ধর্ষণ: ন্যায় বিচারের স্বার্থে জানতে হবে
প্রকাশ : ১০ মে ২০১৭, ০২:২১
এই মুহুর্তে সামজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় ধর্ষণের শিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। অপরাধীচক্র প্রভাবশালী পরিবারের সন্তান। তার উপর ধর্ষিতা ছাত্রীদ্বয় মামলা করেছেন এক মাসেরও পর। টানা দুইদিন যুদ্ধ করে তবেই থানা পুলিশ মামলা নিয়েছে দয়া করে। লোকলজ্জা ও আতঙ্কে বিচার চাইতে দেরি হয়েছে উল্লেখ করেছেন, তবে নির্যাতনের শিকার হলে আইন তাকে সুরক্ষা দিতে বাধ্য। অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়া তাদের অধিকার। ধর্ষণের শিকার নারী মাত্রই জানেন কি তার যাতনা, আমরা ধারণা করতে পারি কেবল। শরীরের উপর যতোটা না অত্যাচার হয়, মানসিক যন্ত্রণা হয় তার হাজার গুণ বেশি। তবে কিছু অজ্ঞতার কারণে পার পেয়ে যেতে পারে দুশ্চরিত্রের কতিপয় মানুষরূপী পশু।
অনুমতি বা সম্মতি ছাড়া একজন লাইসেন্সধারী পতিতা কেন, আপনার বৈধ স্ত্রীর সাথেও আপনি যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন না। আইন আপনাকে এই অধিকার দেয়নি। ন্যায় বিচারের স্বার্থে ও অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে সুবিচার নিশ্চিত করার নিমিত্তে কিছু বিষয় নারী পুরুষ সবাইকে জানতে হবে। বাংলাদেশে এই অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়ার বিধান পর্যন্ত আছে। আইনের ফাঁক ফোঁকর গলে অপরাধীদের বের হয়ে যাওয়ার অনেক উদাহরণ হয়তো আছে, তবে মনে রাখতে হবে আইনের চোখ অন্ধ! আদালত প্রমাণ চাইবে। পরিপূর্ণভাবে দোষী সাব্যস্থ বা প্রমাণে ব্যর্থ হলে একজন অপরাধী ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধ করলেও লঘু শাস্তি পেয়ে বেরিয়ে আসতে পারে। ইদানিং এই বিষয়গুলো আলোচিত হচ্ছে, মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন তাদের মানবীয় অবস্থান থেকেই, কিন্তু আমি আপনাদের অনুরোধ করবো এই অপরাধের আইনগত বিষয় সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা রাখার জন্য।
কিছুদিন আগে এক শিশু কন্যা ধর্ষণের শিকার হলেও বিচার চেয়ে না পেয়ে অভিমানী পিতা নির্যাতিত কন্যাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দিয়েছেন। ব্যাক্তিগত জীবনে আমিও দুই কন্যার বাবা, বুঝি একজন বাবার যন্ত্রণা। সম্প্রতি তারকা থেকে শুরু করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তিবর্গের পরিবারের দিকেও আমাদের অভিযোগের আঙুল উঠছে, কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কখনো কখনো নির্বিকার!
