আন্দোলনের কৌশল, রাবার বুলেট-সীসার বুলেট ও বিবিধ প্রসঙ্গ
প্রকাশ : ৩০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:৩২
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি কেবলমাত্র বামপন্থীদের প্ল্যাটফর্ম নয় বা জাতীয় সম্পদ ও স্বার্থ রক্ষার প্রসঙ্গ শুধুমাত্র বামপন্থীদের রাজনৈতিক স্বার্থের বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে এই মরার দেশে এমন কোনো অ-বাম দেশপ্রেমিক বা প্রগতিশীল শক্তির অস্তিত্ব নেই যারা প্রলোভনের সামনে মাথা নত না করে দায়িত্ব নিয়ে এই আন্দোলন চালিয়ে নিতে পারে। কখনো কখনো প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বা এনজিওরা জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনে সমর্থন দেয় বটে-কিন্তু তাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ আছে। সেই স্বার্থ মিটে গেলে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে তাদের এতোটুকুও বাধে না; এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। অগত্যা, জাতীয় সম্পদ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার এই আন্দোলন বাম প্রভাবদুষ্ট হয়েই টিকে থাকছে। এখানে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে যে সাংস্কৃতিক কর্মীরা বা ইনডিভিজুয়ালরা রয়েছেন-- তারাও চিন্তা চেতনা ও চরিত্রে অনেকখানিই বাম ধারার। এই প্রশ্নে কেউ কেউ বামদের সমালোচনা করেন-বলার চেষ্টা করেন তারা কুক্ষিগত করে রেখেছেন বলে অন্যরা আসছে না। তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে বিপুল মানুষের সমর্থন আছে ঠিকই-তবে শক্তি ও সাহস নিয়ে লড়া্ই করার মত বিশেষ কোনো অংশ এর বাইরে নেই। থাকলে এতোদিনে তারা ঠিকই জড়ো হতেন- অথবা ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে জাতীয় সম্পদ রক্ষার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতেন।
বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের গ্যাস ভারতে রপ্তানির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে গ্যাস রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে তৎকালীন বিএনপি সরকারকে সরে আসতে বাধ্য করা হয়। গ্যাস রপ্তানি না হওয়ার সুফল সাধারণ মানুষ যতোটা না পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হয়েছে ব্যবসায়ী ও শিল্প উদ্যোক্তারা। কিন্তু আন্দোলন চলাকালীন বামদের বাইরে আর কাউকেই পাওয়া যায়নি। ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনি বিরোধী আন্দোলনে স্থানীয় মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছিলেন ভিটেমাটি ও কৃষি রক্ষার তাগিদে। তার মধ্যে গরীব ক্ষেতমজুর যেমন আছেন, অবস্থাপন্ন কৃষকও আছেন। ফুলবাড়ির মানুষ জীবন দিয়ে তাদের অস্তিত্ব আপাত রক্ষা করেছেন। এমনকি রামপালে কয়লা বিদ্যুৎের উন্নয়ন আগ্রাসন থেকে সুন্দরবনকে বাঁচানো গেলে তার সুফল শুধু বামপন্থীরা বা কৃষক-শ্রমিকেরা ভোগ করবেন না; শ্রেণি নির্বিশেষে দেশের আপামর মানুষই লাভবান হবে-এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
বন্ধু জিয়া হাসান জাতীয় কমিটির হরতালের দিনের প্রতিক্রিয়ায় উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, আন্দোলনকারী বাম কর্মীরা টিয়ার আর প্লাস্টিকের বুলেট খেয়েছেন, সীসার বুলেটের সামনে পড়েননি- ফলে এর মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। তিনি মুখে না বললেও ইঙ্গিত করেছেন যে এখানে আসল বীরেরা হল, বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীরা; যারা আরো বেশি দমন-পীড়ন ও সীসার বুলেট মোকাবেলা করছেন। জিয়ার উষ্মার প্রেক্ষিতেই উপরের কথাগুলো মনে করছিলাম আর ভাবছিলাম- ভেতরে ভেতরে কতোটা হীনমন্য এবং ইতিহাসবোধশূণ্য হলে কেউ এ ধরণের তুলনায় যেতে পারে!
বিএনপির আমলে সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল- তখনো তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ার প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু জাতীয় কমিটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় স্বার্থের পক্ষে নীতিনিষ্ঠ থাকার কারণেই আগের আন্দোলনগুলিতে সফলতা এসেছে। গ্যাস রপ্তানির বিরুদ্ধে আন্দোলনে লীগের সমর্থন ছিল, তারাই আবার ৯৬-২০০১ ক্ষমতায় থাকাকালে গ্যাস রপ্তানির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুমোদন দিয়েছিল। ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনিবিরোধী আন্দোলনেও আওয়ামী লীগের সমর্থন ছিল- সেই তারাই আবার এখন এশিয়া এনার্জির পক্ষে ওকালতি করে ওপেন মাইনিং করার চেষ্টাকে জারি রেখেছে। এখন রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলনে বিএনপির সমর্থন আছে। কিন্তু ভারত ক্ষমতার নিশ্চয়তা দিলে তারা এরকম আরো একাধিক প্রকল্পের পক্ষে দাঁড়াবে তা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়। ব্যাপারটা বিএনপি বা আওয়ামী লীগের নয়- ব্যাপারটা তাদের রাজনীতির ধরণ ও ক্ষমতার চরিত্রের। সেই চরিত্র কতোটা খারাপ তা দুই পক্ষই একাধিকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই পুরো সময়ে বিএনপি আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকদের জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে যে তারা যেন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে অংশ নেন।
ফুলবাড়িতে সীসার বুলেট ছুটে ছিনিয়ে নিয়েছে তরীকুল, সালেকীনের প্রাণ। খুব ভালো হত যদি তরীকুল সালেকীন বেঁচে থেকেই ভিটেমাটি জীবন-জমি রক্ষায় বিজয় অর্জন করতো, সেটা ঘটেনি। তাই বলে যখন বুলেট এসেছে তখন জাতীয় কমিটির নেতারা বা তরীকুলরা পিছিয়ে যায়নি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামে বামপন্থীরা সীসার বুলেটসহ সকল প্রকার দমন-নিপীড়নের চূড়ান্ত রূপ মোকাবেলা করেছেন। পুলিশ রিমান্ডে মোশরেফা মিশু, মন্টু ঘোষ বা তুহিন চৌধুরিদের উপর যেই মাত্রার নির্যাতন হয়েছে তা অকল্পনীয়; বামপন্থীরা গার্মেন্টস শ্রমিকের সংগ্রাম থেকে পিছু হটেননি।
কথাগুলি আলাদা লেখা দিয়ে বলতে চাইনি- জিয়ার পোস্টের কমেন্টেই বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে বিষয়ে বাজে অভিজ্ঞতা থাকায় আলাদা পোস্ট দিচ্ছি। কিছুদিন আগে একমুখী শিক্ষার প্রসঙ্গে জিয়া একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন। বেশ দুর্বল চিন্তার কাঁচা লেখা। তিনি বলেছিলেন- বামপন্থীদের একমুখী বা একই ধারার শিক্ষার আইডিয়াটা খুবই অবৈজ্ঞানিক, এইটার মধ্য দিয়ে তারা বৈচিত্র ধ্বংস করে সবাইকে একইরকম বানাতে চায়। শিক্ষার আলাদা আলাদা ধারাগুলিকে সমর্থন করে তিনি বলেছিলেন, কেউ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে, মাদ্রাসার ছাত্র কোরানে হাফেজ হবে-এই বৈচিত্র রক্ষা করাই গুরুত্বপূর্ণ। যে শিক্ষাই দেয়া হোক না কেন সেটা মানসম্মত হচ্ছে কী না সেটাই জিয়ার বিবেচনায় মুখ্য। ওই পোস্টের কমেন্টে আমার সাথে অনেক আলাপ হয়। আমি বলেছিলাম, একই ধারার শিক্ষার কাঠামোগত ধারণা নিয়ে জিয়া যা ভাবছেন তা আদৌ ঠিক নয়, একমুখী শিক্ষা মানে সবাইকে একইরকম বানানো নয়- সকল শিশুর জন্য সুষম এবং বৈষম্যহীন একটা শিক্ষার ব্যবস্থা করা যাতে করে শিশুটি আনন্দের সাথে ভারসাম্যপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলেছিলাম, মাদ্রাসার যে শিশুটি নিরানন্দের মধ্যে কঠোর তালিম নিচ্ছে তার ছবি আঁকতে ইচ্ছে করবে এবং সেটাই তার শিশুমনের জন্য স্বাভাবিক। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়বে নাকি মাদ্রাসায় পড়বে এর কোনো সিদ্ধান্তই যেহেতু শিশুটি নিজে নিতে পারে না তাই প্রাথমিক বা প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ে সকলের জন্য শিশুদের উপযোগী একটা কমন শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা দরকার এবং সেটাই হচ্ছে একমুখী বা একই ধারার শিক্ষা। এটা মূলত শিক্ষার নিম্নস্তরে প্রযোজ্য-বড় হওয়ার পরে সে ধর্মশিক্ষা বা যেকোনো ধরণের শিক্ষা গ্রহণ করতে চাইলে সেই দ্বার তার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। উত্তরে জিয়া বলেন-তিনি অনেক কষ্ট করে টাকা রোজগার করেন এবং নিজের সন্তানের জন্য মানসম্মত শিক্ষা চান, আর তাই তিনি নিজের সন্তানের জন্য দামী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পছন্দ করেছেন। এইখানে রাষ্ট্র বা সমাজের কোনো হস্তক্ষেপ তিনি চান না। আমি বলেছিলাম, মানসম্মত শিক্ষা তো সবার সন্তানের জন্যই দরকার- আপনি সেটাই বলেন। সবার সন্তানের জন্য মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা হলে আপনার স্বার্থের পাশাপাশি গোটা সমাজের স্বার্থ রক্ষিত হবে। কিন্তু আপনি বৈচিত্র রক্ষার নামে গরীব মানুষের সন্তানটির জন্য মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাকে চিরকালই গরীব রেখে দিলেন আবার নিজের সন্তানকে ঠিকই বাজারোপোযোগী শিক্ষা দিলেন- এভাবে সমাজে বৈষম্য বাড়তে থাকবে। আবার শুধু বাজার উপযোগী শিক্ষা পেলেই যে শিশুর সার্বিক বিকাশ নিশ্চিত হবে, মোটেও তা নয়। বিশেষত প্রাথমিক শিক্ষার সাথে মাতৃভাষার সম্পর্ক খুব গভীর।
এরকম আরো নানান আলাপ হলো। জিয়ার সাথে গভীর রাতে আলাপ শেষ করে সকালে উঠে আবার ফেসবুক খুলে তার জবাব দেখতে গিয়ে দেখলাম- আমার কমেন্টসহ পুরো কনভার্সেশনটি ডিলিট করে দিয়েছেন তিনি। কারণ জানতে চাইলে ইনবক্সে বললেন-আমার সাথে মতের বিরোধ হচ্ছে, এইটা তিনি পাবলিকলি দেখাতে চান না। কিন্তু মূল পোস্টটি তিনি ঠিকই রেখে দিলেন। মারাত্মক গোজামিল দেয়া নিজের দুর্বল চিন্তাগুলো তাকে লজ্জিত করলো না- কিন্তু আপন জ্ঞানী ইমেজটি টিকিয়ে রাখার জন্য বিতর্কগুলোকে মুছে দিলেন।
শ্রমিকের মজুরির অধিকার, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বা সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে- এই ধরণের কোনো বাম মতাদর্শিক সংগ্রামে জিয়া হাসানের মত লোকদের আশা করি না আমি। কারণ তাদের শ্রেণি অবস্থানই ভিন্ন। কিন্তু জাতীয় সম্পদ রক্ষার স্বার্থতো অন্য সবার মত তারও ইস্যু- আর তাই জাতীয় কমিটির আন্দোলনে তাকেও রাস্তায় দেখতে চাই। জাতীয় কমিটি এখনো পর্যন্ত কোনো আন্দোলনে আপোষ করেনি এবং শত্রু বা মিত্র নির্ধারণে তার এযাবতকালের কৌশল কার্যকর হয়েছে। আর তাই আন্দোলনের কৌশল বা কর্মসূচি নিয়ে সমালোচনাও হওয়া দরকার টু দ্যা পয়েন্ট। জিয়া হাসান, পিনাকী ভট্টাচার্য বা অন্য যে কেউ- আপনাদের আলোচনাটা হতে হবে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করে সুন্দরবন রক্ষার সংগ্রামকে সফল করার আলটিমেট নিয়ে। তারপরেও, যদি একান্তই মনে হয় যে জাতীয় কমিটি পারছে না তাহলে ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আপনাদের রাস্তায় দেখতে চাই। সেটা হলেও আন্দোলন সফল হওয়ার পথে চাপ বাড়বে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা