আবার সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা
প্রকাশ : ০২ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:৫৫
আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের প্রতি আমরা যেসব নিষ্ঠুরতা করে থাকি তার মাঝে একেবারে এক নম্বরের নিষ্ঠুরতাটি নিশ্চয়ই তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাটি। আমি নিশ্চিত আজ থেকে অনেকদিন পর যখন সবাই এই সময়ের ভর্তিপরীক্ষা নামের এই নিষ্ঠুরতার কথাটি জানবে তখন তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়ে ভাববে– আমরা কেমন করে আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়েদের উপর এত বড় নিষ্ঠুরতাটি চাপিয়ে দিতে পেরেছিলাম?
তারা যদি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে তাহলে দেখবে ভর্তিপরীক্ষা নামের এই প্রক্রিয়া মোটেও ‘অ্যাকাডেমিক’ নয়, এটি আসলে ‘বাণিজ্যিক’ অর্থাৎ শিক্ষকেরা কীভাবে বাড়তি কিছু টাকা রোজগার করতে পারবে সেটি নিশ্চিত করাই এর প্রধান কারণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ কথার সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল সেখানে সব ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলররা ছিলেন, আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কীভাবে সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নেওয়া সম্ভব তার উপরে একটি প্রেজেন্টেশান দেওয়া। আমি গাধা প্রকৃতির মানুষ, তাই সরল বিশ্বাস বড় বড় ভাইস চ্যান্সেলরদের সমন্বিত ভর্তিপ্রক্রিয়া কীভাবে নেওয়া যায় তার উপর ‘জ্ঞান’ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, তাঁরা কেউ কোনো আগ্রহ দেখাননি। একজন সরাসরি বলেই ফেলেছিলেন, তিনি যদি এই প্রস্তাব নিয়ে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কাছে ফিরে যান তাহলে তাঁর শিক্ষকেরা তাঁর বারোটা বাজিয়ে ফেলবেন।
কাজেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভাইস চ্যান্সেলররা এবং শিক্ষকেরা বহলে তবিয়তে আছেন শুধুমাত্র এই দেশের ছেলেমেয়েদের বারোটা বেজে যাচ্ছে!
ন্যাড়া বেলতলায় যায় না। আগেই বলেছি আমি গাধা প্রকৃতির, তাই ন্যাড়া হয়েও বেলতলায় শুধু যে যাই তা নয় বেলতলায় ঘুরাঘুরি করতে থাকি। এখন ভর্তিপরীক্ষার মরশুম এই দেশের ছেলেমেয়েরা এই নিষ্ঠুরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাই মনে হল সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষার কথাটি আরও একবার সবাইকে মনে করিয়ে দিই অর্থাৎ আরও একবার বেলতলায় যাই।
এই মুহূর্তে ভর্তিপরীক্ষা নামে যে নিষ্ঠুরতা হচ্ছে তার অনেক সমস্যা যারা পরীক্ষা নেন তারা সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। যারা এই পরীক্ষা দেয় তারা টের পায়। আমি যেহেতু অনেক দিন প্রক্রিয়াটি খুব কাছ থেকে দেখেছি, তাই তার সমস্যাগুলোর কথা জানি, সেগুলো এ রকম:
১.
আমাদের দেশে এখন ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং যেহেতু সবাই আলাদা আলাদাভাবে ভর্তিপরীক্ষা নিতে চায় তার জন্যে কমপক্ষে ৩৭টি ছুটির দিন প্রয়োজন। বিষয়টি আরও জটিল, কারণ বড় বড় ইউনিভার্সিটিগুলোর ইউনিটগুলোর পরীক্ষা আলাদা আলাদাভাবে হয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি কিংবা বিভাগেরও আলাদা আলাদা ভর্তিপরীক্ষা হয়। কাজেই এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হওয়া এবং ক্লাশ শুরু হওয়ার মাঝখানের সময়টিতে কোনোভাবেই সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের ভর্তিপরীক্ষা শেষ করতে পারবে না। কাজেই একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষা হয়। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে তারা ভর্তিপরীক্ষার ভালো তারিখগুলো দখল করে ছোট ছোট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিপদের মাঝে ফেলে দেয়।
একেবারে সোজা হিসাবে কেউ যদি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার জন্যে এক বা একাধিক দিন নির্ধারণ করে দিতে চায় (মেডিকেল এবং ডেন্টালসহ) সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই অসম্ভব একটা বিষয়কে সম্ভব করার জন্যে যেটি করা হয় সেটি এক ধরনের চরম নিষ্ঠুরতা। একই দিনে দুই বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের যদি পরীক্ষা থাকে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের রাতের বাসে দেশের অন্য প্রান্তে ছুটে যেতে হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই দেশের একজন ছাত্র বা ছাত্রীর দেশের যে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় অংশ নেওয়ার অধিকার রয়েছে কিন্তু তারা সেটি করতে পারে না।
২.
ভর্তিপরীক্ষায় অংশ নিতে টাকার দরকার হয়। রেজিস্ট্রেশানের জন্যে টাকা লাগে, পরীক্ষা দিতে যাওয়ার জন্যে টাকা লাগে, অপরিচিত শহরে থাকার জন্যে টাকা লাগে, সবকিছু মিলিয়ে পরিমাণটি কম নয়। অনেক সময়েই সাথে অভিভাবকেরা যান, কাজেই টাকার পরিমাণটাও বেড়ে যায়। কাজেই একজন ছাত্র বা ছাত্রী যত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিতে চাইবে তাকে তত বেশি টাকা খরচ করতে হবে। কাজেই গরীব বাবা-মায়ের গরীব সন্তান শুধুমাত্র আশেপাশের কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারে। মধ্যবিত্ত নিম্ন-মধ্যবিত্ত হয়তো কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারে, কাজেই তাদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ বেড়ে যায়।
বিত্তশালীদের জন্যে টাকা সমস্যা নয়, তারা যে কয়টি ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দেয়, এসি বাস, ফার্স্টক্লাস ট্রেন কিংবা প্লেনে করে ভর্তিপরীক্ষা দিতে যায়, ভালো হোটেলে রাত কাটায়, তাই তাদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ অনেক বেড়ে যায়।
সোজা কথায় এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ গরীব বাবা-মায়ের গরীব সন্তানের জন্যে নয়, বিত্তশালী পরিবারের মেধাবী সন্তানের জন্যে।
৩.
ভর্তিপরীক্ষায় অংশ নিতে মেয়েদের সমস্যা ছেলেদের থেকে বেশি, মা-বাবারা অনেক সময়েই তাদের ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্যে দেশের নানা অচেনা শহরে নিয়ে যেতে চান না। কাজেই অনেক মেয়েই শুধু তার নিজের শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্যে ভর্তিপরীক্ষা দিতে পারে। সেখানে সুযোগ পেলে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়। সুযোগ না পেলে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ভাগ্য মেনে নেয়।
৪.
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষার দিন-তারিখগুলো এলোমেলো। কাজেই একজন ছাত্র বা ছাত্রী কোনো এক শহরের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিয়ে ছুটতে ছুটতে একটা বাসে উঠে, সারা রাত বাসে করে দেশের অন্য প্রান্তের কোনো এক শহরে হাজির হয়। সেখানে বিশ্বাম নেওয়া দূরে থাকুক, অনেক সময় বাথরুমে যাওয়ার সুযোগ পর্যন্ত থাকে না। অচেনা শহরের অচেনা পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত ক্ষুধার্ত নিদ্রাহীন চোখে ভর্তিপরীক্ষা দিতে যায়। কতটুকু পরীক্ষা দিতে পারে আমি জানি না, শুধু অনুভব করতে পারি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা একটি তরুণ বা তরুণী ভাগ্যটুকু নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলি। কেন খেলি? কিছু বাড়তি টাকা রোজগার করার জন্যে।
৫.
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফলাফল ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের ভর্তি না করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে আলাদাভাবে ভর্তিপরীক্ষা নেয়, তার কারণ হিসেবে দেখানো হয় যে, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাটি মানসম্পন্ন নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে, তারা ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার জন্যে যে প্রশ্নগুলো তৈরি করে সেগুলো মানসম্পন্ন? কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পারবে, আমি তাদের সেল্যুট করছি, কিন্তু আমি জানি বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পারবে না। ভালো করে খুঁজলে দেখা যাবে বিভিন্ন গাইড বই কোচিং সেন্টারের প্রশ্ন দিয়ে ভর্তিপরীক্ষা নেওয়া হয়েছে।
ভর্তিপরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার পর কোচিং সেন্টারগুলো বড় বড় করে পত্রপত্রিকায় ছেলেমেয়েদের ছবি ছাপিয়ে নিজেদের বিজ্ঞাপন জাহির করে। ভর্তিপরীক্ষা-সংক্রান্ত জটিলতার জন্যে একবার হাই কোর্ট আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইউনিটের ভর্তিপরীক্ষা পর্যালোচনা করতে দিয়েছিল। তখন আমি এক ধরনের বিস্ময় এবং আতঙ্ক নিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, ভর্তিপরীক্ষার প্রত্যেকটি প্রশ্ন কোনো না কোনো গাইড বই থেকে নেওয়া।
যদি নিম্নমানের গাইড বই কোচিং সেন্টারের প্রশ্ন দিয়েই পরীক্ষা নেওয়া হবে তাহলে আমাদের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফলাফল দোষ করল কী? কেন আদৌ ভর্তিপরীক্ষা নিতে হবে?
৬.
ভর্তিপরীক্ষাগুলো খুব অযত্ন এবং অবহেলার সাথে নেওয়া হয়। প্রত্যেকবার পরীক্ষা নেওয়ার পর দেখা পায় প্রশ্নে ভুল আছে কিংবা এক প্রশ্ন দুই জায়গায় চলে এসেছে। প্রশ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো আত্মবিশ্বাস নেই। যদি থাকত তাহলে পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্র তার সঠিক উত্তর প্রকাশ করে দিত। ছেলেমেয়েরা নিজেরাই বের করে ফেলত কে কেমন পরীক্ষা দিয়েছে। পুরো প্রক্রিয়াটাতে স্বচ্ছতা থাকত।
৭.
যেহেতু সব ছেলেমেয়েকেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দিতে হয় তাই ছোট বড় সব বিশ্ববিদ্যালয় এতগুলো ছেলেমেয়ের ভর্তিপরীক্ষা একা নিতে পারে না। আশেপাশের স্কুল-কলেজের সাহায্য নিতে হয়। ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার সময় শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ভর্তিপরীক্ষার ডিউটি দেন না, কর্মকর্তারা ডিউটি দেন। শুধু শিক্ষক-কর্মকর্তা নয়, তাদের স্ত্রী কিংবা স্বামীরাও দেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষকেরাও দেন। কাজেই পরীক্ষাগুলো ঠিকভাবে নেওয়া হয় না। পরীক্ষা শেষে যখন উত্তরপত্রগুলো আসে সেগুলো দেখলেই বোঝা যায় সেখানে প্রক্রিয়াগত কী পরিমাণ ভুল রয়েছে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একসঙ্গে এত ছেলেমেয়ের পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষমতা নেই, তারপরেও সেটা নিতে হয়; না নিয়ে উপায় নেই।
৮.
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হওয়ার সাথে সাথে যদি খুব দ্রুত ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে নেওয়া যেত তাহলে কোচিং সেন্টারগুলো ব্যবসা করার সুযোগ পেত না। কিন্তু যেহেতু দীর্ঘসময় ধরে ভর্তিপরীক্ষা নিতে হয় তাই কোচিং সেন্টার ব্যবসা করার সুযোগ পায়। এই দেশে কোচিং সেন্টারগুলো যেভাবে ব্যানার-ফেস্টুন-পোস্টার দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয় তার সাথে শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারের তুলনা করা যায়। এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষার সাথে কোচিং সেন্টারের এক ধরনের অদৃশ্য যোগাযোগ রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপরীক্ষার জন্যে কোচিং সেন্টাগুলো যে রমরমা ব্যবসা করে তার সাথে আর কিছুর কোনো তুলনা নেই। মফস্বল থেকে থেকে ছেলেমেয়েরা ঢাকা এসে মেস, হোটেল, বাসা ভাড়া করে কোচিং করে শুধুমাত্র কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্যে।
প্রায় প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সিটের জন্যে অনেক ছেলেমেয়ে ভর্তিপরীক্ষা দেয়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার সময় হঠাৎ করে দেখা যায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগে ভর্তি করার জন্যে ছেলেমেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু এরকম উদাহরণও আছে যেখানে কোনো একটি বিভাগে ওয়েটিং লিস্ট থেকে ডেকেও সিট পূরণ করা যায়নি বলে সিট ফাঁকা রেখে ভর্তিপ্রক্রিয়া শেষ করতে হয়েছে। এই বিষয়গুলো ঘটে, কারণ প্রায় সব ছাত্র সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপরীক্ষা দেয়। যারা ভালো করে পরীক্ষা দিতে প্রস্তুতি নিয়েছে তারা অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়, কিন্তু ভর্তি হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সিট ফাঁকা থেকে যায়। তখন মাইগ্রেশন করে নিচ থেকে ছাত্রদের এনে ভর্তি করা হয়।
প্রক্রিয়াটি জটিল, এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়ার জন্যে প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়ে যায়।
৯.
সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা না নেওয়ার জন্যে আরও অনেক ধরনের সমস্যা হতে পারে, কিন্তু আপাতত শেষ একটি বলেই থামা যাক। সেটি হচ্ছে পুরোপুরি মানবিক। এইচএসসি পরীক্ষা। এই পরীক্ষা দিয়ে তাদের খানিকটা আরাম করার কথা। যে পছন্দের বইটি পড়বে বলে অপেক্ষা করছিল সেটি পড়ার কথা; যে জায়গাটিতে বেড়াতে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছিল সেখানে বেড়াতে যাবার কথা; যে গ্রামের বাড়িতে অনেকদিন যাওয়া হয়নি সেখানে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের সাথে সময় কাটানোর কথা। কিংবা কোনো কিছু না করেই বিছানায় শুয়ে গান শোনার কথা। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারে না। পরীক্ষা শেষ করে তাদের ভর্তিপরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হয়। আমি লক্ষ্য করেছি, এই বয়সের ছেলেমেয়েরা আজকাল এটাকে ভর্তিপরীক্ষা না বলে ‘ভর্তিযুদ্ধ’ বলতে শুরু করেছে।
কেন একটা ছেলে বা মেয়েকে পড়াশোনা করার পর একটা যুদ্ধ করতে হবে? কেন তারা একটি দিনও শান্তিতে ঘুমাতে পারবে না? যাই হোক আমি এখানে যে কথাগুলো লিখেছি সেই কথাগুলো সবাই জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ভাইস চ্যান্সলররাও জানেন, কিন্তু তারপরেও কেউ ছেলেমেয়েদের এই নিষ্ঠুরতা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন না।
যশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর একবার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, কেউ যখন করছে না আমরা দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একবার একটি ভর্তিপরীক্ষা করি, পরের বার হয়তো অন্য কেউ যোগ দেবে, এভাবে ধীরে ধীরে কালচারটি গড়ে উঠবে।
আমি খুব উৎসাহ নিয়ে আমাদের এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগটিতে যোগ দিয়েছিলাম। প্রক্রিয়াটি যখন একেবারে শেষ পর্যায়ে তখন সিলেট শহরের বামপন্থী দলগুলো প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার জন্যে আন্দোলন শুরু করে দিল।
সারা জীবন শুনে এসেছি বামপন্থী দল গণমানুষের জন্যে কাজ করে, কিন্তু নিজের চোখে যখন দেখতে পেলাম এটি সত্যি নয় তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। আমি মনে মনে এই বামপন্থী দলগুলোর বড় বড় নেতাদের খুঁজে বেড়াই তাদের জিজ্ঞেস করার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচার কমানোর জন্যে এই উদ্যোগটির বিরোধিতা তারা কেন করেছিলেন?
