'মায়েরা এমন কি-ই-বা করে?'
প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০১৭, ০১:০৬
বিশ্ব নারী দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘বি বোল্ড ফর চেঞ্জ’। সত্যিই তাই। বোল্ড হওয়া ছাড়া এ নেতিয়ে পড়া জাতির বাঁচার রাস্তা নেই। কেউ তাদেরকে কখনো সুযোগ দেয়নি, দেবে না। এ দিনকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী কত সভা সমাবেশ হয়, আলাপ আলোচনা কত কিছু হয়। কিন্তু আমি ভাবছিলাম আমাদের সেই সর্বংসহা মায়ের জাতের কথা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার সর্ব প্রকার রীতি রেওয়াজ যাদের জিনগত হয়ে আছে তারা কতটা নিজেকে বোল্ড করতে পারবে? হ্যাঁ, সংসার, সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি অনেক বাধা। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় বাধা নিজেকে কতটা পেরিয়ে আসতে পারবে সেটা প্রশ্নাতীত। বলতে দ্বিধা হলেও তথাকথিত শিক্ষিত প্রগতিশীল আধুনিক হয়ে আমি নিজেও সে দলেরই এক সদস্য। আমি জানি। হ্যাঁ, আমি জানি আমাদের অধিকাংশই আমার দলের। নিজের ভিতরের কিছু না কিছু আমাদেরকে বোল্ড হতে আটকে দেয় প্রতিনিয়ত।
তবে আজ অন্তত আমার জীবনের কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব আর আপোষের বিষয়গুলো সবার সাথে শেয়ার করে নিজের ভেতরকার গুমটবাঁধা যন্ত্রণাগুলোকে খুন করতে চাই। হয়ত আমার মত অনেকের সাথে কোথাও মিলেও যেতে পারে।
শুরুতেই আমার অনুপ্রেরণা, সে অপরাজেয় সৈনিকের কথা না বললে আমার জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। যার কাছে আমার শেখা কি করে মাথা উঁচু করে নিজেকে দুর্বল না ভেবে মানুষের মত বাঁচতে হয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়, শত ঝড়েও না টলে লড়ে যেতে হয়, হিংস্র থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। চেনা অচেনা পথে চলতে গেলেই যার একটি কথা আমাকে বাঘিনীর মত করে দেয় “সবসময় মেরুদন্ড সোজা করে সিনা টেনে চলবে। আঘাত আসলে গর্জন করে ওঠবে”। আজ আমি আমি হয়ে ওঠার পিছনে যার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যার কথা অনেক বার বলতে গিয়েও বলা হয়ে ওঠেনি। সে আর কেউ না। আমার মা। যাকে হাজার বিশেষণে বলতে গেলেও কম হয়ে যাবে। তার কথা না বলতে পারার কারণ একটাই। যদি মেয়ে হয়ে মা’র কথা বলতে গিয়ে সুখ ঠিক আছে কিন্ত তার পাশাপাশি দু:খের অনুভুতির কথা চলে আসে আর তাতে যদি কোনভাবে নিজের অজান্তেই দেবতুল্য বাবাকে ভিলেন করে দিই!
আমার মা। একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। আর দশজন নারীর মতই ডালি ভরা স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় তার বৈবাহিক জীবন। অল্প কিছু দিনের দেখা আর জানাশোনা অত্যন্ত প্রতিভাবান সুপুরুষ আমার বাবা সুন্দর মনের এই শিল্পীটিকে মনে মনে ভালো লাগায় প্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথেই এক বাক্যে রাজি হয়ে যান বিয়েতে। পড়াশোনার মাঝামাঝি চাকরি শুরু করলেও ইচ্ছে ছিল উচ্চশিক্ষা নেওয়ার। যদিও তার অভিভাবক শিক্ষক পিতার একদমই তা ছিল না আমার জানা মতে। তাই এ সজ্জন ভদ্রলোকের সাথে বিয়ের প্রস্তাবটা তার স্বপ্ন পূরণের একটি ধাপ বলে তার মনে হয়েছিল। শুরু হলো তার স্বপ্নিল সংসারের পথে হাঁটা।
বিয়ের বছর না ঘুরতেই আদরের কন্যা সন্তান মানে আমি আবির্ভূত হলাম কোল জুড়ে। জগত ভোলা শিল্পী স্বামীর সাথে মিঠে মান অভিমান, দ্বন্দ্ব আর আরও নতুন যোগ হওয়া স্বপ্ন মানে সন্তান মানুষ করার বাসনা নিয়ে সংসার করতে করতে কোল ভরে এলো আরো দুটি আদরের ধন। একা হাতে চাকরি, সন্তান সামলানো, তাদের মৌলিক অমৌলিক চাহিদা, সংসার সামলানো, রান্নাবান্না, বাজার সদাই, সীমিত আয়ে সংসার খরচের হিসাব নিকাশ, সবচেয়ে বড় বিষয় সন্তানগুলো তিনটিই কন্যা হওয়ায় চারপাশের বিষময় ছোবল থেকে বাঁচিয়ে মানুষ করার জন্য একটু বেশি সতর্কতার সাথে লালন পালন এসব রোজনামচা কপচাতে কপচাতে এক সময় টের পেলেন