ডিম আগে না মুরগী আগে
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:৩১
‘গণমাধ্যম দর্শকদের রুচি তৈরি করে দেয়’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের প্রধানতম একটি গণমাধ্যম টেলিভিশন। আমাদের দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো দর্শকদের রুচি তৈরি বা ধবংস করতে ভূমিকা রাখছে কিনা কিংবা রাখলেও কতখানি রাখতে পারছে, এটা বর্তমানে একটি বার্নিং কোয়েশ্চেন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলো থেকে দর্শকেরা অনেক আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর পেছনে বেশ কিছু কারণও আছে। টিভি চ্যানেলগুলোর পিক আওয়ার বা অফপিক আওয়ার আলাদাভাবে বোঝার উপায় নেই। আপনি যেকোন সময় দেশের যেকোন চ্যানেল খুলে দেখতে পাবেন হয় বিজ্ঞাপন চলছে আর নাহলে সংবাদ বা টকশো। একজন দর্শক নিশ্চয়ই সারাক্ষণ বিজ্ঞাপন কিংবা সংবাদ, টক শো দেখার জন্য টিভি খুলে রাখবেন না। নাকি চ্যানেলগুলো দর্শকদের এমন রুচিই তৈরি করে দিতে চায় যে, দর্শকেরা শুধুই বিজ্ঞাপন কিংবা টক শো ছাড়া আর কিছু দেখবেন না। তারা যা দেখাবেন, দর্শকেরা তা-ই দেখতে বাধ্য থাকবেন। বিজ্ঞাপন কিংবা সংবাদ-টকশোর বাইরে অন্য কোন অনুষ্ঠান বা নাটক কোন চ্যানেলে কোন সময়ে প্রচারিত হয় তা দর্শকেরা জানতেও পারেন না। স্বাভাবিক কারণেই দর্শকেরা দেশীয় চ্যানেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে। এমন কি আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনও চলে যেতে শুরু করলো ভারতীয় চ্যানেলগুলোতে। বহুজাতিক কোম্পানীগুলোও বাংলাদেশের জন্য পয়সা খরচ করে, নতুন করে আর বিজ্ঞাপন তৈরি করে না। বিদেশী বিজ্ঞাপনগুলোই বাংলায় ডাব করে প্রচার করে। অথচ এক সময় নতুন একটি বিজ্ঞাপন প্রচারিত হলেও দর্শক আগ্রহ নিয়ে দেখতো। বিজ্ঞাপনেও বৈচিত্র হারিয়ে ফেলছে এ দেশের চ্যানেল।
অনুষ্ঠানের বৈচিত্র তো অনেক আগেই দেশীয় চ্যানেলগুলো হারিয়ে ফেলেছে। দর্শকদের রুচি বা চাহিদার প্রতি কোন তোয়াক্কাই যেন তাদের নেই। আমাদের নাটকগুলোতে থাকে আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে ভাঁড়ামোপূর্ণ অভিনয়, কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর অপচেষ্টা, ভারতীয় সিরিয়ালের নকল কুটিলতাপূর্ণ কাহিনী, অল্প বয়সী অ-অভিনেতা অ-অভিনেত্রীদের অতি অভিনয়, প্রেমের কাহিনীর নামে নিম্নরুচির ফ্লার্টিং ও ছাগলামি। গণমাধ্যমই যে শুধু দর্শকদের রুচি তৈরি করে দেবে তা নয়, বরং দর্শকদের রুচি অনুযায়ী অনুষ্ঠানের মান তৈরি হয়। তবে আমাদের চ্যানেলগুলো ও অনুষ্ঠান নির্মাতারা দর্শকদের রুচির কথা থোড়াই কেয়ার করে। সব ধরনের দর্শকের জন্য তাদের রয়েছে ঐ এক কুমীরের বাচ্চার মত এক টাইপ অনুষ্ঠান। কোন বৈচিত্র খুঁজেই পাওয়া যায় না।
নারী দর্শকের কথা যদি ভাবি, তবে তার জন্য রয়েছে শুধু রূপচর্চা, ফ্যাশন ও রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানের দরকার নেই, তা আমি বলছি না। তবে একজন নারী রাঁধা আর চুল বাঁধা ছাড়াও আরো বিষয়ে আগ্রহ থাকতে পারে। নারীর অধিকার সচেতনতা বিষয়ক অনুষ্ঠান কিংবা আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে নারীর আত্নরক্ষার কৌশল শেখানোর জন্য কোন অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় কিনা, আমার জানা নেই। তবে নারী নিজেকে কিভাবে পণ্য হিসেবে গড়ে তুলবে, তা শেখানোর প্রচুর অনুষ্ঠান রয়েছে।
তরুণদের জন্য বিজ্ঞান, তথ্য, প্রযুক্তিভিক্তিক, জ্ঞানমূলক, উদ্ভাবনী প্রতিভা অন্বেষণের, অ্যাডভেঞ্চারমূলক, শিক্ষামূলক, সৃষ্টিশীল অনুষ্ঠানের খরা রয়েছে চ্যানেলগুলোতে। বিতর্কের অনুষ্ঠান এক বিটিভি ছাড়া আর কোন চ্যানেলেই নেই। শিশুদের কথা ভেবেও অনুষ্ঠান বানানো হয় না। হলেও হাতে গোনা, অল্প কিছু। একসময় বিটিভিতে শিশুদের জন্য নতুন কুঁড়ির মত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান হতো। এই অনুষ্ঠান দেখে দেখে বাচ্চারাও নিজেদের নানারকম প্রতিভা নিয়ে সচেতন হতে পারতো। এখন দেশীয় চ্যানেলগুলোতে ভারতীয় চ্যানেলের অনুকরণে ‘‘ক্ষুদে গানরাজ’’ টাইপ প্রতিযোগিতা হয়। এসব প্রতিযোগিতাতে শিশুদেরকে দিয়ে এডাল্টদের মত সাজসজ্জা দিয়ে, এডাল্টদের মত অঙ্গভঙ্গি করে নাচিয়ে, এডাল্টদের অনুকরণে প্রেমের আবেদন মাখানো গান গাওয়ানো হয়। এসব অনুষ্ঠান মূলত এডাল্টদের টার্গেট করে বানানো। শিশুদের দিয়ে বড়দের মত করে বড়দের গান গাওয়ানোর মত অশ্লীলতা আর কী হতে পারে? এসব অনুষ্ঠান দেখে দেখে এখন শিশুরাও বড়দের গান গাইতেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে, যা খুব ভালো কথা নয়। গণমাধ্যম যদি এভাবেই দর্শকদের রুচি তৈরি করে দিতে চায়, তবে তা ভবিষ্যত প্রজন্মের বেড়ে উঠার জন্য আশংকাজনক। যেই শিশুর গাইবার কথা ছড়া গান, তাকে রাবারের মত টেনে হিঁচড়ে লম্বা করে, বড় করে গাওয়ানো হচ্ছে বড়দের গান!
শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। লাইভ গানের অনুষ্ঠানগুলো মোটামুটি। এছাড়াও আছে কাকের ময়ূর সাজার মত পাশ্চাত্যের অনুকরণে অতি আধুনিক কিছু উপস্থাপক ও তারকাদের অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে তাদের বিকৃত ভাষা শোনার চেয়ে না শোনাই মঙ্গলজনক। সেই সাথে আছে তাদের সস্তা ও ইঙ্গিতময় স্হূল রসিকতা। একসময় শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা শেখার জন্য দর্শকেরা টিভির নাটক বা অনুষ্ঠান দেখত। এখনকার ‘আইছি’ ‘করছি’ ‘প্রিয় দড়শখ’ মার্কা নাটক বা অনুষ্ঠান দেখলে বাংলা ভুলে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তার চেয়ে বাংলায় ডাব করা বিদেশী সিরিয়ালগুলো বরং দর্শকদের চোখ ও কানের আরাম দেয়। এসব সিরিয়ালের শক্তিশালী সংলাপ, অভিনয় দক্ষতা, কাহিনীর বৈচিত্র্যতা দর্শকদের ধীরে ধীরে দেশীয় চ্যানেলমুখী করছে। কিন্তু সেই একই চ্যানেলে নিজস্ব নাটক বা অনুষ্ঠান হলেই দর্শক চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছেন। বাংলা ডাব করা এই বিদেশী সিরিয়ালগুলো বন্ধ করে দিয়ে দেশীয় চ্যানেলগুলো যদি তাদের বস্তাপচা নিম্নমানের অনুষ্ঠান দেখাতে চায়, তবে তা হবে দর্শকদের উপর নির্যাতন। চ্যানেল ও কলাকুশলীদের উচিত হবে বিভিন্ন রুচির দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে অনুষ্ঠানের মান ও বৈচিত্র্য বাড়ানো।
এতদিন বিটিভির অনুষ্ঠানের মান নিয়ে সবাই হাসি ঠাট্টা করতো। এখন প্রায় সব দেশীয় চ্যানেলের নকল, একঘেঁয়ে ও নিম্নমানের অনুষ্ঠান নিয়ে এর চেয়ে বেশি হাসি ঠাট্টা করা যায়। তবে, বিটিভি নিয়ে যতই হাসাহাসি করুন না কেন, এই এক বিটিভিই এখনো সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। জনসচেতনতামূলক ও শিক্ষামূলক নাটক, অনুষ্ঠান, বিজ্ঞাপন সবই এই এক বিটিভিতেই প্রচারিত হয়ে থাকে। এর সাথে অন্য কোন দেশীয় চ্যানেল টেক্কা দিয়ে পারবে না। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ ও কলাকুশলীদের ভুলে গেলে চলবে না, দর্শকদের হাতে রিমোট কন্ট্রোল রয়েছে। অনুষ্ঠান ভালো না হলে, দর্শক চ্যানেল পালটে দেবেন। সুতরাং, শুধু গণমাধ্যমই যে দর্শকদের রুচি তৈরি করে দেয়, তা নয়, বরং দর্শকের রুচিও গণমাধ্যমের মান তৈরি করে দেয়; একথাও ভাবতে হবে।
লেখক: লেখক ও শিক্ষক