একজন পরাধীন নারীর অঙ্গীকার
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০১৭, ১৮:০০
ছোটবেলা থেকেই স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস প্রতিটি বাঙালির মত আমার জন্যও একাধারে একটা উত্তেজনার, আনন্দের, কষ্টের, অর্জনের, এবং আবেগে আপ্লুত হবার দিন। কিন্তু বড়বেলায় এই দিনে মনে এসে ভিড় করে আরো অজস্র ভাবনা, নিজের জীবন এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে জন্ম নেয়া নতুনতর আরো অজস্র অনুভূতি।
স্বাধীন দেশে বেড়ে উঠা একজন নারী হয়েও আমি অনুভব না করে পারি না আমি স্বাধীন তো নইই, আমি মানুষও নই, বরং আমি স্বাধীন দেশের একজন পরাধীন নারী। আমার অনিচ্ছুক অধীনতা সমাজের কাছে, ধর্মের কাছে, পুরুষের কাছে। নারীর স্বাধীনতা বা সম-অধিকারের প্রশ্নে যখন ধর্মের বর্ম আর সামাজিক রীতিনীতির হাতিয়ার নিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া হয়, নারী হিসেবে আমাকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ করে উপস্থাপিত কোনো কুরুচিপূর্ণ কৌতুকে যখন সামষ্টিকভাবে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন আমারই আশেপাশের আত্মীয় বন্ধু পুরুষরা এবং নিজ মর্যাদা সম্পর্কে উদাসীন নারীরা তখন এমনটা না ভেবে আমার কোনো উপায় থাকে না।
দুঃখজনক হলেও সত্যি যে স্বাধীন এই দেশে এখনো নারীর সম-অধিকারের সার্বজনীন গ্রহণযাগ্যতাই সৃষ্টি হয়নি। নারী-পুরুষের অধিকারের মধ্যে যে আরোপিত বৈষম্য রয়েছে, তা স্বীকার করেন না অনেকেই, যারা স্বীকার করেন তাদের মধ্যেও অনেকে এর দায় নারীর উপরেই চাপিয়ে দেন- নারী নিজে নিজেকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে না, নারী আত্মনির্ভরশীল হবার চেষ্টা করছে না, নারীরাই অন্য নারীর সামনে এগিয়ে যাবার পথে বাধার সৃষ্টি করছে। এসব অনর্থক বুলি আউড়ানোর সময় নারীর সামনে এগিয়ে যাবার পথে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বাধাগুলোর কথা ভাবাই হয় না, নারীদের পারস্পরিক সহযোগিতার অভাবের পেছনে কাজ করে তাদের যে সংকীর্ণতা তার ঐতিহাসিক ও সামাজিক কারণগুলোকে তলিয়ে দেখা হয় না। দিনের শেষে এই সমাজের কাছে সবমিলিয়ে নারী ঊনমানুষই থেকে যায় যার সমস্ত অপ্রাপ্তির দায় তার নিজের, আর কারো নয়।
স্বাধীনতা দিবস এলেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দুই লক্ষ মা বোনের ‘ইজ্জত-হানি’ নিয়ে বক্তৃতায় আগুন ঝরানো হয়, কিন্তু যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ধারাবাহিকতায় লাঞ্ছিত হয়েছেন অগণিত নারী, সেই দেশের সমাজ নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য কী করেছে গত অর্ধ দশকে? যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়েছেন আমার বাবা, উঠতি বয়সের বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘর থেকে ঘরে, গ্রাম থেকে গ্রামে, এমনকি দেশান্তরে পায়ে হেঁটে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে বেড়িয়েছেন আমার মা, আত্মীয়স্বজনদের আশ্রয়ে সহ্য করেছেন নানান গঞ্জনা সেই দেশে নারী হিসেবে আমার অবস্থান কতটা সম্মানের, কতটা নির্ভরতার, কতটা স্বাধীনতার?
