লংগদু এবং কিছু নিজের কথা
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০১৭, ১৯:৫৮
প্রথমতঃ বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভাষ্য এবং তথ্য বাংলাদেশে কোন আদিবাসী গোষ্ঠী নেই যারা আছে তারা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, খিয়াং, গারো, উড়াও, হাজং, কোচ, বানাই, মুনপিুরী আরো যে অন্যান্য গোষ্ঠী রয়েছে যাদের কথা বলার ভাষা আলাদা, কৃষ্টি সংস্কৃতি ভিন্নরকম, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান সব ভিন্ন তারা বাংলাদেশেরই কিন্তু তারা আদিবাসী নয় তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।
সত্যি কথা বলতে কি এই যে মনের মাধুরী মিশিয়ে মনের মত করে কোন স্বার্থ হাসিল করার জন্য এবং কোন অন্যায় ধামাচাপা দেয়ার জন্য যে ইচ্ছামত নাম রেখেছে এই নাম চাকমা মারমা গারোরা কেউ বাপ দাদার মুখে শুনেনি এবং শিক্ষিতরাও ভালোমত উচ্চারণও করতে পারে না নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। তবে হাজারবার সত্য কথা হলো এসকল গোষ্ঠী নিজেদেরকে আদিবাসী নামে ডাকলেই গর্ববোধ করে এবং এ নামই তাদের রক্ত মাংসের মধ্যে মিশে রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ সদাসর্বদা বা সবসময় ছোটখাটো অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করেই যে এদের থাকতে হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেই বাঙালি না যেহেতু চোখ মুখ চেহারা দেখেওতো যে কেউ বলতে পারে, ঢাকা শহরে হলে 'চাকমা চাকমা' আবার জেলা শহরগুলোতে 'গারো গারো' বা 'চিং চাং চং' মানে ভাষাকে কটাক্ষ করে এভাবেই শুনিয়ে শুনিয়ে টিটকারি দিতে থাকে। যখন থেকে মা-বাবার হাত ধরে প্রয়োজনে বাইরে বিচরণ শুরু করে তখন থেকেই এ কটাক্ষ হজম করে চলেছে বাংলাদেশের প্রতিটি আদিবাসী গোষ্ঠী।
বাঙালিদের দেখে কেউ যদি কটাক্ষ করে বলতে থাকে বাঙাল বাঙাল আপনার কেমন লাগবে তখন একটু অনুভব করে দেখেন। সাপ খাও, ব্যাঙ খাও, ইঁদুর খাও, পোকামাকড় খাও, পঁচা ভাত খাও, আরো কত কিছু। যে কোন মানুষ যার রুচিতে যেটা খেয়ে থাকুক না কেন তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি কারো অধিকার আছে?
তৃতীয়তঃ ইদানিং লংগদুতে যে ৩০০টির মত ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা নির্যাতন করে ঘরছাড়া করা হচ্ছে তা তো আজকের বা এ কয়দিনের মধ্যে হঠাৎ করে হয়নি। প্রশাসনের কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই এমনই মনে হয় কারণ মানুষ ভুলে যায়নি কয়দিন আগেও দিনাজপুরে সাওঁতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল সেখানে পুলিশ প্রশাসন স্বয়ং থেকেই আগুন জ্বালানোর কাজে সহায়তা করেছিল। মধুপুরে ইকো পার্কের নামে শত শত গারো আদিবাসীদের জায়গা জমি দখল করে ঘরছাড়া করার কাযে লিপ্ত রয়েছে এবং সিলেটেও একই অবস্থা।
স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে এসেও যদি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীই এখনো দেখতে হয় তাহলে স্বাধীনতার নামে প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে? স্বাধীনতা কি শুধুমাত্র বাঙালিদের জন্যই ছিল? স্বাধীনতা কি শুধুমাত্র নেতা নেত্রীদের জন্যই ছিল? স্বাধীনতা যুদ্ধে যে চাকমা মারমা গারো হাজংদের রক্ত দিতে হয়েছিল সে রক্তে কি কলংক ছিল নাকি যার জন্য আজকে তাদের বংশধররা এত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে?
চতুর্থতঃ একটির পর একটি ঘটনা ঘটেই চলেছে অথচ কয়টার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে বা কয়জন দৃষ্কৃতকারীকে শাস্তি দেয়া হয়েছে? পাহাড়েই থাকুন বা সমতলেই থাকুক বাঙালি না হলেও আদবিাসীরাও এ দেশের নাগরিক, জন্মসূত্রেই এ দেশের নাগরিক, দেশের সকল ধরনের নাগরিক সুবিধা পেতে তাদেরও অধিকার রয়েছে এবং অধিকার কিভাবে আদায় করতে হয় সে পথ ধরে অধিকার আদায়ের ইতিহাসও রয়েছে। সুতরাং তাদের অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্ব এ সরকারেরই তা কোনভাবে এড়িয়ে গেলে চলবে না। একসময় তার জবাবদিহি দিতেই হবে। উল্টাপাল্টা বিবৃতি দিয়ে মিথ্যাচার করেও সত্য ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার পাঁয়তারা সবসময়ই দেখে এসেছি এবং লংগদুর ব্যাপারেও তাই শুরু হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এত এত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করতে হবে কেন?
লেখক: প্রকল্প ব্যবস্থাপক, ওয়ার্ল্ডভিশন বাংলাদেশ