মুখ ফেরান ক'দিন ফেরাবেন!
প্রকাশ : ১৩ মে ২০১৭, ২১:৩০
ক'দিন ধরে নিজের সাথে যুদ্ধ করছি, কি লিখি, কি বলি। আর লিখতে না পারায় অন্য কোন কাজে মনও দিতে পারছি না। আজ একজন ধর্ষকের জন্মদাতা দিলদারের নির্লজ্জ আস্ফালন শুনে বুঝলাম কদিন ধরে যে কথাটা বলছি আর ভিতরে ভিতরে উপায় খুঁজছি সেটাই ঠিক। আসলে এ সমাজ, আমাদের পরিবারগুলোই ধর্ষক তৈরি করছে।
শিশু, নারী ধর্ষণ একটা নৈমিত্তিক খবর হয়ে উঠেছে আমাদের মিডিয়ায় আর সামাজিক যোগাযোগে। প্রতিদিন ঘরে বাইরে অসংখ্য নৃশংস, অমানবিক ঘটনা ঘটছে সারাদেশে। কয়েকটা মাত্র আমরা জানতে পারি। বেশির ভাগই সামাজিক বাস্তবতায় ধামাচাপা পড়ে যায়। নয় মাসের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা কেউই বাদ যায় না। যৌনাঙ্গ কেটে হলেও চরিতার্থ করতে হবে পাশবিক উন্মত্ততা! ধিক এ মানব জন্ম।
পুরুষ, পৌরুষের বদৌলতে নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসাবে তার লালসা মেটানোর অধিকার মনে করে মানসিক, শারীরিক, যৌন নানা রকম নির্যাতন অহরহ চালিয়ে যাচ্ছে ঘরে, কর্মস্থলে, রাস্তায়, বিদ্যাপিঠে সর্বত্র। সব পুরুষই কি এমন! হয়তো না। আবার কোন কোন নারীও কি এমন ঘটনার মদদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দিচ্ছেন না?
আমরা প্রতিদিন বিভিন্নভাবে ধর্ষণের বিচার চাইছি, ধর্ষকদের উপযুক্ত শাস্তি চাইছি। নিশ্চয়ই এধরনের ঘৃণ্য অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে এ কাজ করতে সাহস পাবে না কেউ। শাম্তি হলেই এমন চিন্তা মাথায় আনতেও দশবার ভাববে এবং ভয়ে সে কুচিন্তা ত্যাগ করবে। তবে, বিচারের পাশাপাশি এধরনের অমানবিক, নোংরা, নৃশংস মানসিকতা কেন তৈরি হচ্ছে, কোথায় তৈরি হচ্ছে তা খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি।
একটি পরিবারে যখন শিশু বাবাকে দেখে তিনি মাকে সম্মান করছেন, তখন সে নারীকে সম্মান করতে শেখে। আর প্রতিদিন যদি মাকে প্রতিপদে বাবার কাছে নিগৃহীত হতে লাঞ্ছিত হতে দেখে, বাবার ব্যাভিচার দেখে বড় হয় তখন তার কাছে সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। সেই কু-শিক্ষাই হবে তার আদর্শ। যেমন ধর্ষকের জন্মদাতা দিলদারকে পুত্রের সাফাই গাইতে শুনলাম আজ -'পুত্রের বয়সী ছেলেরা দুষ্টুমি করে ধর্ষণ করে। তিনি নিজেও করেন!'
প্রতিটি পরিবারে বাবা মা যদি শৈশব থেকে সন্তানকে শেখান নারীকে তথা মানুষকে সম্মান করতে হয় তাহলে সে অমানুষ হতে পারে না। শিশুদের নারী পুরুষ নয় মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে। বাড়িতে কন্যা ও পুত্র দুই শিশুকেই সমান সুযোগে, সমান সম্মানে বড় করতে হবে। পরিবারের শিক্ষাটি বড় জরুরি।
আমাকে, আপনাকে নিয়েই সমাজ। আমরা যদি পরিবারে নারীর সম্মান নিশ্চিত করতে পারি তবে গোটা সমাজটিই নারীকে সম্মান করবে। নারীকে মানুষের মর্যাদা দিতে হবে। মানুষ হিসাবে সম্মান, মর্যাদা দিতে যদি ব্যর্থ হয় সমাজ, তবে নারীর সময় এসেছে সে সম্মান মর্যাদার অধিকার কেড়ে নিয়ে মানুষ পরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার। প্রতিটি নারীর উচিত নিজের এবং অপরের নারী সত্তাকে সম্মান করা। তবেই সমাজে আমরা আমাদের অধিকারের স্থানটি অর্জন করতে পারবো। মনে রাখতে হবে, একজন নারী ধর্ষিত হচ্ছেন মানে সমাজের রাষ্ট্রের প্রতিটি নারী ধর্ষিত হচ্ছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী নেত্রী, স্পিকার, শিক্ষক, সাধারণ মা, বোন স্ত্রী যেই হোন না কেন।
সমাজে নারীর সম্মান না থাকলে যেমন প্রত্যক্ষ নির্যাতন বাড়ে তেমনি নির্যাতনের পর যে উপহাস, তাচ্ছিল্য, ধর্ষণের আর ধর্ষকের পক্ষে যুক্তি, নারীর বেশভূষা চালচলনের প্রতি কটাক্ষ বাড়তে থাকে। এসবই সেই কু-শিক্ষারই ফল। যে কুশিক্ষার কারণে থানার পুলিশ ৭২ ঘন্টা লাগায় অভিযোগ নিতে। যে কুশিক্ষার ফলে রক্ষক পুলিশ ধর্ষিতার পিতাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। আইনজীবী ধর্ষকদের পক্ষে আইনী লড়াই লড়ে।
কাটাতে হবে সামাজিক মানুষের উদাসীনতা। মানুষ সে কেমন মানুষ, যার হৃদয় আরেকজনের দুঃখে কষ্টে কাঁদে না? প্রতিদিন খবরের কাগজে ধর্ষণের খবর বের হয় আমরা আর দশটা খবরের মতো দেখি, পাশে সরিয়ে বিনোদন সংবাদ পড়ি সোৎসাহে। শাহবাগে, প্রেসক্লাবে, রাজু ভাস্কর্যে নানান সংগঠনের আয়োজনে চিৎকার শুনে গাড়ি বা রিক্সা থেকে অসীম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নেন। মুখ ফেরান ক'দিন ফেরাবেন! আপনিও একজন নারী বা নারীর বাবা মা, নারীর ভাই বোন, বা শিক্ষক, বন্ধু, প্রেমিক বা স্বামী। যেদিন আপনার প্রিয়জনের শরীরে ধর্ষক কামড় বসাবে সেদিনই বুঝবেন আপনি ধর্ষিতার গ্লানি। সেদিনও শাহবাগে প্রেসক্লাব আর রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়ানো এই পাগলরাই আপনার পাশে থাকবে। আজ আপনি এ প্রতিবাদে এসেছিলেন কি না ভাবতেও যাবে না তারা। কিন্তু আমার একটি কথা বলার আছে সমাজটাকে বাসযোগ্য করতে আমাদের সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। একা বা অল্প কয়েকজনের চিৎকার রাষ্ট্রের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদই পারে এই সব শক্তিশালী প্রভাবশালী ধর্ষক বা নিকৃষ্টজীবদের প্রতিহত করতে। আমরা যারা আন্দোলন করছি তারা যদি সত্যিই দেশের সমাজের উত্তরণ চাই তবে একাত্ম হয়ে আন্দোলনটা জোরদার করি। বিভিন্ন বিভক্তি বিপরীত শক্তিকেই জয়ের পথে এগিয়ে দিচ্ছে।
ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক এবং আসুন ধর্ষক সৃষ্টির কারণ উদঘাটন ও তার প্রতিকার করে সমাজ ও রাষ্ট্রকে নারী, শিশু তথা মানুষের নিরাপদ আবাসে রূপান্তরিত করি।
লেখক: সহ সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী