আমরা কি তবে পচে গেছি?

প্রকাশ : ৩০ এপ্রিল ২০১৭, ২২:৩৩

(১)

আমি কি তবে আমার দেশকে নিয়ে আমার দেশের মানুষকে নিয়ে আর অহংকার করতে পারব না? আমার সামনে কখনো কেউ যদি বাঙালির জাত তুলে কখনো কিছু বলে আমি খুব আবেগ আক্রান্ত হয়ে পড়ি। ক্রোধে উত্তপ্ত হয়ে যাই। এমনও হয়েছে কান্না চলে এসেছে বা কাউকে মারতে উঠেছি। কেননা আমি সবসময়ই মনে করেছি এই দেশে আমরা সকলেই শেষ বিচারে মানুষ হিসাবে ভাল। কিছু মন্দ লোক আছে আমাদের মধ্যে, তবে আমাদের কালেকটিভ মরালিটি অন্য যে কোন দেশের মানুষের চেয়ে কোন অংশে কম না। আমার এই ধারণাটা এতো প্রবল ছিল যে একেকসময় আমার মনে হতো আমি কি তবে উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে গেছি?

আমাদের সকলের, মানে কিনা বাঙালিদের, কালেক্টিভ মরালিটি নিয়ে এখন কি আর অহংকার করার মতো অবস্থা আছে? আমার ভয় হচ্ছে। আমরা কি জাতি হিসাবে পচে গেছি? গত কয়েক বছর ধরে আমার অহংকারের ভিত্তি নড়ে উঠেছে। চারপাশে নানারকম ঘটনা ঘটে যেগুলি যে কোন বিচারেই অনৈতিক কাজ, খুবই নিচু ধরনের কাজ। সেইসব ঘটনা নিয়ে তো আমরা উদ্বিগ্ন হইই। কিন্তু এইসব ঘৃণ্য ধরনের ঘটনার চেয়ে এইসব ঘটনায় মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে আমার ভয় লাগছে এখন। তবে কি আমরা সত্যিই পচে গেছি?

দুইটা ঘটনা এখানে বলি। একটি আট বছরের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সমাজের মাতব্বররা সালিশে বসেছে। সালিশে ওরা রায় দিয়েছে মেয়েটির বাবাকে ধর্ষক এক হাজার টাকা দিয়ে দিবে, ব্যাস মামলা মিটমাট হয়ে গেল। অসহায় পিতা তার লাঞ্ছিত শিশু কন্যাটির হাত ধরে ট্রেনের নিচে শুয়ে পড়েছেন। এটা নিয়ে ফেসবুকে বেওকুফ বেআক্কেল ধরনের কিছু ছেলেপিলে নানারকম স্ট্যাটাস দিচ্ছে বটে, কিন্তু রাষ্ট্রের যে পরিচালন যন্ত্র- সরকার নামক যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, সেই যন্ত্রটির বিশেষ কিছু অনুভূত হয়েছে বলে মনে হয় না।

আমাদের যে বিশাল বুদ্ধিজীবী সমাজ আছে, আমাদের যে বিশাল মিলিটারি বাহিনী আছে, আমাদের যে বিশাল পুলিশ বাহিনী আছে- এনারা সকলেই ব্যাস্ত, এদের নানানরকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এনাদের সময় নেই এইসব নিয়ে কিছু বলার বা করার।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও খুবই খুবই বিব্রতকর। একজন লেখক, লোকে খুব আলোচনা করছে ওকে নিয়ে, তিনি এক খবরের কাগজে সাক্ষাৎকার দিয়ে তার প্রেম ও প্রেরণার ঘটনা বলেছেন। তার প্রেম ও প্রেরণার উৎস একটি শিশু, ক্লাস টুতে পড়া একটি শিশু। এই শিশুটি যখন ক্লাস টুতে পড়ে এই লেখকবাবু তখন ওর স্কুলের হেডমাস্টার। বিবমিষা উদ্রেক হয়নি আপনার? এই ঘটনা খবরের কাগজে পড়ে আমাদের দেশের কেউ বমি করেছে বলে শুনিনি।

(২)

ধর্ষণ তো সব সমাজেই হয়। সব সমাজেই কিছু মানুষ অসুস্থ থাকে, কিছু মানুষ অপরাধ করে। এইধরনের এবোমিনাল ধরনের অপরাধও অন্যান্য দেশে মাঝে মাঝেই হয়। কিন্তু কোন দেশেই এই ধরনের ঘটনাকে একটি সহজ স্বাভাবিক অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয় না। কোন সভ্য দেশেই সম্ভবত সামাজিক বিচারে একটি আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অপরাধকে সামান্য কয়টা টাকা দিয়ে সেটল করার কথা বলবেন না। এই ঘটনা আমাদের এখানে হয়েছে।

এইখানেই ভয়, এইটা নিয়েই বলছি। অপরাধী অপরাধ করবে, কিন্তু সমাজের অন্য মানুষেরা তো এটাকে নিন্দা করবে, নাকি? একটি আট বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করেছে একটি লোক, আর দশজন লোকে বসে এর বিচার করছে। আরে ঐ খবিসকে তো কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলার কথা। মানুষের লাথিতেই ওর ঘটনাস্থলেই মরে যাওয়ার কথা। ঝাঁটা দিয়ে পিটিয়ে ওর চৌদ্দ গুষ্টিকে পিঠের ছাল চামড়া তুলে দেওয়ার কথা। না। মুরুব্বীরা বসে বেশ গম্ভীরভাবে বিচার বিবেচনা করে রায় দিয়েছে, বাচ্চার বাপকে এক হাজার টাকা দিয়ে দে।