ধর্ষিত নারীর ‘ইজ্জত-হানি’ কথাটাতেই আমার তীব্র আপত্তি। নারীর মর্যাদাকে তার শারিরীক লাঞ্ছনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলার মধ্যেই আছে নারীর প্রতি এক গভীর অশ্রদ্ধার ইঙ্গিত। তারপরও প্রচলিত এই টার্মটা ব্যবহার করেই বলছি, দুই লক্ষ মা বোনের ‘ইজ্জত-হানি’র বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গৌরবে পৃথিবীর মানচিত্রে জ্বলজ্বল করতে থাকা বাংলাদেশে নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টি একটা সস্তা কৌতুকের ঊর্ধ্বে বিবেচিত হয় না এখনো।
ঘরোয়া আড্ডায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারী স্বাধীনতা নিয়ে যেসব কৌতুক ব্যাপক বিনোদন যোগায় তার মধ্যে একটি হলো- নারী বিধাতার কাছে পুরুষের সমান অধিকার চাইলে বিধাতা বললেন, ‘সমান অধিকার দেয়া হলো। তোমার প্রসব বেদনা উঠলে তোমার সন্তানের পিতারও প্রসব বেদনা হবে’। নয়মাসের গর্ভধারণ শেষে যখন সেই নারীর প্রসব বেদনা শুরু হলো, দেখা গেল একই সাথে প্রসব বেদনা শুরু হয়েছে গল্পের রূপান্তর ভেদে ড্রাইভারের, দারোয়ানের, অথবা কাজের ছেলের। এই গল্প শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে দেখেছি শিক্ষিত, নারী-স্বাধীনতা বিষয়ে মৌখিক সমর্থন যোগানো তথাকথিত সুশীল মানুষদেরকে, এমনকি অনেক শিক্ষিত অথচ অর্বাচীন নারীকেও।
স্বাধীন বাংলাদেশে এই হলো নারী স্বাধীনতার প্রতি মানুষের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি - স্বাধীনতাকামী নারী মাত্রেই দুশ্চরিত্র, এবং যেহেতু ঘরের চৌহদ্দির বাইরে কোনো জগত প্রকৃতপক্ষে তার নেই সেহেতু তার স্বাধীনতার দৌড়ও কাজের ছেলে, ড্রাইভার অথবা দারোয়ানের সাথে চরিত্রস্খলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নারীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এসব কৌতুকের মাধ্যেমে হেয় করা হয়, নারী-পুরুষের মধ্যকার প্রাকৃতিক ভিন্নতাকে বদলে দিতে চাওয়ার মত বাতুলতার অভিযোগে নারীকে অভিযুক্ত করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই- নারী অধিকারের আন্দোলনকে কুয়াশাচ্ছন্ন এবং অগ্রহণযোগ্য করে তোলার মাধ্যমে এর সাফল্যকে ব্যাহত করা ও নারী-পুরুষের মধ্যকার আরোপিত বৈষম্যগুলোকে আরো প্রতিষ্ঠিত করে তোলার মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের জয় জয়কার অব্যাহত রাখা।
আমাকে হতবাক করে দেয় এই বিষয়গুলো দেখতে এবং বুঝতে শিক্ষিত পুরুষদের অক্ষমতা, নাকি অনীহা? যারা এসব কৌতুককে নির্দোষ ভাবেন আমি বলব হয় তারা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী, অথবা সমগ্র নারী জাতির মর্যাদার চেয়ে নিজের অট্টহাসির অধিকারের গুরুত্ব তাদের কাছে অনেক বেশি। দুই ক্ষেত্রেই আমার কাছে তারা হাসির পাত্র। তাদের অমানবিকতা, অসৃজনশীলতা, অশিক্ষা দেখে তাদেরকে আমি ঘৃণা নয়, বরং করুণাই করি।
অনেকে আবার বলেন- নিয়ম ভাঙার নয়, নিয়ম পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করুন। কবে কোথায় কোন নিয়ম মানতে মানতে পরিবর্তিত হয়েছে? নতুন দালান গড়তে হলে পুরোনোকে আগে ভাঙতে হবে বই কী? যে দালানে আমার স্থান দাসীর উর্ধ্বে নয়, যে দালানের কোণায় কোণায় আমার স্বপ্নেরা নিষ্ফল পাখা ঝাপ্টায়, যে দালানে আমার অবস্থান বন্দীর, যেখান থেকে আমার মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও হাস্যস্পদ, সেই দালান ভাঙার চেষ্টা করে যাবো আমৃত্যু। স্বাধীন দেশের নারীদের কাছে, মানুষদের কাছে এ আমার অঙ্গীকার।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিক্ষক, নাট্যকর্মী, ও অনুবাদক