পুরুষ হওয়া কি খুব গর্বের কিছু?
প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০১৭, ১৪:০৩
‘নারীরা কি চাইলে খাড়াইয়া মুততে পারবে? পারবে না, কাজেই পুরুষ যে অধিকার ভোগ করবে সেটা নারীরা ভোগ করার অধিকার রাখে না।’ এরকম মন্তব্য প্রতিনিয়ত শুনছি। যেন দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করা ভয়ংকর গর্বের একটি কাজ। এরকম মন্তব্যকারীরা মনে করেন, নারীরা সমানাধিকার চায় মানে হল তারা পুরুষ হতে চায়, পুরুষের মত দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে চায়। ‘নারীবাদ মানে পুরুষ হবার চেষ্টা নয়’। এধরণের মন্তব্য তাদের মুখেই শোভা পায়। প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত কেউ এধরণের মন্তব্য করলে বুঝতে হবে, তিনিও দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করার গর্বে গর্ভবতী হওয়া গ্রুপের একজন গর্বিত সদস্য। তাদের ধারণা, পুরুষ হওয়া গর্বের কিছু। তাই নারীরা শুধু পুরুষ হতে চায়। আহা! ভেবে কী সুখটাই না পায় তারা!
বাঙালি নারীর পোশাক শাড়ি। এখন সাথে যুক্ত হচ্ছে হিজাব। অথচ কিছু নারী হিজাব তো দূরে থাক, শাড়ি পর্যন্ত পরে না! পরে জিন্স, টি শার্ট! আজ্ঞে, বাঙালি পুরুষের পোশাকটি যেন কী? কে পরে ওই ধুতি,ফতুয়া,পাঞ্জাবী? কোনও মেয়ের ছোট চুল রাখা, প্যান্ট,শার্ট পরার মানে দাঁড় করানো হয়েছে, মেয়েটি পুরুষ হতে চায়। প্যান্ট শার্টকে বাঙালি পুরুষদের নিজেদের বাপদাদার সম্পত্তি ভেবে ফেলার কারণটা কী? আপনি চুল ছোট রেখে, প্যান্ট শার্টের মত ঝামেলা মুক্ত পোশাকটিকে আপনি নিজের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কেউ যদি, চুল ছোট রাখে, প্যান্টশার্ট পরে তবে সে আপনার মত পুরুষ হতে চায় না, বরং আপনার মত ঝামেলা মুক্ত হতে চায়। নিজের ভালোটা শুধু আপনিই বোঝেন এবং বোঝার অধিকার রাখেন- আপনার যদি এমন ধারণা হয়ে থাকে তবে জেনে রাখুন ধারণাটি একশ ভাগ ভুল। মেয়েরা কীভাবে চলবে, কীভাবে বলবে, প্রস্রাব দাঁড়িয়ে করবে নাকি বসে করবে, চুল ছোট রাখবে নাকি বড় রাখবে, পর্দা করবে কি করবে না-- এসব কিছু মেয়েদের উপরই ছেড়ে দিন। মেয়েরা কী করবে মেয়েদেরকেই বুঝতে দিন। ঠিক যেভাবে আপনি কী পরবেন, কীভাবে চলবেন সেটা নিজে ঠিক করে থাকেন।
নারীবাদ মানে, "এটা নয়, ওটা নয়, সেটা নয়” এসব হল নারীবাদ’কে পুরুষের নিজস্ব সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করে ফেলার চেষ্টা। বাংলাদেশের মত একটি ঘোর নারী বিদ্বেষী সমাজে নারীবাদ নিয়ে লিখতে গেলেই বলে, ‘পুরুষ বিদ্বেষী’। নারী পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা পেলে এতদিন ধরে নারীর অধিকার খর্ব করে যে রাজত্ব করেছেন সেটি আর চলবে না। ধর্ষণ করে দোষ দিয়েছেন-মেয়ের চরিত্রের, চলাফেরার, পোশাকের। পতিতাদের সাথে সমাজের বাবুরা শুয়ে পতিতাদের নষ্ট করে, বেশ্যা মাগী বানান। অথচ বাবুর চরিত্র, সামাজিক মর্যাদার কোনও হেরফের হয় না। পতিতালয় বন্ধের দাবী তুললে নির্লজ্জ ভাবে তারা জানান- ‘এতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে’। নিজেদের নষ্টামির দোষ ভুক্তভোগীর ওপর চাপিয়ে দেয়ার এ সুযোগ যারা আপনাদের দিতে চায় না, আপনাদের দৃষ্টিতে তারা নিশ্চয়ই ঘোর পুরুষ বিদ্বেষী।
মেয়েরা বড় হলে মায়েরা সাধারণত তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলে থাকেন, ‘শত হলেও পুরুষ, পুরুষ মানুষের বিশ্বাস নাই’। মামা, চাচা, খালু,ফুপা, এমনকি বাবা, ভাই দ্বারা যৌন হেনস্থার স্বীকার হচ্ছে নারীরা। এমন কোনও মেয়ে হয়তো পাওয়া যাবে না, যে তার সমগ্র জীবনে কোনও রকমের যৌন হেনস্থার স্বীকার হয় নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এটি নিকট আত্মীয়ের দ্বারা ঘটে থাকে। আমি গরমকালে বাসায় পাতলা হাতকাটা গেঞ্জি পরতাম। যা আমার মায়ের খুব অপছন্দ ছিল। ‘বাসায় বাবার সামনে এধরণের কাপড় পরতে নেই’ এই কথার উত্তরে আমি যখন বলেছি, ‘কেন? বাবা কি মাঝেমধ্যে ভুলে যান যে, আমি তার সম্পর্কে মেয়ে হই’। নিশ্চিত ভাবে আমার উত্তরটি শুনতে খুব বাজে লাগছে। যদিও বাবার সামনে, ভাইয়ের সামনে ঢেকে চলার কথাটিকে খারাপ বা বাজে কথা বলে আপনাদের মনে হয়নি। বাবা বা ভাইয়ের চোখ যদি মেয়ে বা বোনের শরীরের দিকে যায় তবে তাদের দ্বারাও ভুল কিছু হয়ে যেতে পারে-- এই ভয়েই তো মেয়েরা, বোনেরা তাদের বাবা-ভাই-নিকট পুরুষ আত্মীয়দের সামনে শরীর ঢেকে চলে।
আমাকে দেখে কেউ ভয় পাচ্ছে, আমি আছি বলে অতিরিক্ত সতর্ক হয়ে পোশাক পরছে, আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না-- এরকম কিছু আমার জন্য নিঃসন্দেহে লজ্জার। আচ্ছা, ছেলেদেরও কি লজ্জা হয়, যখন একটি মেয়ে তাকে ধর্ষক ভেবে ভয় পায়, তাকে দেখে সতর্ক হয়, ওড়না টানে? সমগ্র নারী জাতি যখন পুরুষ জাতিটিকে ভয় পেয়ে চলে, বিশ্বাস করতে পারে না, ধর্ষক কামুক ভাবে তখন পুরুষ হিসেবে লজ্জিত না হয়ে তারা কীসের গুণে গর্বিত হয়?
মনে মনে নিশ্চয়ই আপনাদের রণ সংগীতটি বাজছে, ‘সব পুরুষ এক নয়’। জেনে রাখুন, সব পুরুষ এক না হলেও, সব নারীরাই সব পুরুষকে অবিশ্বাস করে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই ৭৬টি ধর্ষণের ঘটনাসহ ৩৬৫জন নারী ও কন্যাশিশুকে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে প্রকাশিত ১৪টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
তাদের প্রকাশিত তথ্যানুসারে ৭৬টি ধর্ষণের মধ্যে ১৪ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪ জনকে, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১২ জনকে। শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ৪ জন। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫ জন। এছাড়া এসিডদগ্ধ হয়েছেন ৩ জন। অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন ৫ জন, তন্মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১ জনের। ৮ জন নারী অপহরণের শিকার হয়েছেন। পাচারের শিকার হয়েছে ৯ জন নারী ও কন্যাশিশু। এদের মধ্যে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়েছে ২ জনকে। বিভিন্ন কারণে ৬৩ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে।এছাড়া যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩১ জন, এদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ১২ জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ জন। উত্ত্যক্ত করা হয়েছে ২৩ জনকে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে ৩৩ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন এবং ৯ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। জানুয়ারি মাসে বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে ২২টি, এদের মধ্যে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে ১২ জন এবং ৩১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে ২১ জনকে। পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ০৪ জন। বে-আইনি ফতোয়ার ঘটনা ঘটেছে ২টি। এছাড়া অন্যান্যরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
ফেব্রুয়ারি মাসে মোট নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩৭৬টি। ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মোট ৭৯ টি। বিভিন্ন কারণে ৫৯ জন নারী ও কন্যাশিশুকে হত্যা করা হয়েছে। বিভিন্ন নির্যাতনের কারনে ২৫ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে এবং ০৮ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়াও প্রতিনিয়ত, রাস্তায় ঘাটে, যানবাহনে, কর্মস্থলে, নিজের ঘরে যেসকল যৌন হেনস্থা হয় সেগুলা অধিকাংশই অজানা থাকে। যৌন নিপীড়ককে রক্ষা করতে সবাই উঠে পরে লাগে, ঘটনা জানাজানি হলে মেয়ের জন্য ভালো হবে না- এই অজুহাতে চেপে যেতে বলা হয়। যেন, মেয়ের ভালোর কথা কতই না ভাবেন তারা। মেয়েদের এমন শুভাকাঙ্ক্ষী থাকলে আর শত্রুর দরকার কী?
লেখক: আহবায়ক, তসলিমা পক্ষ