নিতান্ত নারীর বিপক্ষেই কথাটা যায় বলে বলতে পারছি না। নাইলে আমি সেখানে থাকলে ঐ মাতব্বরগুলিকে বলতাম আমি তোদের একেকজনকে দশ হাজার করে টাকা দিব, বিনিময়ে...। এই সব কয়টা মাতব্বর টাকার জন্যে ওদের মেয়ে বৌকে বেচতে পারে। টাকার অংক কম বা বেশী হবে হয়তো। এদের তুলনায় ঐ হতভাগা বাপটা কতো বড়! প্রাণ দিয়েছে।

এবং এইটা কিন্তু কেবল যে ঐ একটা গ্রামের চিত্র সেটা তো না। সারা দেশের চিত্রই এটা। একটা ধাড়ি বয়সের লোক, ইশকুলের হেডমাস্টার, ক্লাস টুতে পড়া একটা শিশুকে দেখে ওর মনে আপত্য স্নেহ জাগার কথা। নিতান্ত পারভার্ট না হলে ওর মাথায় প্রেম বা কামভাব আসবে কি করে? আর বদমাশটা সেটা আবার ফলাও করে খবরের কাগজে ইন্টারভিউ দিয়ে বলেও! ঐ কাগজের অফিসেই ওকে মাটিতে ফেলে জুতাপেটা করা হল না কেন বদমাশটাকে?

যেটা বলেছি, একজন দুইজন মানুষ মন্দ কাজ করবে, একজন দুইজন মানুষ অসুস্থ থাকবে। কিন্তু দেশের বেশিরভাগ মানুষ তো সুস্থ থাকবে, নাকি? বেশিরভাগ মানুষ তো এইসব লোককে এদের ঘৃণ্য কাজের জন্যে শায়েস্তা করতে চাইবে। নাকি? দেশের বেশিরভাগ মানুষ যদি এইরকম খারাপ মানুষকে সহ্য করে, এইধরনের অসুস্থ অপরাধকে স্বাভাবিক বলে মনে করে, তাহলে দেশের কালেক্টিভ মরাল স্ট্যান্ডার্ড কোথায় গিয়ে ঠেকল? বিবেচনা করেন।

(৩) 

আমরা কি তবে পচে গেছি? আমরা কি আমদের কন্যা শিশুকে একটা ছাগল বা লাউতা বা কলাটা বা পিতলের ঘড়াটার মত একটা তুচ্ছ পণ্য বিবেচনা করছি? আমরা কি তবে সবাই মিলেই ভাবছি যে আমাদের একটা শিশু কন্যাকে কেউ অত্যাচার করবে আর ছাগল চুরি বা লাউ চুরির মত ধরা পড়লে কয়টা টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে রেহাই পেয়ে যাবে?

আমরা কি তবে সেই অন্ধকার জমানায় চলে গেছি যখন নারীশিশুকে বুড়ো ধাড়িরা লালসার জন্যে কিনে নেবে? আমি কি তাহলে আর আমার সম্প্রদায়, বাঙালি নামক এই জাতিটিকে নিয়ে আর অহংকার করতে পারবো না? আমার জাতিটি কি তবে আসলেই একটি নিতান্ত অসভ্য জাতিতে পরিণত হয়েছে?

সমাজ যে পচে গেছে সেটা তো আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন। আর কি ঘটনা ঘটলে আপনারা বলবেন যে সমাজটা ভাঙতে হবে? আর কতোটা মেয়ের দাম হাজার টাকা ধরে দিলে আপনারা বলবেন যে এই সমাজে চলবে না, নতুন একটা সমাজ বানাতে হবে?

না। আমি হতাশ হই না। আমি জানি আমাদের তরুণরা এইসব সহ্য করবে না। আমি জানি আমরা যতই পচে যাই না কেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা এটা বেশিদিন চলতে দিবে না। ওরা ঠিকই এই পচা সমাজ ভেঙে দিবে। আমরা বুড়ো হাবড়ারা যা পারিনি, সেই কাজটি আমাদের ছেলেমেয়েরা করবে। নিশ্চয়ই করবে।

(৪) 

জাস্টিস হাবিবুর রহমানের একটা কথা মনে পড়ছে। ২০০৭ সনের কথা। দেশে তখন ইমারজেন্সি চলছে। আমি আর আমার স্ত্রী গেছি উনার বাসায় এক কাজে। আমাদের নানারকম কথায় দেশের অবস্থা নিয়ে হয়তো একটু হতাশা প্রকাশ পেয়েছে। শেলি সাহেব হেসে আমাদেরকে বললেন, 'দেশ নিয়ে হতাশ হবে না। দেশ যত রসাতলেই যাক না কেন, এই দেশের মানুষ ঠিকই দেশকে টেনে উপরে তুলে নিয়ে আসবে। বাঙালি একটি রেজেলিয়েন্ট জাতি, এরা ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবে।'

হাবিবুর রহমান শেলি সাহেব মারা গেছেন। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, 'আর কবে আমরা ঘুরে দাঁড়াবো স্যার?'

লেখক: আইনজীবী

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত