সমপ্রেমি হলেই কেউ ক্রিমিনাল হয়ে যায় না
প্রকাশ : ২১ মে ২০১৭, ২১:০৫
জুলহাস মান্নান আর ওর বন্ধু, নাটকে অভিনয় করতো ছেলেটা, ওদেরকে যে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে মেরেছে তার কি একবছর হয়ে গেছে? আমরা একসময় সবকিছু ভুলে যাই, কিছুই মনে থাকে না, ভুলে যাই যে একটা অন্যায় হয়েছিল আমাদের দেশে যার বিচার হওয়াটা ফরজ ছিল, কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র বিচারটা করেনি। এই ভদ্রলোক, জুলহাস মান্নান, সমপ্রেমিদের একটা কাগজ বের করতো, 'রূপবান', সেই কাগজটি কি এখন আর বের হয়? জানি না। জানবো কি করে? এই কাগজ যদি বেরও হয়, আপনার গলির মোড়ের খবরের কাগজের দোকানটিতে তো এটা দেখতে পাবেন না।
দেখা যাচ্ছে যে এই পর্যন্ত যাত্রায় ওরা সফল হয়েছে। যারা মানুষের কল্লা কেটে ভিন্নমত দমন করতে চায় মনে হচ্ছে ওরাই সফল হয়েছে। কিভাবে? দেখেন না, জুলহাস মান্নানকে হত্যার পর থেকে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রায় রংধনুর মিছিলটি আর যুক্ত হয় না। রাষ্ট্র যেন ওদের কাছে নতজানু হয়েছে। কেরানীগঞ্জে ২৭ জন্য যুবককে গ্রেফতার করেছে র্যাব- কেবল ওরা সমপ্রেমি বলেই।
এইসব কল্লা কাটাকাটিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি যেটি হয়েছে, একটা আতঙ্ক ঢুকে গেছে অনেকের মনে। বিশেষ করে সংসারী সেইসব মানুষ, যারা যৌবন পেরিয়ে এসেছেন, মনে মনে ধরেই নিয়েছেন এইভাবেই বাকি জীবন কাটবে, এই দেশে আর বিপ্লব হবে না। এরা ভয় পেয়েছেন এবং সেই ভয়টা তরুণদের মধ্যে ছড়াচ্ছেন। এটা একটা বড় ক্ষতি। কারণ এই আতঙ্কের কারণে তরুণরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছে না। র্যাডিকেল যে কোন কিছু ভাবতে গেলে বা বলতে গেলেই ওদেরকে থামিয়ে দিচ্ছে বড় ভাইরা, 'এইসব বলবে না, এইসব বলে বিপদ ডেকে আনার কোন মানে নাই ইত্যাদি'।
এই যে ২৭ জন তরুণকে র্যাব গ্রেফতার করেছে ওরা সমপ্রেমি বলে, এটা অন্যায়। এটা অন্যায় কারণ, প্রথমত একজন একজন মানুষ কাকে ভালবাসবে সেটা তো ভাই সমাজ বা রাষ্ট্র ঠিক করে দিতে পারবে না। আপনি একজন নারীকে ভালবাসবেন নাকি একজন পুরুষকে ভালবাসবেন সেটা আপনার ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। আসলে ঠিক পছন্দেরও ব্যাপার না, এটা একটা শারীরিক ব্যাপার যার উপর আপনার কোন হাত নাই। আর প্রেমের ব্যাপারটা তো নেহায়েতই নিজস্ব ব্যাপার। এটা নিয়ে আপনারা ঘাঁটাঘাটি করবেন কেন? আমার বেডরুমে আপনি উঁকি মেরে দেখতে থাকবেন? কি আজব!
কিন্তু সবচেয়ে অবাক হয়েছি কি দেখে জানেন? এই যে ২৭জন ছেলেকে র্যাব অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করলো, এর বিরুদ্ধে কিন্তু কোন প্রতিবাদ হলো না। অনলাইনেও না, অফলাইনেও না। উল্টা দুইএকজন বন্ধু, যাদেরকে লিবারেল এবং মুক্তমনা বলে পছন্দ করি, ওরাও দেখি কায়দা করে বলছেন, সমপ্রেম নাকি বাংলাদেশের আইনে অপরাধ সুতরাং পুলিশ যে ওদেরকে গ্রেফতার করেছে সেটার নাকি প্রতিবাদ করা ঠিক হবে না। ওরা অবশ্য সমপ্রেম বলেন না, সমকাম বলেন। বলুক, ওরা কামের দিকটা বড় করে দেখেন, ওরা সমকাম বলুন, ওদের ইচ্ছা।
দেখেন, আইনের ব্যাপারটা ভিন্ন। আমাদের দেশের পিন্যাল কোডে ৩৭৭ ধারায় 'আনন্যাচারাল অফেন্স' নামে একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ আছে। সেখানে বলা হচ্ছে কেউ যদি কোন নারী বা পুরুষ বা পশুর সাথে 'against the order of nature' সঙ্গম করে তাইলে তার সাজা হবে। এখন সমপ্রেমিরা যখন পরস্পরের সাথে মিলিত হয় সেটা কি carnal intercourse against the order of nature হবে? চিন্তা করে দেখেন। এখন আমরা যতটুকু জানি, চিকিৎসা বিজ্ঞান বলেন বা সমাজবিজ্ঞান বলেন, এখন তো সকলেই বলছেন যে সমপ্রেম নাকি against the order of nature তো নয়ই, বরং পুরাই ন্যাচারাল। তাহলে?
তাছাড়া এই যে অপরাধটা, আনন্যাচারাল অফেন্স, কিছুসংখ্যক লোক একসাথে জড়ো হলেই এই অপরাধটা সংগঠিত হয় না বা এর এটেম্পট হয় না। কেবলমাত্র ঐ কাজটা করলে বা করতে গেলেই অপরাধটা হয়। একজন মানুষ প্রকৃতিগতভাবে সমপ্রেমি হলেই সে ক্রিমিনাল হয়ে যায় না। এমনকি আমাদের প্রচলিত আইনেও না।
সুতরাং প্রতিবাদটা করুন। ওরা মারতে আসুক, কাটতে আসুক, আসুক। আপনি যদি লিবারেল হয়ে থাকেন, তাহলে এইসব প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই হবে। এমনকি সেটা যদি প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধেও যায়। বরং প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটা একটু বেশি জরুরী।
লেখক: আইনজীবী