পিএসসি, জেএসসি ও অন্যান্য
প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬, ২৩:১৬
অভিভাবকেরা প্রায়ই পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করার কথা বলে থাকেন। এই পরীক্ষাগুলোর জন্য শিক্ষার্থীদের অল্প বয়স থেকেই পড়ার অতিরিক্ত চাপ বহন করতে হয়, যা শিশু-কিশোরদের সুষ্ঠুভাবে বিকাশের ক্ষেত্রে বাধা দান করে থাকে। অথচ ভেবে দেখেছেন কি, পড়ালেখা, পরীক্ষা ইত্যাদির নামে অভিভাবক নিজেরাই শিশু কিশোরদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দেন। একজন শিক্ষার্থী তার দক্ষতা, যোগ্যতা, সামর্থ্য অনুযায়ী পড়বে এবং সে মোতাবেক ফলাফল করবে। কিন্তু অভিভাবকেরা তা হতে দেবেন না। যে শিক্ষার্থীর ১০ কেজি ভার বহনের সামর্থ্য নেই, তার মাথায় ১০০ কেজি ভার চাপিয়ে দেন (রূপক অর্থে বলা)। এ প্লাস না পেলে অভিভাবকেরা সন্তুষ্ট হন না, অথচ ভাবেন না এ প্লাস পাবার সেই সামর্থ্য সন্তানের আছে কিনা! সন্তানের পরীক্ষা তো নয়, যেন তারা নিজেরাই পরীক্ষা দিচ্ছেন।
প্রতিযোগিতা বা পড়ালেখার চাপ তাই তখন আর শিশু কিশোর উপযোগী থাকে না। অভিভাবকেরা নিজেদের মধ্যকার অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও চাপ চাপিয়ে দেন সন্তানদের উপর। আর তাই সন্তানদের উপর অভিভাবকেরা চাপিয়ে দেন অতিরিক্ত পড়ার চাপ, অতিরিক্ত কোচিং করান, খেলাধুলা করতে দেন না। সন্তান তার সর্বোচ্চ চেষ্টাতে যে ফলাফল করে তাতে অভিভাবক খুশি হন না, যদি না সেই ফলাফল এ প্লাস হয়! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অভিভাবকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে, নিজেদের সুনাম ধরে রাখার জন্য শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পড়া, বাড়তি ক্লাস, মডেল টেস্ট ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত রাখে। শিক্ষার্থীদের সাথে সাথে অভিভাবকেরাও অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তায় পেরেশান হয়ে পড়েন। যদি সন্তান পরীক্ষায় এ প্লাস না পায়, তবে অভিভাবকের সব পরিশ্রম ও প্রেস্টিজ ধুলায় মিশে যাবে। অথচ পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষা শুধুমাত্র এ প্লাস অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে প্রবর্তন করা হয় নি।
পরীক্ষায় এ প্লাস পাবার প্রত্যাশা নিয়ে যে অভিভাবক সন্তানকে বাড়তি চাপে রাখেন এবং নিজেও বাড়তি চাপে থাকেন, সেই অভিভাবক-ই পড়ার অতি চাপের কথা বলে পিএসসি জেএসসির মত পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাতিল হোক চান। এস এস সি পরীক্ষার আগে পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষাতে অংশ নিলে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বড় পাবলিক পরীক্ষার ভীতি কেটে যাবার কথা। কিন্তু অভিভাবকদের কল্যাণে (!!!) আরো বেশি করে পরীক্ষা ভীতি তৈরি হয়। এটা ঠিক যে, পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষার সনদ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। তারপরেও কিছু কথা থেকে যায়, এই পরীক্ষার সনদগুলো কোন কোন পরিবারের সন্তানদের জন্য খুব দরকার। এই পরিবারের সন্তানেরা বেশির ভাগ সময় পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণির পরে ঝরে যায়। পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষার সনদের জন্য হলেও তারা এখন পড়ালেখায় আগ্রহী হচ্ছে। যারা এ+ পাবার কথা স্বপ্নেও ভাবে না, তারা শুধু প্রতিদিন পেট ভরে ভাত খেতে পাবার স্বপ্ন দেখে, ড্রাইভার, পিয়ন এরকম পদে একটি ছোট্ট চাকরির স্বপ্ন বড়জোর দেখতে পারে, তাদের জন্য এই সনদগুলো দরকার, তাদের এ প্লাসের দরকার নেই। পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষার চলনসই ফলাফলের একটি সনদ আপনার কাছে যত গুরুত্বহীনই হোক না কেন, এই পরিবারগুলোর মুখ কতটা উজ্জ্বল ও গর্বিত করে তোলে তা হয়ত ভাবতেও পারবেন না। পিএসসি/জেএসসি পরীক্ষা বাতিল হলে তাদের সামান্য স্বপ্নগুলোও হারিয়ে যাবে।
আপনার সন্তানকে আপনি নাসার বিজ্ঞানী বানানোর স্বপ্ন দেখতে পারেন, অসুবিধা নেই। নিজের সন্তানের পাশাপাশি এই আধ পেটা খাওয়া, খেটে খাওয়া শিশু-কিশোরদের কথাও দয়া করে ভাবুন।
লেখক: লেখক ও শিক্ষক