তার নিজের সে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দু:স্বপ্নে মিলিয়ে গেছে। অনেক দিন বলতে বলতে সদাব্যস্ত গানপাগল বাম রাজনৈতীক বরটি বই খাতা এনে দিয়েছিল ঠিকই যে কিনা আবার প্রায়ই গান বা রাজনৈতিক কাজ কিংবা সমাজের প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে কয়েক দিনের জন্য ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে সংসার ত্যাগী হয়ে যেত। আর তাই এ সবকিছু সামলে আজ ধরি কাল ধরি করতে করতে ওগুলো অধরাই রয়ে গেছে। একসময় ওগুলোর মায়া কাটিয়ে মা নিজের অধরা বাসনাকে তিন কন্যার সাথে জুড়ে দেয়। কিন্তু সারা জীবনের স্বপ্ন, আশা, এত প্রাণ সঞ্জীবনী থাকা সত্ত্বেও ভালোবাসার জন্য জীবনের সাথে আপোষ করে নেয়।
সে হয়ত একটু সাহসী পদক্ষেপে জয় করতে পারতো তার কাঙ্খিত লক্ষ্য। এমন পরামর্শ আমিও এক সময় বুঝে না বুঝে দিতে গিয়েছি। তবে তার একটাই কথা, এতে হয়ত কচুরীপানা হয়ে ভেসে যেতাম আমরা, সন্তানরা। তবে আমার সজ্জন পিতার খানিক সুদৃষ্টি আর সহযোগিতায় ও হয়ত ডানা মেলতে পারতো। না, বাহবা নিতে আমার বাবাকে ভিলেন বানানোর কোন ইচ্ছে আছে ভেবে নেওয়ার কোন কারণই নেই। সে কখনও মা কিংবা আমাদের স্বাধীনতা খর্ব করেনি। এমনকি সে মাকে মহিলা পরিষদ এর সাথে থাকতে উৎসাহিত করত। কিন্তু আমি জানি সে তো এই পুরুষ শাষিত সমাজেরই একজন। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ সমাজ সংস্কার এর মত বড় বিষয়গুলোর কাছে সংসার, স্ত্রী, সন্তান তো কিছুই না। ওগুলো তো আছেই। চলছে চলবে। আর আমার মা’র তো এসব অজানা কিছুই নয়। তো সে কেন জেনেশুনে অশান্তি করতে যাবে? চলছে চলুক না। আপোষ।
আরেকটা গল্প যা একান্তই আমার। আপোষের। বিয়ের কিছু দিনের মাথায় মাসিক সংক্রান্ত ট্যবুর কারণে আমার শাশুড়ি মা যখন আমাকে রান্নাঘরে যেতে মানা করল সেদিন সে মুহুর্তে আমার মাথায় বাজ পড়েছিল। এরকম কিছু যে একুশ শতকের অগ্রসরমান পৃথিবীতে থাকতে পারে তা আমার অজানা ছিল। প্রতিবাদ করতে শুরু করেও অনেক কিছু ভেবে ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিলাম। সমাজ সংসারের প্রথাবিরোধী হয়ে ভালোবাসা আর নিজের দেয়া কথা রাখতে দীর্ঘ দিনের বন্ধু সহযাত্রীকে বিয়ে করে তার বাসায় গিয়ে উঠেছি মাত্র। ঝড় থামার থমথমে অবস্হার মধ্যে আবার ঝড়কে ডাকা বা তার বয়ষ্কা মাকে আবার আঘাত দিতে ইচ্ছে হয়নি। আপোষ করেছিলাম। মনে আছে স্পষ্ট তখন কেবল তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর সেও কিছু না বলে আমার চোখে না তাকিয়ে সরে গিয়েছিল। হয়ত সেও এমন পরিস্হিতিতে বিব্রত হয়ে পড়েছিল। কিংবা বুঝতেই পারেনি। সেদিন থেকে আমি নিজের কাছে, আমার আদর্শ, লড়াইয়ের কাছে সর্বোপরি পুরো নারী জাতির কাছে ছোট হয়ে গিয়েছিলাম।
জানি আমার এ গল্পগুলো নতুন কিছু নয়। আমাদের সমাজের বেশিরভাগ নারীর সাথে মিলে একাকার। এরকম আরো অনেক ক্ষেত্রেই আমরা বোল্ড হতে গিয়েও অনেক কিছু ভেবে একটু উদার হয়ে যাই। ফলে আখেরে তকমা জোটে দুর্বলের। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর এরকম অবস্হা। তাইতো সেদিন আমার হাঁটুর বয়সী এক ছেলে, যে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ এসেছে কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলে উঠে “মায়েরা এমন কি-ই-বা করে? শুধু ঘর সামলায়। সব চিন্তা, কর্ম তো বাবাদের”। আমি ওর সাথে তর্কে জড়াইনি। শুধু বলেছিলাম একথা তার মাকে বলতে। চুপ হয়ে ভাবলাম যে আমরাই তো আমাদের আদরের সন্তানদের এমন করে দেখতে, ভাবতে, বলতে শিখিয়েছি। প্রতিনিয়ত শিখাচ্ছি। আমাদের পরিবর্তন তো দূর কি বাত। আমরা টু মাচ বোল্ড হতে চাই না, সমতা চাই। ভালো তো, কিন্তু তা বলে আমাদের সুবোধ-অবোধ-নির্বোধ পিতা-ভাই-স্বামী-পুত্র নামক বালকদেরকে মানুষের মত ভাবতে শিখাতে সাহায্য তো করতে পারি। যেন তারা আমাদেরকে আমাদের প্রাপ্যগুলো বুঝিয়ে দেয়।
“আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?”
লেখক: প্রবাসী বাঙালি