তাই আসুন আইন সম্পর্কে একটু ধারণা নেই। বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ও বিধিমালায় যেসব ক্ষেত্রে এই অপরাধ সম্পর্কে উল্লেখ আছে, সেগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
১. নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩)
২. দণ্ডবিধি, ১৮৬০
৩. সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২, ৪. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬০
দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলা যায়,
সেগুলো হলো—
ক. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে
খ. নারীর সম্মতি ছাড়া
গ. মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে
ঘ. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ওই নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে।
ঙ. নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। অর্থাৎ ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
আমাদের দেশে ধর্ষণের শিকার হলেও সামজিক, পারিবারিক ও লোক লজ্জার ভয়ে অনেকেই চেপে যান, থানা পুলিশ করেন না। এটা সত্য আমাদের সমাজ এখনো এতোটা উদার নয়। সেখানে পুরুষের অপকর্মের চেয়ে ভিকটিম নারীর চরিত্র হননেই অধিক সময় ব্যায়িত হয়। এই সুযোগে ব্যাহত হয় ন্যায় বিচার। এই ধরণের ঘটার পরে যে কাজগুলো অবশ্যই করা উচিত তা হলো-
প্রথমতঃ ধর্ষণের শিকার হলে সাথে সাথেই এমন কাউকে এ বিষয়ে জানানো, যাকে বিশ্বাস ও ভরসা করা যায় এবং যত দ্রুত সম্ভব থানায় এজাহার দায়ের করা।
দ্বিতীয়তঃ ধর্ষণের প্রধান আলামত নির্যাতিত নারীর শরীর। তাই মেডিকেল বা ডাক্তারী পরীক্ষার আগ পর্যন্ত কিছুতেই গোসল করা যাবে না। শুধু মেডিকেল পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে ধর্ষণের শাস্তি দেয়া যায়। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের সময় যে পোশাক পরা ছিল তা ধোয়া যাবে না। এটিও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। পরিধেয় কাপড় পলিথিনে নয় বরং পেপার বা কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রাখলে ভালো হয়।
তৃতীয়তঃ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় এজাহার দায়ের করতে হবে। এবং মেডিকেল পরীক্ষাও খুব দ্রুত করতে হবে। কারণ ঘটনা ঘটার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা না করালে অনেক আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
উল্লেখ্য যে, ডাক্তারী পরীক্ষা থানা পুলিশের ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে করা হবে। এখন প্রায় প্রতিটি থানায় ওয়ান স্টপ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার আছে।
এখানে একটা বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এই অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ায় নির্যাতিতা নারীই হলেন প্রধান সাক্ষী, তাই ভয় ভীতির পরোয়া না করে যা ঘটেছে ঠিক তাই বলতে হবে আদালতে, এক্ষেত্রে বিপক্ষের আইনজীবী আপত্তিকর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেও পিছিয়ে আসা ঠিক হবে না, এতে লাভবান হবেন অপরাধী।
এবার দেখা যাক ধর্ষণের শাস্তি কোন আইনে কি-
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে—
ধারা ৯(১): কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও তাকে দেয়া যেতে পারে।
ধারা ৯(২): ধর্ষণের ফলে বা ধর্ষণের পরে অন্য কোন কাজের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষণকারী মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করবেন। এছাড়াও তাকে এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ৯(৩): একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে এবং ধর্ষণের কারণে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে তাহলে ধর্ষকরা প্রত্যেকেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়াও তাদেরকে অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
ধারা ৯(৪): যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে
(ক) ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
(খ) যদি ধর্ষণের চেষ্টা করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
ধারা ৯(৫): পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোন নারী ধর্ষিত হলে, যাদের হেফাজতে থাকাকালীন উক্ত ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ উক্ত নারীর হেফাজতের জন্য সরাসরি দায়ী হবেন। এবং তাদের প্রত্যেকে অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল: নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য সরকার প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নামক বিশেষ আদালত গঠন করেছে। ধর্ষণের বিচারও এই ট্রাইব্যুনালে হবে।
ধর্ষণ এমন একটা অপরাধ, যার ক্ষতিপূরন করা সম্ভব নয় কোনভাবেই, সমঝোতা হওয়াটাও অবাঞ্ছিত, অপ্রত্যাশিত। কিন্তু প্রায়ই শোনা যায় গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করা হয় এই ধরনের অপকর্ম পর্যন্ত, কিংবা বিয়েও দিয়ে দেয়া হয়। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে, নারীর অবস্থা আরো শোচনীয়। এমনকি ধর্ষণের চিত্র ধারণ করে তা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ইন্টারনেটে, মুঠোফোনে বা ইউটিউবে। নারীর প্রতি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে না পারলে ভয়াবহ সামজিক বিপর্যয় আসন্ন। তাই আইন জানুন ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে এগিয়ে আসুন। মনে রাখবেন একজন সুপুরুষ কখনোই কাপুরুষের মতো ধর্ষক হতে পারে না। আপনার বুকে হাত রেখে বলুন আপনি কাপুরুষ না সুপুরুষ।
লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী