মানুষ মানুষের জন্য, সমাজ বদলানোর জন্য
প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০১৭, ২৩:৫৭
“একজন সাধারণ মানুষ তার আপনজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, পরিচিত-অপরিচিত জনের নিকট সম্ভবত একবারই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একবারই তাকে ঘিরে সবার জল্পনা-কল্পনা দেখতে পাওয়া যায়। সেটা হচ্ছে মৃত্যু।”
নিশ্চিত মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এলেও তাকে ফিরে পাওয়া নিয়ে খুব একটা আবেগ-উদ্দীপনায় বিচলিত হতে দেখা যায় না, পুনঃপ্রাপ্তির আনন্দে তাকে ঘিরে কোন উৎসব হয় না!
অথচ মৃত্যুর সাথে সাথে কত উৎসব-আয়োজনে শোকের মাতমে অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলেও তার জন্য সময় ব্যয় করতে দেখা যায়। যার কিছুই তখন আর সেই সাধারণ মানুষটাকে আবেগতাড়িত করতে পারে না, এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠাও তার চোখের কোনে কয়েক ফোঁটা জল আনতে পারে না!
আমার কেন যেন মনে হয়, অন্তত এই একবার সবার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্যই অনেকে অভিমানে সুইসাইড করে ফেলে।
বারংবার প্রতিধ্বনিত অতি পুরোনো কথা-‘মানুষ বড় অদ্ভূত’!
--এমনটাই লিখেছিলাম কিছুদিন আগে। আজ শান্তা নামের মেয়েটা এমন অভিমানেই সুইসাইড করে ফেলল! কিছুদিন আগে জ্যাকুলিন সুইসাইড করেছে, ইডেনের একটা মেয়ে করেছে। জানা-অজানার এ সংখ্যার অভাব নেই।
শান্তা আজ সবার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেউ নিন্দা করছে, কেউ শোক করছে, কেউ সহানুভূতি দেখাচ্ছে, কেউ আত্মহত্যার কারণ জানতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। কিন্তু শান্তা যখন বেঁচে ছিল, যখন ফেসবুকে মেয়েটা বিষন্নতা, অসহায়ত্ব, হতাশার প্রকাশ করত লেখার মাধ্যমে তখন কি কেউ মেয়েটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল? মেয়েটা অন্ধকারের সাথে সন্ধি করেছিল। কেউ কি তাকে অন্ধকার ভুলে আলোকে ভালবাসতে শিখিয়েছিল? মেয়েটার একটা পোস্ট দেখলাম। সে লিখেছিল-“যদি আত্মহত্যা করি তাহলে মোবাইল, ফেসবুক সব বন্ধ করে করব, যাতে কেউ আলগা পিরিত দেখাতে না আসতে পারে।” তার মানে বেঁচে থাকতে কেউ তার পাশে দাঁড়ায়নি। কেউ তার কষ্ট লাঘবে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেয়নি। যদি দিত মেয়েটা সুইসাইড করতে বাধ্য হত না। একটা মানুষ সুইসাইড করার সিদ্ধান্ত শখে নেয় না। কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে করে সে যখন পরাজিত হয়ে যায় তখনই সে সুইসাইড করতে বাধ্য হয়। প্রতি মিনিটে মিনিটে মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করার চাইতে কয়েক সেকেন্ডের কষ্টকে মেনে নিয়ে মারা যাওয়াটাকেই তার কাছে তখন সহজ মনে হয়। কিন্তু তাতে কার কি যায় আসে! সবাই একদিন, দুইদিন, তিনদিন আলোচনার ঝড় উঠায়। তারপর সব শান্ত, যে যার মত! আবার আরেকজন সেই একই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে, যে নিজেও হয়তো শান্তার আত্মহত্যার জন্য শান্তাকেই বোকা, ইমোশনাল, দুর্বল মানসিকতার ভেবেছিল। আবহমান গতিতে চলতে থাকে সুইসাইডের দুষ্টুচক্র।
