‘রোজার সঙ্গে স্বাধীনতার চেয়ে পরাধীনতার সম্পর্ক বেশি’
প্রকাশ : ১০ জুন ২০১৬, ১৫:৫২
মুসলমানের রোজার সঙ্গে স্বাধীনতার চেয়ে পরাধীনতার সম্পর্ক বেশি। সম্প্রতি চীনের সরকার চীনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে রোজা নিষিদ্ধ করেছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, কর্মী ও শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কারও বেলায় অবশ্য এ নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।
স্বাস্থ্যের কারণে শিক্ষার্থীদের রোজা রাখা ঠিক নয় বুঝি, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কর্মীদের মধ্যে কমিউনিজমে এবং নাস্তিকতায় বিশ্বাসী হওয়ার শর্ত যেহেতু আছে, তাদেরও রোজা রাখাটা হয়তো উচিত নয়। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি সকলে তো নাস্তিক নয়, তারা যদি রোজা রাখতে চায়, তবে রোজা রাখতে তাদের কেন বাধা দেওয়া হবে? সরকার নিশ্চয়ই বোঝাতে চাইছেন, রোজা রাখলে যেহেতু শরীরে ক্লান্তি এসে ভর করে, দিনের বেলায় আপিস-টাইমে সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। কিন্তু অনেকে যারা রোজা রেখেও দিব্যি ক্লান্তিহীন কাজ করে যেতে পারে, তাদের রোজা রাখার অধিকার কেন থাকবে না? সব রোজদার তো অফিসে বসে ঝিমোয় না! চীনের সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার নিন্দে করছি আমি।
চীনে, এমন নয় যে, মুসলিমদের শুধু রোজা রাখারই স্বাধীনতা নেই। ধর্মবর্ণলিঙ্গ নির্বিশেষে কারোরই বাক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের অধিকার নেই চীনে। সরকারের সমালোচনা করার কোনও অধিকারই নেই কারোর। লেখক সাংবাদিকরাও মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। চীনের পত্র-পত্রিকা কোনওটিই সরকারি মতের বাইরে ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারে না। গণতন্ত্রবিরোধী এবং মানবতাবিরোধী ভূমিকার জন্য চীনকে বিশ্বের লোক নিন্দে করে। মুসলিমদের রোজা রাখার অধিকার হরণ করার কারণেও নিন্দে করে। চীন অবশ্য বলে দিয়েছে, মুসলিম জঙ্গী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতেই মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশগুলোয় রোজার সময় কড়া নজর রাখেন চীন সরকার। রমজান মাসে ক্যাফে-রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন সরকার। ক্যাফে রেস্তোরাঁ বন্ধ না রাখার পক্ষে আমি। চীনের সরকার এই কাজটি কিন্তু মন্দ করেননি। ক্যাফে রেস্তোরাঁ বন্ধ করলে অমুসলিমদের মুশকিল হবে।
রোজা নিয়ে মুসলিম দেশগুলো চীন যা করছে তার উল্টোটা করছে। চীন যেমন রোজা পছন্দ করে না, মুসলিম দেশ রোজা এত বেশি পছন্দ করে যে মানুষের ওপর রোজা জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে। কিছু দেশে তো রোজা না রাখলে শাস্তি পেতে হয়। রোজা না রাখলে বাইরে কিছু খাওয়া, বা কিছু পান করা নিষেধ। মুসলমানদের মধ্যে অনেকে রোজা রাখতে চাইলেও অসুস্থতার কারণে রোজা রাখতে পারে না, তাদের ওষুধপত্র খেতে হয়, নিয়মিত খাবার খেতে হয়, ঘরে হয়তো রান্নাবান্নার আয়োজন নেই, তারা কোথায় খাবে যদি বাইরে খাবারের দোকান সব বন্ধ থাকে? মুসলিম দেশে তো শুধু মুসলিম বাস করে না, অমুসলিমও বাস করে।
নাগরিক হিসেবে বা বসবাসকারী হিসেবে তাদের কেন অধিকার থাকবে না ক্যাফে রেস্তোরায়ঁ খাওয়ার? মুসলমানদের অনেকেই রোজা রাখে না, বা রোজা রাখতে চায় না, তাদের কেন অধিকার থাকবে না রাস্তাঘাটে পিপাসা পেলে পানি পান করার? ক্ষিধে পেলে খাবার? ধর্মে যারা অবিশ্বাসী তাদের কেন অধিকার থাকবে না ক্যাফে রেস্তোরায়ঁ যাওয়ার? ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যার ধর্ম পালন করতে ইচ্ছে করে, সে করবে পালন। যার পালন করার ইচ্ছে নেই, সে করবে না। তাকে কেন রাষ্ট্র বা রাজ্য বা সমাজ জোর করবে বা বাধ্য করবে ধর্ম পালন করতে? ধর্ম কি তবে মুক্তির কোনও উপায় বলবে না, পরাধীনতার শেকলই কেবল পরাবে? রাষ্ট্র কিন্তু সবার জন্য, শুধু সংখ্যাগুরুদের জন্য নয়, সংখ্যালঘুদের জন্যও। সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু—সবাইকে সমান চোখে দেখা সরকারের দায়িত্ব।
বাংলাদেশে শেষ রাত থেকে শুরু হয়ে যায় মানুষের ঘুম ভাঙাবার জন্য বিকট ডাকাডাকি। এই চিৎকারে সবার ঘুম ভেঙে যায়। যারা সেহরি খেতে উঠতে চায় না, তাদেরও ঘুম ভেঙে যায়। তাদের কি অধিকার নেই ঘুমোবার? একই কথা বলা যায় আযানের ব্যাপারে। একসময় যখন মানুষের এলার্ম ঘড়ি ছিল না, মোবাইল ফোন ছিল না, তখন সেহরি খেতে ওঠার জন্য পাড়ার ছেলেদের চিৎকার হয়তো সেহরি যারা খেতে চায়, তাদের উপকার করতো। এখন এই টেকনোলজির যুগে চিৎকার চেচামেচি সম্পূর্ণই অর্থহীন। মোবাইল ফোনে এলার্ম কী করে সেট করতে হয়, তা, আমার বিশ্বাস, সবাই জানে। না জানলেও এটি শিখে নেওয়াটা দু’মিনিটের কাজ।
যারা রোজা রাখতে চায় তাদের অধিকার আছে রোজা রাখার। যারা রোজা রাখতে চায় না, তাদেরও অধিকার থাকা উচিত রোজা না রাখার। প্রতিটি মানুষেরই অধিকার আছে ধার্মিক হওয়ার, অধিকার আছে ধার্মিক না হওয়ার। সারা পৃথিবীতেই দেখি ধর্মকর্ম করার সব রকম অধিকার মানুষের আছে। শুধু তাই নয়, ধর্মে যাদের অবিশ্বাস, তাদের নিন্দে করার অধিকারও ধার্মিকদের আছে। কিন্তু অবিশ্বাসীদের কোনও অধিকার নেই ধর্মবিশ্বাসীদের নিন্দে করার। নিন্দে করলে খুন হয়ে যেতে হয়, অপদস্থ হতে হয়, মামলায় ফাঁসতে হয়, জেল খাটতে হয়, নির্বাসনে যেতে হয়।
ইসলামের যারা পণ্ডিত, তারা ইসলামের প্রশংসা করতে গিয়ে সব সময় বলেন, --‘কোরান বলেছে, ‘ধর্মে কোনও জোর জবরদস্তি নেই’’। ইসলামের পক্ষে, আমার মনে হয়, এটিই শ্রেষ্ঠ বাক্য। কিন্তু রোজার বেলায় কেন এই বাক্যটি ব্যবহার করা হয় না? কেন বলা হয় না ‘রোজার ব্যাপারে কোনও জোর জবরদস্তি নেই?’ ধর্মে যদি জোর জবরদস্তি না থাকে, নামাজ রোজাতেও জোর জবরদস্তি নেই। তবে কোরানে যা লেখা আছে বলে মুসলিমরা গৌরব করে, সেটির চর্চা কেন মুসলিমরা করে না? ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই, আল্লাহ বলেছেন। আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর উপদেশকে মেনে চলবে, এ তো সকলেই আশা করে। রোজদারদের সম্মান করার জন্য আল্লাহ আছেন, হাশরের ময়দানে তাঁরা আল্লাহর নেক নজরে পড়বেন। রোজদাররা কেন অরোজদার এবং অমুসলিমদের কাছ থেকে সম্মান পেতে চান? নিজেদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হলেও কেন সম্মান দেখাতে হবে রোজদারদের? সম্মান তো, যতদূর জানি, পারস্পরিক। তুমি আমাকে সম্মান দিলে আমি তোমাকে সম্মান দেবো। তাই নয় কি?
বাংলাদেশে এক হিন্দু পুরোহিতকে জবাই করে মুসলিম সন্ত্রাসীরা তাদের রমজান শুরু করেছে। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মালম্বীদেরও খুন করা হচ্ছে। সেদিন বোরখা পরা এক হিজাবি মেয়েকে খুন করা হলো, কারণ তার স্বামী মৌলবাদ-বিরোধী। কারও নিরাপত্তা আজ বাংলাদেশে নেই।
ইসলাম যদি আরও উদার না হয়, তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি মুসলিমদের। আজ বিশ্বের অগুনতি মানুষ মুসলিমদের নিন্দে করছে। অনেকে তাদের আর বিশ্বাস করছে না। মুসলিম নাম শুনেই ছিটকে সরে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে। মুসলিমরা দুনিয়া জুড়ে কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কারণে অসহিষ্ণু, ঘাতক,বর্বর বলে চিহ্নিত হচ্ছে। ইসলামকে উদার করার দায়িত্ব নিতে হবে মুসলিমকেই। বিশ্বের কাছে মুসলিমদের প্রমাণ করতে হবে যে তারা সন্ত্রাসী আর অসহিষ্ণু নয়, তারা জঙ্গী মুসলিমদের সমর্থন করে না, তারা ক্ষমায়, উদারতায়, স্বাধীনতায় এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, তারা মানুষের মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে।
মানবাধিকার আর গণতন্ত্রকে সম্মান না করলে বিশ্বের বিবেকবান মানুষের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার কোনও পথ খোলা নেই।
পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মুসলিম না হয়েও নামাজ পড়েন, রোজা করেন। যদিও আমরা সবাই বুঝতে পারি এসব তিনি মন থেকে করেন না, মুসলিমদের ভোট পাওয়ার জন্য করেন, কিন্তু তারপরও আমি মনে করি না তার নামাজ রোজায় কারও বাধা দেওয়া উচিত। তাঁর অধিকার আছে যে কোনও ধর্ম পালনের। একসঙ্গে একাধিক ধর্ম পালনের অধিকার কে বলেছে কারও নেই? কোনও ধর্ম পালন না করার অধিকার যেমন মানুষের আছে, এক এবং একাধিক ধর্ম পালনের অধিকারও মানুষের আছে।
তবে একটি কথা কেউ যেন ভুলে না যায় যে, রাষ্ট্রের চোখে ধর্ম পালন যে করছে এবং যে করছে না – দু’জনের গুরুত্বই সমান, দু’ব্যক্তির অধিকার সমান।
তসলিমা নাসরিন এর ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে