কাঁটা
প্রকাশ : ১৩ মে ২০১৭, ২২:২২
অগ্রণী বোধশুন্য হয়ে বসে আছে নব’র কবরের পাশে। মেয়েদের কবরের কাছে যেতে নেই, সারাজীবন মেনে আসা নিয়ম আজকে তার কাছে অর্থহীন লাগছে। নব তার চেয়ে পনের বছরের ছোট, যে বয়সে মেয়েরা বন্ধুদের সাথে গল্পের বই নিয়ে কাড়াকাড়ি করে সে বয়সে অগ্রণী ছোট বোন নবকে নিয়েই দিনরাত মেতে থেকেছে। ছোট পুতুল বোন তার; তার জামা পরানো, ছোট পায়ে তেল মাখানো, বড় বড় চোখে বড় বোনের দিকে তাকিয়ে নব’র খিলখিল করে হাসা, মনে হয় এই তো সেদিন! সেই বোনটা মাত্র বিশ বছর বয়সে চলে গেল সেই না ফেরার দেশে। এই মাটির ঢিবির নিচে শুয়ে আছে ছোট্ট নব, বাড়ির মহিলা এবং পুরুষরা অগ্রণীকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কেউ আদর করে বলেছে, 'পাগলামি করস কেন? সেতো আর ফিরব না। মাইয়া মাইনষের কবরে যাইতে নাই। নামাজ পড়, দোয়া-দরূদ পড়, নব বেহেস্ত পাইব'। কেউ কেউ অনেক ধমকের সুরে বলেছে, 'মাইয়া মানুষ বাড়াবাড়ি করবা না, কবরে কি আছে? সে আল্লাহর কাছে গেসে, আল্লাহ যেন তারে বেহেস্ত নসিব করে এই দোয়া কর। খবরদার কবরের কাছে যাইবা না, গজব পড়ব'।
অগ্রণী বোধের বাইরে চলে গেছে, কারো আদর, ধমক, কিংবা গজবের ভয় তাকে স্পর্শ করে না। সে নিজেও হয়তো জানে না সে কত ঘন্টা ধরে এই মাটির ঢিবির দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখে জল নেই। সে ঠিক এখানেও নেই। নিজেকে কি ক্ষমা করতে পারবে সে? কোনদিন? তার এই ছোট পুতুল বোনকে সে কোন কিছু থেকেই রক্ষা করতে পারেনি। ছয়বছর আগে যেদিন সে প্রথম জানতে পারল কি ভয়ানক কষ্ট নব সাত বছর বয়স থেকে লুকিয়ে রেখেছে সে এমনি বোধশুন্য হয়ে গিয়েছিল। অগ্রণীর প্রাক্তন স্বামী নবকে সাত বছর বয়সে প্রথম ধর্ষণ করে এবং ভয় দেখায় যদি কাউকে কিছু বলে অগ্রণীর ক্ষতি হবে। সেই থেকে শুরু, সাত বছর ধরে নিয়মিত ধর্ষিত হয়েছে সে নিজের ঘরে, নিজের মা এবং বুবুর একেবারে নাকের ডগায়। অগ্রণী যেদিন জানতে পারে সেদিনই এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু আইনের আশ্রয় সে নেয়নি। কেন নেয়নি? সে কি ভীত? সে কি লজ্জিত? সে কি অপারগ? অসহায়? কেন সে নেয়নি? কেন ছোট নব মাত্র বিশ বছরের জীবনের তের বছর এই নরক যন্ত্রণা ভোগ করে গেল?
অগ্রণী এই কবর থেকে কোনদিন সরতে চায় না, সে জানে না নব যে বিচার চাইতেই পারল না কোনদিন এই গ্লানি সে কি করে বয়ে বেড়াবে?
এ কোন গল্প নয়, এটা সত্য ঘটনা, অগ্রণী আমার বন্ধু। নব’র মৃতুর পর কি করে এই অপরাধের বিচার চাওয়া যায় আমরা জানি না। আমরা আইন জানি না, আমরা আইনি সহায়তা চাইলে ভোগান্তির শিকার হই। যখন নব, শাজনীন, তনু, রিশা, খাদিজা হয়ে পত্রিকার পাতায়, টিভি নিউজে আসে আমরা আহত হই, রাগে ফেটে পড়ি, আমরা ঘৃণা জানাই, বিচার চাই এবং বিচার না পাওয়া নিয়তি ধরে নেই। কিন্তু যখন নব আমার বোন হয় আমি জানি না আমার কি করণীয়!
আমার অনেক প্রশ্ন। যে শিশু বানান করে পড়া শিখছে সে প্রতি পদে পদে আমাদের প্রশ্ন করে, এটা এমন কেন, ওটা অমন কেন? কেন এই শিশু ধর্ষিত হয়ে প্রশ্ন করে না? কেন শিশু প্রশ্ন করে না আমাকে হাঁটু ঢাকা, হাতাওয়ালা জামা পরতে বল তুমি, কিন্তু যখন আমার জামা খুলে আমাক নগ্ন করে আমাকে ধর্ষণ করে যায় তার বেলা? তখন কেন তুমি আমাকে চুপ করে থাকতে বল? কি করে একজন শিশু এটা লুকিয়ে রাখা শিখে? যে শিশু মেঝেতে পড়ে গেলে কেঁদে বাড়ি মাথায় করে ফেলে সে কি করে ধর্ষিত হয়ে চুপ করা শেখে? কে শেখায়? কেন আমার বোন, কিংবা বান্ধবি ছোটবেলায় যৌন নির্যাতনের স্বীকার হল নিজের ঘরে নিজের মানুষের দ্বারা এবং বছরের পর বছর লুকিয়ে রাখল? কেন? আমাদের কত শাসন, কত আদব-কায়দা! কোথায় আমাদের সেই আদব-কায়দা আর শাসন যখন নব নিজের ঘরে ধর্ষিত হয়, কেন অগ্রণী বিচার চাইতে পারে না? এই শিশু যৌন নির্যাতন তো শুধু মেয়ে শিশুতে সীমাবদ্ধ নয়, ছেলে শিশুরাও নির্যাতিত হচ্ছে, মেয়েদের এবং ছেলেদের দ্বারা ছেলে-মেয়ে শিশু নির্যাতিত হচ্ছে। যে সমাজ সমপ্রেমে বিশ্বাস করে না সে সমাজে পুরুষ এবং মহিলা দ্বারা ছেলে এবং মেয়ে শিশু নির্যাতিত হচ্ছে এবং সমাজ তা অবলীলায় ঢেকে রাখছে শত বছর ধরে। আমরা আমেরিকার ইলেকশন নিয়ে আলাপ আলোচনা করে অনেক জ্ঞান অর্জন করে ফেলি কিন্তু ঘরের ভিতরে নিজের শিশুকে রক্ষা করার জ্ঞান অর্জন করি না, কখনই করি না। আমরা হাঁটু ঢেকে রাখতে শিখাই, চুল ঢেকে রাখতে শিখাই, হাত ঢেকে রাখতে শিখাই, এবং সব ঢেকে রাখার পর কেউ যেদিন বাহুবলে সব ছিঁড়ে ফেলে ধর্ষণ করে যায় আমরা তাও ঢেকে রাখতে শিখাই।
অগ্রণীর সাথে আমার পরিচয় নব’র মৃত্যুর কয়েক বছর পরে। নব’র কথা জানতে পারার পর আমি হতবিহবল হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কি করণীয়? আইন কি বলে? কার কাছে জানতে চাইব? নব মৃত, কি করে প্রমাণ হবে? আমি জানি না, আমি আইন জানি না। আমরা কেউ আইন জানি না, বনানীর মেয়ে দুটো ধর্ষণের একমাস পরে মামলা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে, নব কি করে ন্যায় বিচার পাবে?
আমার ছোটবেলার বান্ধবির সাথে নব’র প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারলাম সেও অনেক অল্প বয়সে নিজের একাধিক নিকটাত্মীয় দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে। দশ বছর বয়স থেকে সালোয়ার কামিজ পরে সে, ওড়নাসহ। তার চাচা তাকে কেরাত বেত দিয়ে মারতো যদি সে পায়জামা না পরতো, মায়ের সামনেই মারতো। সে খুব বেয়াদবি করতো চাচার সাথে, তখন মা’ও চড় লাগাতো। মার খেয়ে সে আরো বেয়াদবি করতো। চাচাকে দু’চোখে দেখতে পারতো না, চাচা ঘরে আসলে মায়ের রুমে এসে বসে থাকতো। রোজ মার খেতো, রোজ বেয়াদবি করতো।
অনেকের সাথে বেয়াদবি করতো সে; চাচাত ভাই, ফুফাত ভাই, ফুফা, এমন অনেক। তার বেয়াদবি মাত্রা ছাড়া ছিল, পুরা দাদাবাড়ি তাকে চরম বেয়াদব হিসেবে জানে। উনিশ বছর বয়সে তার বেয়াদবি এত বেড়ে গেল যে সে দাদাবাড়ির কেউ ঘরে ঢুকলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে ফেলে। মায়ের থাপ্পড়ও তার চিৎকার থামাতে পারে না। একদিন সে তার বড়বোনের কাছে খুলে বলে কেন সে এদের কাউকে সহ্য করতে পারে না। ছোটবেলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন তাকে যৌন হয়রানি করেছে। যখন থেকে সে বুঝতে শিখেছে সে এদেরকে ঘৃণা করেছে, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারেনি, যত মার খেয়েছে তত জিদ আর ঘৃণা বেড়েছে, এবং যে চাচা কেরাত বেত দিয়ে মেরে মেরে পায়জামা পরা শিখিয়েছে সেও মা না থাকলে গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করেছে!!! মায়ের কাছে একথা খুলে বলার পরে মা অনেক কেঁদেছে এবং ক্ষমা চেয়েছে। বিচার চাইতে পারেননি কিন্তু মেয়ে যেসব আত্মীয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তাদের তার বাসায় প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে।
আজকাল অনেক নারী-পুরুষ ফতোয়া দেন ইসলাম মেনে চললে মেয়েরা ধর্ষিত হত না। সৌদি আরবের মেয়েরা কেন ধর্ষিত হয়? এদেশ থেকে যে নারী শ্রমিক আমরা চালান করে দেই তাদের অভিযোগগুলো পড়ে বা শুনে দেখার বোধ কোনদিন কি এইসব ফতোয়াবাজদের হয়েছে? বারো হাত কাপড় আমাকে রক্ষা করবে ধর্ষকামী পুরুষের হাত থেকে? কাপড়ের কি শক্তি? চারতলা করে হিজাব পেঁচানোর পর গাঢ় মেকাপের পিছে যে সময় তুমি ব্যয় কর সেই সময়ে একটু আত্মরক্ষার কিংবা নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবার জন্য ব্যয় করে দেখ। আজকে পর্যন্ত তুমি শাজনীন কিংবা তনু হওনি বলে কালকেও হবে না একথা তোমাকে কে বলে দিল?
লেখক: গবেষক