আমাদের ছেলে সন্তানেরা 'না' শব্দের মানে জানে না!

প্রকাশ : ২৮ মে ২০১৭, ০৩:৩২

আমাদের দেশে ধর্ষণ একপ্রকার উৎসব। প্রতি মিনিটে একজন নারী এদেশে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বৈবাহিক ধর্ষণেও আমাদের দেশ প্রথমসারির দিকে। এইসব ধর্ষণের ঘটনার বেশিরভাগেরই কোনো এফ আই আর হয় না। বেশিরভাগের খবরই প্রচারমাধ্যমে আসে না। তারপরও যে ঘটনাগুলো আসে, সেটা নিয়ে কদিন মাতামাতি হয়, মোমবাতি মিছিল হয়, ফেসবুকে ধর্ষকের ফাঁসি নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়। আরেকপক্ষ ধর্ষণের জন্য মেয়েদের পোশাক, চরিত্র দায়ী বলে আকাশ বাতাস আন্দোলিত করেন। তারপর ধীরে ধীরে আবার সব শান্ত হয়ে পড়ে। জনগণ আবার কোনো নতুন ইস্যু নিয়ে মাতামাতি শুরু করে। 

আবার ক'দিন পর নতুন কোনো পৈশাচিক ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। একপক্ষ মোমবাতি নিয়ে হাঁটেন, আরেকপক্ষ মেয়েদের পোশাক অব্দি যান। ব্যস এই অব্দিই। এদিকে ধর্ষণের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। 

আসলে এভাবে মোমবাতি হাতে হেঁটে, বা পোশাকের দোহাই দিয়ে কোনোদিন ধর্ষণ কমানো যাবে না। ধর্ষককে ফাঁসি দিয়েও ধর্ষণ কমানো যাবে না। ধর্ষকের লিঙ্গ থেঁতলে দিলেও ধর্ষণ কমানো যাবে না। কারণ আমাদের গোড়ায় গলদ। ছোট থেকেই আমাদের ছেলে সন্তানের মধ্যে ধর্ষণের মানসিকতা তৈরী করা হয়। এই মানসিকতাটাই মহামারী। স্যুট টাই পরা ভদ্রলোক থেকে শুরু করে অশিক্ষিত রিক্সাওয়ালার মধ্যেও এই ধর্ষণের মানসিকতা লুকিয়ে থাকে। তাই যতদিন অব্দি না এই মানসিকতার আমূল পরিবর্তন করা হচ্ছে, ততোদিন অব্দি ধর্ষণ আর ধর্ষিতার সংখ্যা এভাবেই বেড়ে চলবে। 

আমাদের সমাজের মা-বাবারা মেয়েটি যে কোনো সময় ধর্ষিত হতে পারে এই আশঙ্কা করেন, কিন্তু নিজের ছেলেটাও যে ধর্ষক হয়ে উঠতে পারে, সে ব্যাপারে তাদের কোনো মাথাব্যাথা নেই। মা-বাবারা মেয়েদের সর্বদা না করতে ব্যস্ত। এটা না, ওটা না, হাফ হাতা পোশাক না, রাতবিরেতে একা যাওয়া না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারা এই 'না' শব্দটার শিক্ষা নিজের ছেলেদের দেন না। আমাদের মা-বাবারা মেয়েদের সর্ব অবস্থায় 'না' করে, কিন্তু মেয়েদেরও যে 'না' বলার অধিকার আছে, মেয়েরা 'না' বললে যে সঙ্গে সঙ্গে থামতে হয়, এই শিক্ষাটা নিজের ছেলে সন্তানকে দেয় না। 

তাই সমাজের মা-বাবারা, এবার থেকে মেয়েদের নিয়ে সদা শংকিত না থেকে, নিজের ছেলে সন্তানটিকে নিয়ে ভীত থাকুন। কারণ আপনার ছেলে সন্তানটিও কিন্তু যেকোনো সময় ধর্ষকের ভূমিকায় নেমে আসতে পারে। তাই এখন থেকে নিজের ছেলে সন্তানদের আগলে রাখুন ধর্ষণের চিন্তা থেকে, খারাপ বন্ধুদের থেকে। মেয়েরাও তাদের মতো সমান মর্যাদা সম্পন্ন মানুষ এবং মেয়েদের অনুমতি ব্যতীত তাকে ছোঁয়া সবচেয়ে বড় অপরাধ, সবচেয়ে বড় পাপ, এই শিক্ষা নিজের ছেলে সন্তানকে দিন। সাথে এটাও বলুন, নিরাপদ থাকা মানে শুধু নিজে নিরাপদ হওয়া নয়, অন্যকে বিপদে না ফেলার নামও নিরাপদ থাকা। 

"No means No. So no need of explanation or strong causes or more speech for it." - এই কথাটা নিজের ছেলেটিকে মন্ত্রের মতো শেখান। নিজের ছেলেটিকে শেখান বিকৃত যৌনইচ্ছা সংবরণ করাই 'মানুষের' ধর্ম। একটা মেয়ে যখন 'না' বলবে তখন তাকে থেমে যেতে হবে। 'না' মানে নিজের যৌনইচ্ছা সংবরণ করতে হবে। সেই না'টা প্রেমিকা বলুক বা কোনো যৌনকর্মী, অফিসের কলিগ বলুক, সহপাঠী বলুক, বা যে কোনো অপরিচিত মেয়ে কিংবা নিজের বউ, তাকে থেমে যেতে হবে। 'না' মানে না। 'না' মানে তাকে থামতে হবে। 'না' বলার পরও যদি সে অগ্রসর হয়, সেই মুহুর্তেই সে 'মানুষ' থেকে জানোয়ারে পরিণত হবে। 

এই শিক্ষায় ঘরে ঘরে প্রত্যেক মা-বাবারা তার ছেলেকে মানুষ করে তুলুন, দেখবেন 'ধর্ষণ' আমাদের সমাজ, দেশ থেকে নির্মূল হয়ে গেছে।

লেখক: শিক্ষক ও অ্যাক্টিভিস্ট

0Shares
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত