নারীবাদীদের স্বামীরা
প্রকাশ : ২৫ মে ২০১৭, ০১:৫৫
নারীবাদীদের স্বামী বা প্রেমিকেরা কেমন হন? নারীবাদী আন্দোলন করতে গিয়ে যারা মুভমেন্টটার সাথে জড়িয়ে আছেন তাদের এই জ্বলন্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতে হয় প্রায়শঃই। নারীবাদীদের পার্টনারদের কি হাত-পা থাকে? চোখ-কান থাকে? অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব ঠিকঠাক? তারা কি মিনমিন করে কথা বলে না কি জোর গলায়? তারা কি নিজের পয়সায় খায় নাকি বউ বা প্রেমিকা তারে খাওয়ায়? তারা কি বউকে স্বাধীনতা দেয় নাকি বউয়ের ভয়ে কাটা হয়ে থাকে? স্বামী কি বিদেশ থাকে? স্বামী আপনাকে সন্তুষ্ট করতে পারে না? (শারীরিকভাবে) স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হন প্রতিনিয়ত? আচ্ছা আপনার স্বামী তো অনেক ভালো, আপনাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয় আপনি কেন নারীবাদী হয়েছেন? অথবা নারীবাদীদের স্বামীরা নারীর দ্বারা নির্যাতিত হন এটাও একটা সাধারণ ধারণা।
সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়, কেউ বিশেষতঃ নারী যদি নারীবাদী হন তাহলে নিশ্চয় তার কোন সমস্যা আছে। পারিবারিক বা ব্যাক্তিগতভাবে বঞ্চনার ইতিহাস ছাড়া কোন নারীর নারীবাদী হওয়ার কথা নয়। এক দিক দিয়ে এই কথাটা মিথ্যা নয়। পৃথিবীতে বঞ্চনার ইতিহাস ছাড়া তো কোন সংগ্রাম হয়নি। বঞ্চিত হওয়ার ফিলিংস থেকেই তো মানুষ সমতার লড়াইয়ে নামে। ফলে বিবাহিত বা এনগেজড নারী যখন বঞ্চনার শিকার হন তিনি নারীবাদী হয়ে উঠতেই পারেন। একই কথা পুরুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পিতৃতন্ত্রর ফেরে পড়া পুরুষও নামতে পারেন সমতার লড়াইয়ে।
কিন্তু সহযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলাম, যথেষ্ট অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের সাথে সংসার করা নারীটি যদি সমতার কথা বলেন তাহলে শুনতে হয়, আরে ওর স্বামী তো ভিজা বিড়াল, বউরে কিছুই বলে না। তাই এতো বাড় বাড়ছে। আবার যদি প্রগতিশীল পার্টনার হন তবে নারীটিকে শুনতে হয়, স্বামী এরকম উদার মনের তো তাই বউটি এসব করতে পারছে। নারী নিজের যোগ্যতায় বা ইচ্ছায় কিছু করতে পারে সে ধারণাই নাই এই অবিকশিত সমাজে।
আরও বুঝলাম, যারা নারীবাদের কথা মুখে এবং সামাজিক মাধ্যমে জোরেসোরে বলেন তাদের সকলের পার্টনারই নিজেরাও সমতায় বিশ্বাস করেন। বস্তুত নারীবাদী নারীর পার্টনার যদি সমতায় বিশ্বাসী না হন তবে সে সংসার টেকেও না।
তবে এসবের বাইরেও আরেকটি জীবন আছে কিছু নারীর। সে জীবন অর্ধসত্য জীবন। যে জীবনে একচিমটি সমতার সাথে একমুঠো বঞ্চনা মিশে থাকে। সেই বিবাহিত নারীবাদীরা সংসার ভাঙার কোন কারণ খুঁজে পান না। কারণ তারা জানেন, নারীবাদের এই মুভমেন্ট মাঝপথের একটা পর্যায়ে রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তারা কতটা সমতা অর্জন করতে পেরেছেন তার চেয়েও বড় কথা তারা সমতা চেয়েছেন। তাদের এই চাওয়া হয়তো অত সশব্দ নয়, কিন্তু তা বলে তাদের চাওয়াটাও অসত্য নয়।
চোয়াল শক্ত করে সমতার কথা বললেই কেউ প্লিজ তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাবেন না। নারীবাদ কোন কিম্ভুতকিমাকার বিষয় নয়। কার স্বামী আছে বা নেই, কে কয়জনের সাথে শোয়, সমকামে শোয় না বিষমকামে এসবের সাথে ফেমিনিজমের কোন সম্পর্ক নেই। আর নারীবাদীদের পার্টনাররাও কখনও কখনও শুধুই পুরুষ অথবা পিতৃতন্ত্রের পুত্র। এই পার্টনারদের সাথেই সংসারের তেল-নুনের হিসেব কষেই নারীবাদীরা সমতা চান।
জেন্ডার ইনসেনসেটিভ একটা সমাজে বাস করতে করতে আমাদের অভ্যাস হয়ে যায়। ফলে জীবনযাপনের বিভিন্ন খাঁজে খাঁজে নারীর অবমাননার বিভিন্ন ঘটনা কারো কাছে অস্বাভাবিক লাগে না। বরং প্রতিবাদ করা নারীর পার্টনাররা কেমন সেটা হয়ে দাঁড়ায় কৌতুহলের বিষয়।
নারীদের প্রতি ইনসেনসিটিভ আচরণ যেমন আমাদের বন্ধ করা দরকার তেমনি কেউ একজন যখন নারীবাদী হয়ে উঠেন বা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলেন তখন তাকে নিয়ে সমালোচনা করেন; কিন্তু ইনসেনসিটিভ আচরণ বন্ধ করেন, কেউ নারীবাদী হলে তাকে ভিন গ্রহের প্রাণী টাইপ কিছু ভাবাকে দয়া করে বন্ধ রাখেন। এবং একই সাথে ভিকটিমবাদ প্র্যাকটিসও বন্ধ করা জরুরী। কোন মেয়ে স্বামীর মার খেয়ে গায়ে কালশিটে ফেললে আপনি পাশে দাঁড়াবেন, আর কোন মেয়ে অসমতার প্রতিবাদে গলা তুললে আপনি তার স্বামী বা পার্টনার কে? সেই খোঁজ নেবেন অথবা তার স্বামীর দিকে অবাক হয়ে তাকাবেন এই ভেবে যে এই মেয়ের স্বামী কি ধ্বজ না কি - এইগুলো চলবে না।
এই পিতৃতান্ত্রিক প্রাধান্যের সমাজে যেমন নারীর স্বাধীনতাও নানাভাবে সীমিত, তেমনি এই সীমিত অবস্থার মধ্যেই একজন নারীকে তার বিষয়ে কথা বলতে হবে, তার নারীবাদী হয়ে যাওয়াটা এক লাফ দিয়ে উতরে যাওয়ার বিষয় নয়; এটাও তাকে ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে হচ্ছে; সমতার লক্ষ্যে এই হয়ে উঠার সৎ ও আন্তরিক প্রচেষ্টাটার একটি প্রয়াসই নারীবাদ!
লেখক: সাংবাদিক