ধর্ষণ, পতিতালয়, পেডোফিলিয়া
প্রকাশ : ১২ জুন ২০১৭, ১৬:৪৬
কিছু মানুষ আছেন যারা ধর্ষণ বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ দেখলেই ধর্ষকদের পতিতালয়মুখী হবার কথা বলেন। তাদের বলতে চাই ধর্ষকাম একটা মানসিক রোগ যেখানে একজন মানুষ আরেকজনের উপর চড়াও হয়ে ক্ষমতার বীভৎস প্রয়োগ করে। এই স্যাডিস্টিক মেন্টালিটির মানুষগুলোকে যতক্ষণে না থামানো হবে ততক্ষন পর্যন্ত এরা একজন থেকে আরেকজনে ধর্ষণ করেই যাবে। এদের স্বর্গে পাঠালে ওখানেও ধর্ষণ করবে। এটা অপরাধীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যারা ব্যাপারটা এখনও ধরতে পারছেন না তাদের হুমায়ূন আহমেদের ছবি - ‘প্রিয়তমেষু’ দেখার অনুরোধ করছি।
কাজেই পতিতালয়ের দিকে ধর্ষকামী মানসিকতার মানুষকে পাঠিয়ে দেয়া অনেকটা বাইপাস রাস্তার মত। মোদ্দা ব্যাপারটা অনেকটা প্রণোদনা দেবার মত হয়ে যাচ্ছে - এদিক দিয়ে না ওদিক দিয়ে ধর্ষকাম চালিয়ে যাও।
এবার আসি শিশুধর্ষকামী বা পেডোফিলিয়া কেস এ। এটা আরেকটা মেন্টাল ডিসঅর্ডার। পেডোফিলিয়াক লোকজনের উত্তেজনা জাগে বাচ্চাদের দেখলেই। অন্য কোন মেয়ে দেখলে এদের যৌন উত্তেজনা জাগবে না। পেডোফিলিয়াক মানুষ ছেলে মেয়ে উভয়ই হতে পারে। তবে ৮০-৯০% হল পুরুষ পেডোফিলিয়াক। মায়ের কাছে জানতে পারলাম তার এক নারী প্রতিবেশি ছিল। যার প্রধান কাজ ছিল বাচ্চাকাচ্চা পেলেই তাদের বিশেষ জায়গায় হাতড়ানো। কাজেই নারীদেরও একদম বাদ দিয়ে দেইয়া যাচ্ছে না তালিকা থেকে।
এবারে যৌনকর্মী প্রসঙ্গ।
কিছু ভ্রাম্যমাণ যৌন কর্মীর সাথে আলাপ হলে তাদের বাচ্চাদের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করি। তাদের সবারই ভাষ্য মত হল - তারা তাদের বাচ্চাদের বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চাদের এই পেশায় আসতে দিতে রাজি নন।
হরিশংকর জলদাসের 'কসবি' পড়ে আমার মনে হল ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা তবু সুখে আছেন। যারা নির্দিষ্ট কোন পতিতালয়ে বিক্রি হয়ে গেছেন তাদের অবস্থা খুবই করুণ। যারা নির্দিষ্ট টাকা শোধ করে মুক্ত হতে চান তাদের গুণতে হয় কড়া সুদের বোঝা। ফলাফল- না চাইলেও মাসীর ইচ্ছেমত খদ্দের এর মনঃবাসনা পূর্ণ করা লাগে। বিনিময়ে খাওয়া পরার টাকা পায় এরা। রীতিমত নরকের পরিবেশ। যারা একটু বেশি খরচার যৌনকর্মী (হাই রেট) তারা ভালোভাবে থাকার সুযোগ পেলেও ক্ষমতাবানদের হাতে রাখতে গেলে তাদেরও শরীর সায় না দিলে এক রাতেই বিছানায় তুলতে হয় কয়েকজনকে। বাচ্চা কাচ্চা কেউই চায় না নিতে। তবে ছেলে বাচ্চা হলে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসেন আর মেয়ে বাচ্চা হলে পল্লীর মাসীরা খুশিই হন। আয়ের পথ বাড়ল তাদের।
আমার ধারণা পতিতালয়ে কোন মেয়ে বাচ্চার জন্ম হলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃত হয়ে যান মা। যে কিনা নিজেই ধুঁকে ধুঁকে মরে অসংখ্যবার নিজের মৃত্যু কামনা করে অভ্যস্ত তিনি নিজেই আবার তার সদ্য প্রসূত বাচ্চার মৃত জীবনের বোঝা বয়ে বেড়ান। ব্র্যাক সহ অনেকগুলো এনজিও অনেকদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই মেয়ে বাচ্চাগুলোকে স্বাভাবিক জীবন দেবার। চেষ্টা করছে তাদের স্কুল মুখী করার।
জানি পতিতালয়ের মাসী সর্দারনী কিংবা সর্দার কেউই চান না তারা তাদের বাচ্চারা শিক্ষিত হোক। কারণ শিক্ষিত হলে যত বেশি জানবে তত কম মানবে। পল্লীর শোষণের সামাজিক কাঠামো বজায় রাখতে গেলে অবশ্যই মায়েদের নিরুৎসাহিত করতে হবে বাচ্চাগুলোকে শিক্ষিত করার জন্যে। স্বাভাবিকভাবেই সর্দার- সর্রদারনীরা করে থাকেন সেটা। তবুও কিছু মায়েরা বাচ্চাদের এই স্কুলগুলোতে পাঠান। জীবনে কিছুদিনের জন্যে তারা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেন তারপরে আবার ফিরে যান সেই পুরোনো বৃত্তে।
পতিতালয়ের চাহিদা কিংবা সর্দারনীর চাহিদা অনুযায়ী মায়েরা বাচ্চাদের নাচের তালিম দেন তারপরে আদিম নিয়মানুযায়ী “বক্ষ ভান্ডের মধ্যে প্রবৃত্তির উত্তাপে আনন্দ রস গাঁজিয়া সফেন মদ্য রসে পরিণত হইয়াছে”। মোনালি ঠাকুর অভিনীত ‘লক্ষ্মী’ ছবি দেখার অনুরোধ করছি বাকিটা বোঝার জন্যে।
পেডোফিলিয়া বনাম যৌনকর্মী
পেডোফিলিয়াক মানুষগুলোকে গণিকালয়ে পাঠানো মানে হল পতিতালয়ের যে বাচ্চাগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন এনজিওগুলো স্বাভাবিক জীবন দেবার চেষ্টা করছে তাদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মেয়ে বাচ্চাগুলোকে আবার সেই পুরনো চক্রে ফেলে দেয়ার সামিল। ফলাফল বাচ্চাগুলো বয়স হবার আগেই পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়ে ধর্ষিত হতে থাকবে। উল্লেখযোগ্য হল - শিশুর মানসিক সম্মতি থাকলেও তার সাথে যৌনাচার প্রচলিত আইনে ধর্ষণের সামিল।
এখানে কথা হতে পারে যেখানে পল্লীর বাইরে মেয়েরা মানুষ বলেই গণ্য হন না সেখানে প্রচলিত আইন কতটুকু খাটে? হ্যাঁ প্রতিটা পল্লী থেকে একটা নির্দিষ্ট কমিশন চলে যায় নিকটস্থ থানা এবং অবশ্যই রাজনৈতিক নেতার কাছে। ফলাফল “ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ঐ ভদ্র পল্লীতে। এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না”।
তবুও বিকেক জেগে রয়। যেখানে দাঁড়িয়ে কোন নেতাকে আমরা দ্বিধাহীন কন্ঠে বেশ্যার দালালদের গুলি করার আদেশ উচ্চারণ করতে দেখি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আর যাই হোক যৌনকর্ম কোন পেশা হতে পারে না। যৌনকর্মকে একটা সুস্থ কর্মসংস্থান দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা খুব জরুরি।
শেষ কথা - প্লিজ আমরা কেউ যেন ধর্ষণের সাথে গণিকালয়কে মিলিয়ে না ফেলি। কখনই না মিলিয়ে ফেলি। ধর্ষণ নিকৃষ্টতম অপরাধ। আর কোনভাবেই অপরাধের কোন বাইপাস হয় না। একমাত্র শাস্তিই পারে এই অপরাধ প্রবণতাকে কমাতে।
লেখক: জাবি শিক্ষার্থী ও সমাজকর্মী