'সময় গেলে সাধন হবে না'
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:২৯
মজবুত গাঁথুনী না হলে যেমন একটি বহুতল ভবন টিকিয়ে রাখা অসম্ভব, তেমনি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত শক্তপোক্ত না হলে একজন ভালো মানুষ তৈরি করাও সম্ভব নয়। তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত শক্তপোক্ত করতে হলে কোন পদ্ধতি আমাদের অনুসরণ করা দরকার? এমন প্রশ্ন যদি আমাকে কেউ করে, তবে এর উত্তর হবে সৃজনশীল ও প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থা।
একটি সুষ্ঠু, সুন্দর এবং অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠনে সৃজনশীল ও প্রগতিশীল শিক্ষা ব্যবস্থার কোন বিকল্প হতে পারে না। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই প্রতিটি শিশুর মনে এই ভিত তৈরি করে সামনে এগিয়ে যেতে না পারলে কখনোই সৃজনশীল মানুষ পাওয়া সম্ভব নয়। আর সৃজনশীল মানুষ ছাড়া একটি আদর্শ জাতি গঠন করাও সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্প্রসারিত করে গড়ে তুলতে হবে ভবিষ্যত প্রজন্মকে। এখান থেকেই তাদের মনমগজে ও ধ্যানে জ্ঞানে আদর্শ, নীতি নৈতিকতা, সততা, আচরণগত অভ্যাস, দেশ প্রেম, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, জাতির প্রতি মমত্ববোধ, অসাম্প্রদায়িকা তৈরি করতে ব্যর্থ হলে কখনই আদর্শ জাতি গঠন করা সম্ভব হবে না।
বলা হয়ে থাকে, শিশুরা কাদামাটির। এদের যেভাবে গড়ে তোলা হয় তারা সেভাবেই গড়ে উঠে। তাই আদর্শ মানুষ তৈরিতে এই বয়সটাই মোক্ষম। সুতরাং আদর্শ জাতি গঠনের লক্ষ্যে এ সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। যদি, কোনক্রমে শিশুদের এ সময়টাকে কাজে লাগানো না যায়, তবে আদর্শ জাতি গঠনের ‘আশায় গুড়ে বালি’ ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। লালন ফকির বলেছিলেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। যা কিছু করার তা সময়ের মধ্যেই করতে হয়।
বর্তমানের সরকারের কিছু বাস্তবমুখি উদ্যোগের কারণে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে। অনেক শিক্ষিত ছেলে-মেয়েও বের হয়ে আসছে। আগামীতে এ হার আরও দ্বিগুণ হবে। দ্বিগুণ থেকে তিন গুণও হতে পারে। একটা সময় আমাদের দেশে অশিক্ষিত বলে কেউ থাকবে না এমন স্বপ্নও আমরা দেখতে শুরু করেছি। যা উন্নত বাংলাদেশ গঠনে অত্যন্ত কার্যকরী।
কথায় আছে, ‘যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত বেশি উন্নত’। এজন্যই বলা হয়ে থাকে ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। শিক্ষাহীন জাতি সরিসৃপের মত সোজা হয়ে কখনো দাঁড়াতে পারে না। একটি শ্রেণি, গোষ্ঠি বরাবরই চেয়েছে বাংলাদেশিরা মেধাহীন হয়ে থাকুক। এজন্য ভুল শিক্ষা, কু-শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রয়াস বরাবরই করে আসছিল সে গোষ্ঠিটি। বাংলাদেশকে মেধাহীন করার চক্রান্ত আজকের নয়; এ চক্রান্ত শুরু হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে। যার প্রথম রূপটা আমরা দেখেছিলাম আমাদের বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি হত্যার মধ্য দিয়ে। তারা চেয়েছিল বাংলাদেশিরা মেধাহীন হয়ে থাকুক। গোলামি করে বাঁচুক। মাথা তুলে যেন দাঁড়াতে না পারে। এমন লক্ষ্য নিয়েই সেদিন বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়েছিল। আজও একইভাবে এদেশের মেধাবীদের হত্যা করা হচ্ছে। পাশাপাশি মেধাহীন করার চক্রান্ত স্বরূপ মধ্যযুগীয় শিক্ষা ব্যবস্থা কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে। যা আগামীর জন্য অত্যন্ত ভয়ানক। একাত্তরের পরাজিত সেই শক্তিরা এখনও আছে আমাদের আশপাশে। আছে তাদের দোসররা। তারা এখনও চাইছে বিশ্ব দরবারে বর্বর, অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, সাম্প্রদায়িক জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে।
