ফেসবুক ইতিবাচক না নেতিবাচক?
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ২২:০১
প্রথম যখন ফেসবুক সম্পর্কে জানলাম, শুধুই নেতিবাচক কথাবার্তা শুনলাম তেমন কোন সঠিক ধারণা আসলে পেলাম না। কাছের একজনের আইডি দেখে অবশ্য সেগুলোর কোন প্রমাণ পেলাম না, বরং বেশ ভালোই লাগলো। কত পুরনো, বহুদূরে চলে যাওয়া, মানুষের সাথে যোগাযোগ করা যাবে। দুরু দুরু বুকে ছদ্মনামে একটা আইডি খুলে ফেললাম। অনেকদিন যোগাযোগ নেই এমন সব মানুষের খোঁজ পেলাম। যেহেতু তখনো নেতিবাচক বার্তাগুলোতে মাথা বোঝাই হয়ে আছে, একটু সংকোচ কাজ করছিল। কিন্তু যাদের দেখা পেলাম, তারা তো আমার ভীষণ আস্থার মানুষ, তবে ভাবনা কিসের! মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নাম-পরিচয় ঠিক করে ফিরে এলাম আপন পরিচয়ে।
'পুরনো দোকানে বিগত আড্ডা, বিগত ঝগড়া বিগত ঠাট্টা, বন্ধু, কী খবর বল, কত দিন দেখা হয় নি'- আমার মনে সবসময় তীব্রভাবে পুরনো স্মৃতি ঘুরে বেড়ায়, বলা যায় অতীতে আমি আনন্দে বিচরণ করি। সেইসব মানুষের খোঁজ পাবো, সেইসব বন্ধু, পরিচিত, তারা এখন কেমন আছে, কি করছে! ভীষণ এক ভালোলাগায় মনটা ভরে উঠলো। আগের নেতিবাচক ধারণার কারণে ফেসবুকের প্রাইভেসি সেটিংসগুলো ভালোভাবে মেনে চলি। এরমধ্যেও অল্প কিছু মেসেজ, কিছু ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেতে থাকলাম, যার উদ্দেশ্য বা বার্তাটা ঠিক ভালো লাগলো না। তবে ভালোলাগার পাল্লাটাই বেশি ভারী হলো পুরনো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে। কখনো ভাবিনি, আবার কোনদিন ওদের খোঁজ পাবো।
যে দু’একটা উল্টো-পাল্টা মেসেজ পেয়েছি, তার পরিমাণ সত্যিই নগণ্য। সেভাবে রেসপন্স না করলেই, অথবা দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেই হয়, এছাড়া ব্লক করার অপশন তো আছেই। এরই মাঝে পরিচিতদের মধ্যেও খেয়াল করলাম, অনেকেই ইনবক্সে কথা বলাটা সহজভাবে নিতে পারে না, হয়তো আমার মতই পূর্ব কোন ধারণা সমস্যা করছে। তবে আমার মনে হয় নেতিবাচক ধারণাগুলো স্থায়ী আর তীব্র হয় নিজেরাই যদি সেগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারি। সঠিক, উদার মানসিকতা এগুলো দ্রুত দূর করতে পারে। এছাড়া অনেক সহজ সাধারণ কথাবার্তা, ঘর-সংসারের খোঁজ খবর, সমানভাবে সবার সামনে আলোচনা করতে অনেকে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ইনবক্স একটা সুন্দর মাধ্যম।
আমি নেতিবাচক বিষয়গুলো একেবারেই ফেলে দিচ্ছি না। অনেকে আইডি খুলেই সেই উদ্দেশ্যে। মজা করা, অপরিচিতকে বিরক্ত করা-এসবই তাদের অভিপ্রায়। উল্টোটাও অনেকেই করছে, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, সুন্দর সম্পর্ক, নতুন বন্ধু পাচ্ছে। বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচারিত প্রসারিত হচ্ছে এই ফেসবুকের মাধ্যমে। অসংখ্য বিষয় নিয়ে লেখা-লেখি হচ্ছে। সুযোগ হচ্ছে জনমত আদান-প্রদানের।
অনেকেই খুব মিশতে পছন্দ করে, মানুষের সাথে কথা বলা, ভাব বিনিময় - অতীব সহজ হয়ে উঠেছে এই ফেসবুকের কল্যাণে। ব্যক্তি আমার কাছে এটাই ফেসবুকের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক মনে হয়। কত দ্রুত আর সহজেই আরেকজনের খোঁজ নিতে পারছি। আর লেখালেখির জগতে তো একটা বিপ্লবই ঘটে চলছে, কতজন লেখার হাত পাকিয়ে ফেললো এখানে লিখে লিখেই।
আর এইসব ক্ষেত্রেও আমরা আমাদের নিজেদের পরিচয় রাখছি, নিজেরা বেছে নিচ্ছি, কিভাবে আমাদেরকে প্রকাশ করবো! কেউ কেউ তাদের মননশীলতার পরিচয় দিচ্ছে, তাদের বক্তব্যে, ভাষার ব্যবহারে। কেউ কেউ তাদের কদর্য রূপ প্রকাশ করছে নিঃসঙ্কোচে। আবার কত ভালো ভালো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছে, সুন্দর কিছু মানুষ একত্র হয়ে। একইভাবে কিছু ভয়ংকর ঘটনাও ঘটছে। এই ভালো আর মন্দের মিশেল কোথায় নেই! শিশু বয়স থেকে জীবনের সর্বত্রই এর বিচরণ আমরা দেখতে পাই। আমাদের শিক্ষা আর আদর্শ দিয়ে আমরা ইতিবাচক বিষয়গুলোকে বর্ধিত করি, ছড়িয়ে দেই।
ফেসবুক নিয়ে অনেকের একটা বড় অভিযোগ হচ্ছে, 'সময় নষ্ট'। সেটাও তো আমরা নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। যেকোন নেশাই তো আমার কাছে ক্ষতিকর মনে হয়। তাই নেশা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা আমাদেরই করতে হবে। খাওয়া-পড়ালেখা, অবসরের শখ কিংবা দায়িত্ব- সবকিছু আমরা যেভাবে সময় ভাগ করে প্রতিনিয়ত করে চলি, সেভাবেই ফেসবুককেও যোগ করতে পারি এই তালিকায়। কিংবা প্রতিদিনের খবরের কাগজ পড়ার মত করে। এ যুগে যখন এত এত খবরের কাগজের মধ্যে বেছে নিতে হচ্ছে, সেভাবেই আমাদের শিক্ষা আর রুচি অনুযায়ী বেছে নিতে হবে ফেসবুক থেকেও। সুযোগ এখন অনেক বেশিই, হাতের নাগালেই সবকিছু, শুধু আমাদের একটু সতর্ক হতে হবে। সতর্কতা অবলম্বনে দোষের কিছু নেই, আর এই সহজলভ্যতা আমাদের জন্য একটা বিরাট সুযোগ।
প্রযুক্তির এই যুগে এগুলো এড়িয়ে চলা দায়। উত্তর আমেরিকায়, এখন সমস্ত চাকুরীর ক্ষেত্রেই ফেসবুকের মাধ্যমে আবেদন করার একটা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আবেদনকারীকে বোঝার জন্য চাকুরী দাতাদের এটা একটা ভালো উপায়। ফেসবুকে এই সুযোগও রয়েছে যে কেউ কাছের বন্ধু, আত্মীয়, সহকর্মী- এভাবে ফেসবুককে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে নিতে পারে। নিত্যদিনের পড়ালেখার জন্যও উত্তর আমেরিকার স্কুল কলেজগুলো ফেসবুক বা এ ধরণের অ্যাপ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে। মার্ক জুকারবার্গ ফেসবুক তৈরীই করেছিলেন স্কুলের প্রজেক্ট শেষ করার জন্য।
ফেসবুকের নেতিবাচকতাগুলো দূরে সরিয়ে, এর ইতিবাচক ব্যবহার আমরাই নিশ্চিত করতে পারি। যে ছুরি, কাঁচি দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে রোগীর অপারেশনে ডাক্তার ব্যবহার করছে, সেই ছুরি, কাঁচিই আবার ছিনতাইকারী ছিনতাই এর কাজে ব্যবহার করছে। আমাদের শিক্ষা, ভাবনা সবসময় আমাদের ব্যবহারিক কাজে প্রকাশ পায়। পুরনো একটি গল্প দিয়ে শেষ করছি:
শেষ রাতের দিকে, দুজন লোক একটা পুকুরের দু’পাড় দিয়ে হাঁটছে। তাদের একজন চোর, অন্যজন প্রচন্ড ধার্মিক এক ব্যক্তি। আবছা অন্ধকারে দুজন দুজনকে দেখতে পেয়েছে। চোর মনে মনে ভাবছে, এ নিশ্চয় আমার চেয়ে বড় চোর, সবাই গভীর ঘুমে আর সে এই সুযোগে চুরি করার ধান্দায় যাচ্ছে। অন্যদিকে ধার্মিক ব্যক্তিটি মনে মনে ভাবছে, এ নিশ্চয় আমার চেয়েও বেশি ধার্মিক, আরামের ঘুম ছেড়ে নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতায় প্রার্থনা করতে যাচ্ছে।
লেখক: প্রবাসী বাঙালি