স্কুলছাত্রীর বিয়ে অতঃপর সাংবাদিকতা!
প্রকাশ : ১৮ এপ্রিল ২০১৭, ১২:০১
ইতিমধ্যেই আমার বন্ধুরা জেনেছেন, মেরাদিয়ার সপ্তম শ্রেনীর ছাত্রী প্রাচীর বিয়ে নিয়ে আমার উদ্যোগ। ঘটনাটি সামনে আনা আর প্রশাসনকে বাধ্য করার পরিস্থিতি আমি আগেই লিখেছি। বাহবা, সাবাস কিংবা ক্ষোভও দেখেছি। কিন্তু একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা মিডিয়া তো ওভারকাম করতে পারতো!! বিস্ময় এখানেই।। হয়নি, এটা দৃষ্টিভঙ্গির দৃঢ়তাকে দুর্বলতার আদলেই দেখলাম।
একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক বন্ধু সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দুপুর দু'টা অবধি আমার সাথে ছিলেন। প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, মেয়ের পরিবারের সাক্ষাতকার নিয়েছেন। আমিও ছিলাম। কিন্তু রিপোর্ট আসেনি। কারন বিয়েটা হয়ে গেছে।
সর্বাধিক জনপ্রিয় এক দৈনিক পত্রিকার এক সাংবাদিক আমার স্ট্যাটাস দেখে একাধিকবার ফোনে কথা বলেছেন, তারপর গিয়েছেন। এসে রিপোর্টও করেছেন। বিয়ে হয়ে গিয়েছে, বিয়ে ঠেকানো গেলো না।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন বিয়ে হয়ে গিয়েছে, কি আর করা!!
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বারবার কথা দিয়েও মোবাইল কোর্ট না করার যুক্তি বিয়ে তো হয়ে গেছে!!
বিয়ে হয়ে গেছে তাই কিছু করার নেই? কি আশ্চর্য! আমরা কি এটাকে সমবেদনাযুক্ত চেতনা ভাববো নাকি আপোষের? মেয়েটির পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর এটা কোনো যুক্তি? ভবিষ্যতে মেয়েটির সামাজিক অবস্থান যাতে বিতর্কিত না হয় তাই বিয়ে ভাঙা বা কঠোর সিদ্ধান্তটি না নেয়ার অজুহাত মাত্র।
সাঁইত্রিশ বছরের বয়স্ক একটা লোক তেরো বছরের মেয়েকে বিয়ে করার সাহসের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভয়ানক অপরাধ, তেরো কে ষোল বছর করার মধ্যেই আছে ভয়ানক চাতুরি। বিয়ের রেজিষ্ট্রশন না করার মধ্যেই আছে ভয়ানক আইন ফাকিঁ দেবার কৌশল। অথচ কি আশ্চর্য সাংবাদিকরা সেটিকে এড়িয়ে গেছেন। আমার ব্যক্তিগত সামান্য উদ্যোগ প্রশাসন তরিৎ বৈঠকি সিদ্ধান্তে কি করে আসে যে, বিবাহিত সম্পর্ককে সময় বেঁধে দেয়া? কেন অপরাধ গণ্য করে তা আমলে না নেয়া? শাস্তির ব্যবস্থা না করা?
কোনোভাবেই এটি প্রাচীর জন্য নিরাপদ ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। যারা তার জন্য ভয়াবহতম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, সেই তাদেরই বাঁচানোর একটা কৌশল, যা আমার মতে অপরাধ আর অপরাধিদের বাঁচিয়ে রাখার সহযোগিতা।
আমিও এ সমাজের বেড়ে উঠা একজন মানুষ, একজন নারী, প্রাচীর বয়সি মেয়ের মা। যখন অনবরত প্রশাসনকে চাপে রেখেছিলাম আইনী পদক্ষেপের জন্য, আমারও ভেতরে কাজ করছিলো বিয়ের জন্য আনা বড়বড় হাঁড়িতে রান্নার আয়োজন, দু'শত কার্ডের নিমন্ত্রিত অতিথিদের সরি বলা কিংবা হাজারো মরিচ বাতির আলো নিভিয়ে ফেলা কতো কষ্টের। প্রাচীর মার জন্য তা কতো অসহায়ের। কিন্তু দৃঢ়তাকে দুর্বল করিনি। সবই থামানো গেলো। শুধু পারা গেলো না অপরাধীদের শাস্তিভোগের ব্যবস্থা।
যারা করতে পারতেন, তারা সকলেই দায় সেরেছেন পেশাগতভাবে। অপরাধ আর অপরাধীদের বাঁচিয়ে যারা প্রাচীদের পাশে সত্যি দাঁড়াতে পারেন, জনমত তৈরি করতে পারেন, আইন প্রয়োগ করে উদাহরণ তৈরি করতে পারেন তাদের কমিটমেন্ট তামাশাই ঠেকলো।
আমি জানি, প্রাচীকে ইতালী পাঠানো হবে। সে হয়তো প্রথম বিমানে চড়ার আনন্দকে অভাবনীয় রোমান্সের সাথেই নেবে, বেণীগাঁথনের স্কুলের শৈশব হারিয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ পরিবেশে খিলখিল করে হাসবে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস সাঁইত্রিশ বছরের জানোয়ার যখন হামলে পড়বে তখনই শিশুটির সকল রোমাঞ্চিকতা খানখান হবে। চিৎকার করবে, ভেঙে যাবে, আহত হবে, ভয় পাবে। পাশে বাংলায়, মায়ের ভাষায় আমার মতো মাথায় হাত বুলিয়ে কেউ বলবে না, মা তোমার জন্য বিয়েটা একটা ভয়ানক শাস্তি, যা কোনো অপরাধ না করেই পেয়েছো। সেদিন যেমন বিস্ময়ে বলেছিলে, 'আন্টি আমি বিয়ে করতে চাই নি, জোর করে দেয়া হয়েছে'।
নিশ্চিতভাবে বলতে পারি প্রাচীকে ইতালীতে পাঠানো একটা পাচার বৈ কিছু নয়। এ শিশু পাচার হলো সকলের সহযোগিতায় আইনী কাঠামোর মধ্যে রেখেই প্রকাশ্যে পাচার।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, ফ্যামিলি টাইস