সে লক্ষ্যেই ওই গোষ্ঠিটি অত্যন্ত সুকৌশলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। যেখানে স্পষ্টত তাদের কুপমণ্ডুকতা, গোড়ামি আর ভেদাভেদের দৃষ্টিভঙ্গি। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের কোমলমতি শিশুদের মনন ও মগজে। অত্যন্ত সুকৌশলে লিঙ্গ বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িকতার বীজবপন করে দেওয়ার সুদূরপ্রসারি একটা ব্যবস্থা তারা করে ফেলেছে আমাদের সরকারের কাঁধে ভর করে। যা অত্যন্ত দু:খজনক ও হতাশাজনক।
তবে, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের উদ্দেশে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "যারা শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই কোনও কিছুই রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয়। আগে আপনারা ভলান্টিয়ার সার্ভিস দিন, সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য কিছু করুন, শিক্ষা দিন। তারপর কথা বলুন"।
একই সাথে সমালোচকদের কাছে তিনি প্রশ্ন রাখেন, "শিক্ষার মানের মাত্রাটা আসলে কী?"
আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। তাকে নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। আমার তার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করি। তিনি প্রমাণ করতে সক্ষমও হয়েছেন, তার সরকার শিক্ষাবান্ধব। আমরা এমন সরকারই মনে প্রাণে আশা করেছিলাম। আমরা চেয়েছি শিক্ষাবান্ধব ও অসাম্প্রদায়িক সরকার। আমাদের সরকারও তেমন, এমনটাই মনে করি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতে ইসলামীকে খুশি করতে তাদের ইচ্ছেতে পাঠ্যবইয়ে এই পরিবর্তন আনবেন! তাহলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার যে শ্লোগান নিয়ে এসেছেন তার কী হবে?
আমরা জানি যাদুর কাঠি ছোঁয়াতে কিছু করা যাবে না, রাতারাতি কিছু বদলাবেও না। আমরা আশাও করি না সব কিছু রাতারাতি বদলে দিন। বাংলাদেশকে রাতারাতি আমেরিকা ইউরোপ বানিয়ে দিন এমনটা কখনোই চাই না। তাই বলে কী শিক্ষার মান নিয়ে এ দেশের একজন নাগরিক হয়ে কোন কথাই বলা যাবে না? কথা বলার আগে ‘নিজে করে’ দেখাতে হবে? প্রধানমন্ত্রী, এমন বক্তব্য কী আপনার কাছ থেকে প্রত্যাশা করি? আর হ্যাঁ, আপনি কী হলফ করে বলতে পারবেন সরকার যা করছে, যেভাবে করছে, তার সবই কী ভালো?
সময় বদলেছে, পৃথিবী বদলাচ্ছে। চাঁদ, মঙ্গল জয়ের নেশায় মত্ত মানুষ। বিশ্বের সাথে তাল রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে মানুষ বিজ্ঞানমনষ্ক হচ্ছে। এগিয়ে যাবে নতুন নতুন ভিশন নিয়ে। কেউ এখন পশ্চাত্পদ নেই। সবার একটাই ভিশন সামনে এগিয়ে চলা। এই যখন পুরো পৃথিবীর অবস্থা; তখন আমাদেরকে কেন টেনে ধরা হচ্ছে? পশ্চাত্পদে কেন নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে? শিক্ষার শুরু থেকে কেন বাচ্চাদের শেখাতে যাব ‘ও’ তে ‘ওড়না চাই’? তবে কী তারা ডিজিটাল বাংলাদেশকে ওড়নাতে ঢেকে দিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান বানানোর ভিশন নিয়ে মাঠে নেমেছে?
নতুন বছরের ১ জানুয়ারি দেশজুড়েই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নতুন বই। আর এসব বইয়ে রয়ে গেছে যাচ্ছেতাই ভুল, অপ্রাসঙ্গিক নানা বিষয়, যা সত্যি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও নিন্দার ঝড় উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলের বিষয়বস্তু ফিরে আসাটা নি:সন্দেহে বিস্ময়কর। নিখাদ সাহিত্য ও ভাষা শিক্ষার বইয়ে অপ্রাসঙ্গিকভাবে তুলে আনা হয়েছে একেবারে ধর্মীয় বিষয়। বাদ পড়েছে ‘হিন্দু’ ও ‘নাস্তিক’ লেখকদের সৃজনশীল সব লেখা। নতুন শিক্ষানীতির আলোকে তৈরি কারিকুলামের ভিত্তিতে নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রকাশের তিন বছরের মাথায় (২০১৭ শিক্ষাবর্ষ) এমন পরিবর্তন হলো। আর এমন পরিবর্তন এসেছে হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে!
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ২০০৩ সালে পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। প্রতিটি শ্রেণির বাংলা সাহিত্যের বইয়ে ধর্মীয় বিষয় ও ভাবধারা যুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পাঠ্যপুস্তক সংস্কারের কাজ শুরু করা হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করে। এর আলোকে নতুন পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করা হয় ২০১২ সালে যা শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছায় ২০১৩ সালে। তখন বলা হয়েছিল, বাংলা বিষয়কে সাহিত্যসমৃদ্ধ এবং সর্বজনীন করার জন্য ধর্মীয় বিষয়গুলো সরিয়ে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষাসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় বইয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। যা ছিল সৃজনশীল ও প্রগতিশীল শিক্ষা-ব্যবস্থা।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবীতে যখন শাহবাগে গণজাগরণমঞ্চের আন্দোলন চলছিল তখন ছাত্রশিবিরের ফেসবুক পেজ ‘বাঁশের কেল্লা’ পাঠ্যপুস্তক থেকে ইসলামী ভাবধারার কী কী লেখা বাদ পড়েছে এবং কোন কোন হিন্দু ও নাস্তিক লেখকদের কী কী লেখা যুক্ত হয়েছে তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। একই বছর গড়ে উঠা হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি ওই শিক্ষা কার্যক্রম ও সংযোজন-বিয়োজনের বিরোধীতা করে। একই সাথে হেফাজতে ইসলাম সহ আরও ক’টি ইসলামী সংগঠন পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের দাবীতে আন্দোলন করেছিল।
গণমাধ্যমের সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রিয় নেতাদের এক যৌথ বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। ওই বিবৃতিতে পাঠ্যপুস্তকের বাংলা বই থেকে বাদ দেওয়া ১৭টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধের তালিকা প্রকাশ করা হয়। যার সবই ২০১৭ সালের বইয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। একইভাবে যে ১২টি গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ-নিবন্ধকে নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়, তার সব কটিই এবছর বাদ দেওয়া হয়েছে। আর এতে করেই স্পষ্ট যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উপর হেফাজতে ইসলাম-এর কতটা প্রভাব!
আমরা জানি, পাঠ্য-বই পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজনের ক্ষেত্রে বিদ্যালয় পর্যায়ে ট্রাই-আউটের মাধ্যমে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত সংগ্রহ, তার ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে কর্মশালা এবং তার আলোকে এনসিসিসিতে (ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কিন্তু, এবারের সংযোজন-বিয়োজনের বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত হয়েছে এনসিসিসির সভায়। এর প্রধান হচ্ছেন শিক্ষাসচিব।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২০ আগস্ট অনুষ্ঠিত এনসিসিসির সভায় সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা একটি তালিকা দিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন না করে সে অনুসারে পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন-বিয়োজন করে নেওয়ার কথা বলেন। তার এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তন এসেছে। এতে দ্বিতীয় থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের বাংলা বই থেকে ২০১২ সালে যে বিষয়গুলো বাদ পড়েছিল তার সবই আবার ফিরে এসেছে ২০১৭ সালের সংস্করণে। একই সাথে ২০১২ সালে নতুন যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে পাঠ্যপুস্তকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রণীত শিক্ষাক্রম আবার চালু হলো।