একজন মানুষ সুইসাইড করলে অনেকে অনেক ধরণের যুক্তি দিতে থাকে। ভালবাসার জন্য কেউ সুইসাইড করলে একদল যুক্তি দেয়-একজন মানুষই কি সব? একজনের জন্য মরে যেতে হবে? অন্য মানুষগুলো তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? হ্যান ত্যান দুনিয়ার যুক্তি।
মানুষ! মানুষ তো মানুষ। কখনো কখনো একজন মানুষই একজনের কাছে জীবনের সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যে মানুষটা এক সময় হাতে হাত রেখে বলে, দুনিয়ার সবাই তোমাকে ছেড়ে গেলেও আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না। সেই মানুষটাই যখন ছেড়ে যায় তখন দুনিয়ার সব মানুষই তার কাছে এক হয়ে যায়। তখন সে শুধু ঐ একজনের জন্যই মরে যায় না। তার কাছে পুরো পৃথিবীটাই অন্ধকার হয়ে যায়, কাউকেই তার আপন মনে হয় না। কাউকেই বিশ্বাস করতে পারে না। তখন কি আর শুধু একজনের জন্যই সে মারা গেছে এমনটা বলা যায়! বলা যায় না। তাছাড়া সে যে বার বার এভাবে প্রতারিত হয়নি তাই বা কে জানে!
আর মেয়েদের আত্মহত্যা করার প্রবনতা কেন বেশি তার হাজারটা কারণ আছে। একটু মুক্তচিন্তায় ভাবলেই কারণগুলো বুঝতে পারবেন। সহজ কিছু কারণ আমি বলছি। সব কারণ লিখতে গেলে এ লেখা আর ফুরোবে না।
মানুষের কষ্টের অনুভুতি বেশি জেগে ওঠে রাতে। একটা ছেলে যখন হতাশায় ভোগে, কষ্টে থাকে তখন সে যত রাতই হোক বাইরে গিয়ে হাটাহাটি করে আসতে পারে। বেশিরভাগ ছেলেরা সিগারেট ফোঁকে। অনেকে গাঁজা খায়, মদ্যপান করে। আরো অনেক কিছুই করে। ছেলেরাই বলে এসব নাকি টেনশন কমায়, হতাশা কাটায়, কষ্ট লাঘব করে। একটা ছেলে যেকোন সময় বন্ধুর বাসা বা মেসে চলে যেতে পারে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে কষ্টগুলোকে দুহাতে পাশে সরিয়ে রাখতে পারে। ইচ্ছে হলে সে দূরে কোথাও পাহাড়-সমুদ্রে ঘুরে আসতে পারে। কষ্টের সময়গুলোকে ব্যস্ত সময়ে, ভাল লাগার সময়ে পরিনত করতে একটা ছেলের পক্ষে যতটা সহজ একটা মেয়ের জন্য ততটাই কঠিন। একটা মেয়ে সহজেই এগুলোর কোনটাই করতে পারে না আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রতিবন্ধকতা ও কাঠামোর কারণে। আমি নিজেকে দিয়েই বুঝি। মাঝে মাঝে যখন ভীষণ হতাশায় ডুবে যাই, ইচ্ছে করে রাতের রাস্তায় সোডিয়ামের আলোয় হেটে বেড়াতে। মনে হয় এটা করতে পারলেই আমার ভালো লাগত, হতাশা কাটত। কিন্তু পারি না। কেন পারি না তা কি আর ব্যাখ্যা করতে হবে! অথচ একটা ছেলে ইচ্ছে করলেই যত রাতই হোক বাইরে বেড়িয়ে যেতে পারে, খোলা আকাশের নিচে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে। দুই চারজন বন্ধু জুটে যাওয়াও ব্যাপার হয় না। আমি চাইলেও কোন ছেলে বন্ধুকে পাশে পাব না সাপোর্ট হিসেবে। সবই সামাজিক অসুস্থ পাপ চিন্তার কারণে। অথচ আমার ইচ্ছেতে কিন্তু বিন্দুমাত্র পাপ নেই। অথচ আমার এ ইচ্ছেই হাজারটা পাপের কারণ হয়ে ওঠে এ অবুঝ সমাজের কাছে।
যন্ত্রণা তো একটা দুইটা না, যন্ত্রণা হাজারটা। একটা মেয়ে যখন মানসিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে, কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে যখন সে নিজের মত স্বাধীন জীবন-যাপন করতে শুরু করে, রাজপথে বুক উঁচু করে সহজ সাবলীল পোশাক পরে হেটে বেড়ায়, রাত-বিরাত বন্ধুদের সাথে আড্ডায় শামিল হয়, সিগারেট ফোঁকে, যখন তার বেঁচে থাকার জন্য কোন একজনের উপর নির্ভরশীল হতে হয় না, যখন তার চিন্তা-চেতনা এককেন্দ্রিক থাকে না, তখন সে আপনাদের চোখে হয়ে ওঠে বেশ্যা!
আবার যখন একটা মেয়ের জগৎ হয়ে ওঠে শুধু চার দেয়ালের মধ্যে, যখন তার চিন্তা ভাবনা একটি নির্দিষ্ট গন্ডিতে এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠে, যখন সে তার সংকীর্ণ জগৎটাতে কোন কারণে পরাজিত হয়ে সুইসাইড করে ফেলে তখন সে মেয়ে হয়ে ওঠে দুর্বল মস্তিষ্কের, বোকা, পরাজিত। হায়রে সমাজ! আর কবে তুমি অন্তর্নিহিত কারণগুলো স্পষ্ট করে বুঝতে পারবে!
আমি আত্মহত্যার পক্ষে সাফাই গাইছি না। আত্মহত্যা কখনোই কারো কাছে কাম্য হতে পারে না। আমি শুধু বোঝাতে চাচ্ছি, একটা মানুষ আত্মহত্যা করে ফেললে তাকে অপমান না করে তার আত্মহত্যার কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করুন এবং পরবর্তীতে কেউ এমন পরিস্থিতির শিকার হলে তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিন, একটু সময় দিন। যেন সে আত্মহত্যা করতে বাধ্য না হয়। আসলে একটা মানুষ নিজে যদি কোন ভয়ংকর পরিস্থিতে না পড়ে তাহলে সে কখনও আরেকজনের পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করতে পারে না, বুঝতে চায় না। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝার কথা, একটা মানুষ খুব সহজেই নিজেকে নিথর করে দিতে চায় না এটা বুঝতে হবে।
সবার মানসিক শক্তি এক রকম না।অনেকে শত কষ্ট, ঝড়-ঝাপ্টা কাটিয়ে উঠেও স্বাভাবিক জীবন যাপন করে যেতে পারে। আর যাদের কষ্ট সহ্য করার মত মানসিক শক্তি কম, একটু অভিমানী, একটু আবেগী (মনে রাখতে হবে ভালো মানুষগুলোই এ বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে) তারা কোন কষ্ট পেলে মানসিক শক্তিটুকুর সাথে শরীরের শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে, এক প্রকারের বাধ্য হয় সুইসাইড করতে। কিন্তু যদি তার আশপাশের মানুষগুলো তাকে বাঁচার শক্তিটুকু জোগাতে সাহায্য করত তাহলে হয়তো তাকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হত না।
“মানুষ মানুষের জন্য” বলে গলা ফাটিয়ে আমরা কি শুধু সারাজীবন মুখেই বড় বড় বুলি ছাড়ব? আসুন না আমরা এমন অভিমানী, আবেগী মানুষগুলোর হতাশার সময় একটু সাহায্য করি তাকে বাঁচতে, একটু বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেই, তার সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করি। আর আত্মহত্যার পিছনে এ সমাজের অন্তর্নিহিত অনুচিত কারণগুলো বদলে ফেলি।