাইন আছে এরকম পুরুষেরা অন্যদের চেয়েও বেশি বিপদজনক। মেয়ে ডেকে পিঠে হাত বুলানোর ছলে পিঠ হাতানো টাইপ অভিজ্ঞতা বেশির ভাগ মেয়েরই থাকে। যেসব বুইড়াদের মাইয়া দেখলে ঈমান মেশিন খাড়াইয়া যায়, গুতাগুতি করে, চোখ টিপে, শরীর হাতানের চেষ্টা করে- তারা কাদের বাপ? তাদের সন্তানেরাও কি বাবা দিবসে, ‘আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা’ জাতীয় স্ট্যাটাস দেয়? জানি, সবার বাবাই তার সন্তানের কাছে সেরা। কিন্তু আমাদের বাবারা যদি ভালো বাবা হওয়ার পাশাপাশি ভালো মানুষ হতো, তাহলে হয়তো কোনও বাবাকেই সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হতো না’।
সবাই বাবা নিয়ে আবেগী স্ট্যাটাস দিচ্ছিলেন, সেখানে আমার এমন কথা অনেকের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকেছে। কিন্তু আমি কি ভুল কিছু বলেছি? আবেগ দিয়ে নয় যুক্তি দিয়ে একবার ভেবে দেখুন।
জন্মের পর থেকেই কেউ ধর্ষক, নারীবিদ্বেষী হয় না। শিশু বড় হতে হতে ধীরে ধীরে পরিবার সমাজের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের জীবনে সেসবের চর্চা করে। পরিবার থেকেই শিশুরা নারীবিদ্বষী হওয়ার শিক্ষাটা প্রথম পেয়ে থাকে। সমস্যা কিন্তু পুরুষের না, সমস্যা চিন্তা চেতনার, সমস্যা সমাজ ব্যবস্থার! তবে প্রগতিশীল পুরুষেরা যদি এ থেকে পরিত্রানের জন্য কোন ভূমিকা না রেখে উল্টো নারীবাদ সচেতন নারীদের ভুলত্রুটি নিয়ে মেতে থাকে, তবে বলতে হয় তাদের প্রগতিশীলতা কেবল পুরুষের প্রগতির জন্য বন্ধক রাখা।
নারীবিরোধী সমাজকে নারীবান্ধব করতে প্রথমেই দরকার, আমাদের চিন্তাচেতনার পরিবর্তন। আর চিন্তায় পরিবর্তন আনতে অনলাইন সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ আমাদের অধিকাংশের হাতেই এখন স্মার্টফোন আছে। সে উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা অনলাইনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগিং সাইটগুলোতে লিখি। আমাদের লেখাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করি।
সমাজের নারীবিদ্বেষী প্রথাগুলো ভাঙ্গার জন্য সাহস দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে তো আবার কেউ নিয়ম ভাঙ্গতে গেলে, নিয়মের বাইরে কিছু ভাবলে, কিছু করলে তার জন্য চাপাতি শান দেয়া হয়। তবে পরিবর্তনটা আসবে কি করে? আমরা কি তবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে পিছনের দিকেই যাবো?
লেখক: আহবায়ক, তসলিমা পক্ষ