প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বর্ণ পরিচয়ে ‘ও’ তে ‘ওড়না চাই’ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্তরেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এখান স্পষ্টত লিঙ্গ বৈষম্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন ছাত্র কেন ওড়না চাইবে? অথবা, ওড়না কেন প্রয়োজন একজন শিক্ষার্থী যদি তার শিক্ষকের কাছে জানতে চায় তবে, এর উত্তর কী হবে? এর কোন উত্তর মিলে নি কোথাও। শুধু তাই নয়, অসংখ্য ভুল বানানে ছড়াছড়ি পাঠ্য বই। এরমধ্যে, পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে ‘ঘোষণা’ বানান ‘ঘোষনা’, ‘সমুদ্র’ বানান ‘সমুদ’ লেখা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় ইংরেজি নীতিবাক্য লেখা হয়েছে ভুল বানানে। ‘কাউকে কষ্ট দিও না’ এর ইংরেজি লেখা হয়েছে, ‘Do not heart anybody’।
সব থেকে মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে ছাগল গাছে উঠে আম খায়। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতায় ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে’ এমন না লিখে লেখা হয়েছে ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে’। শুধু তাই নয়, একই কবিতার চতুর্থ লাইনে ‘হইতে’-এর পরিবর্তে ‘হতেই’, নবম লাইনে ‘চায়’-এর পরিবর্তে ‘চাই’, পঞ্চদশ লাইনে ‘খাট’ শব্দটি না লিখে লেখা হয়েছে ‘খাটো’। আর কবিতাটির একাদশ থেকে চতুর্দশ লাইন উধাও।
অষ্টম শ্রেণির গল্পের বই আনন্দপাঠ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বইটিতে একটিও মৌলিক গল্প নেই। সাতটি গল্পের সব কটিই বিদেশি লেখকদের লেখার অনুবাদ। গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে আরব্য উপন্যাস অবলম্বনে ‘কিশোর কাজী’, মার্ক টোয়েনের ‘রাজকুমার ও ভিখারির ছেলে’, ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুশো’, ফরাসি ঔপন্যাসিক মহাকবি আবুল কাশেম ফেরদৌসীর ‘সোহরাব রোস্তম’, উইলিয়াম শেকসপিয়ারের ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’, ওয়াশিংটন আরবি রচিত গল্প অবলম্বনে ‘রিপভ্যান উইংকল’ ও লেভ তলস্তয়ের ‘সাড়ে তিন হাত জমি’।
‘অসভ্যতা’র বিপরীতে ‘সভ্যতা’ এ ধারণাটি সৃষ্টি হয় আজ থেকে ১৮ শতক আগে। সভ্য সমাজ উপনিবেশ স্থাপনকারী, নগরবাসী এবং অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন সংস্কৃতিমনা মানুষ। আদি সমাজ থেকে এ সমাজ ভিন্ন। জ্ঞানের আলোকে বর্বরতাকে পরিহার করে ভিন্নতা অবলম্বন করেছিল এ সমাজের মানুষ। যাদের হাত ধরে আমরা পেয়েছি আলো ঝলমলে নগর, পৌঁছে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে চাঁদ অবধি। অথচ আমাদেরকে কৌশলে সভ্য-সমাজ থেকে আদি সমাজে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে চলমান শিক্ষা প্রদ্ধতির মাধ্যমে। গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে সৃজনশীলতা, প্রগতিশীলতাকে আর উস্কে দেওয়া হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা।
অথচ, আমাদের মূল্যবোধের ভেতরে হেফাজত কিংবা ইসলাম অথবা হিন্দুত্ব এই ধরণের বিষয় থাকার কথা না। একটি নির্দিষ্ট বয়সের ছেলেমেয়েদের যে নৈতিকতা, সৃজনশীলতা, অসাম্প্রদায়িকতা শেখাতে চাই, সেই জিনিসটা আমরা সঠিকভাবে শেখাতে পারছি কি না সেটাই মূল আলোচ্য বিষয়। আমাদের শিক্ষার্থীদের অসাম্প্রদায়িক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এই কারিকুলাম ঠিক করতে হবে। কিন্তু, তা না করে করা হচ্ছে উল্টোটা। যা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নয়; পশ্চাতে ফিরে যেতে সাহায্য করবে এ জাতিকে। আর আমরা একসময় বর্বর, সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠিতে রূপান্তরিত হব।
লেখক: ব্লগার