নীতি এবং আদর্শের বড় বড় কথাগুলো কি শুধুমাত্র ‘কথা’? যে কথা কাজে লাগালে মানুষের উপকার হয় সেগুলোতে তাদের এত বিতৃষ্ণা কেন? যশোর এবং শাবিপ্রবির যৌথ ভর্তিপরীক্ষার বিরুদ্ধে বামপন্থী দল যখন বিএনপি এবং জামায়াতের সাথে একত্র হয়ে গেল তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আর প্রক্রিয়াটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সাহস পেল না। এ রকম চমৎকার একটা উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখতে পেল না।
আমি অনেকদিন থেকেই সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার পক্ষে কথা বলে আসছি (কেউ অবশ্য শুনছে বলে মনে হয় না)। আমি যে কোনো রকম যুক্তি ছাড়া কথা বলছি তা না, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল বিশাল ভর্তিপরীক্ষার সাথে জড়িত থেকে একেবারে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো অন্যান্য শিক্ষকদের পাশে বসে নিজের হাতে করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ভাইস চ্যান্সেলরদের খুঁটিনাটিতে ঢোকার সময়-সুযোগ থাকে না।
তাই তাঁরা প্রক্রিয়াগুলোর ডিটেলস জানতে পারেন না, ভাসা ভাসা জেনেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আমি সে তুলনায় যথেষ্ঠ সৌভাগ্যবান আামি এই প্রক্রিয়ার খুঁটিনাটি জানি। শুধু তাই নয়, আমার তরুণ সহকর্মীদের নিয়ে প্রথমবার মোবাইল টেলিফোনে এসএমএস পাঠিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করে একসময় অনেক পরিশ্রম বাঁচিয়ে দিয়েছি।
এখন ইন্টারনেট অনেক সহজলভ্য হয়েছে, আরও সহজে আরও অনেক কিছু করা সম্ভব হয়ে গেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একবার আমাদের ভর্তিপ্রক্রিয়ায় সাহায্য করতে বলা হয়েছিল, তখন চার লক্ষ ছেলেমেয়ের ভর্তিপ্রক্রিয়ায় আমরা যুক্ত ছিলাম। তাদের উত্তরপত্র প্রক্রিয়া করে দিয়েছিলাম। এবারে যখন মেডিকেল কলেজের ভর্তিপরীক্ষা শুরু হয়েছে তখন হঠাৎ করে জানতে পারলাম, আমাদের কয়েকজনকে এই পরীক্ষা প্রক্রিয়াটি ঠিকভাবে করা হচ্ছে কী না, সেটা ‘তদারক’ করার জন্যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্যের কাজ তদারক করা খুবই বিপজ্জনক কাজ, যিনি করছেন এবং যাঁকে করা হচ্ছে দুজনেই দুজনকে সন্দেহের চোখে দেখেন। তাই এই কাজে আমি খুব আগ্রহী ছিলাম না।
কিন্তু দায়িত্ব দেওয়া হলে না গিয়ে উপায় থাকে না। কাজেই আমি অত্যন্ত সংকোচের সাথে গিয়েছিলাম এবং অনেক বড় বিস্ময় ও আনন্দ নিয়ে আবিষ্কার করেছি এই দেশের বড় বড় ডাক্তার এবং শিক্ষকেরা আমাকে একজন তদারককারী না ভেবে নিজেদের একজন হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এবারের মেডিকেল ভর্তিপ্রক্রিয়াটি যে অসাধারণ নৈপুন্য নিয়ে শেষ করা হয়েছে তার কোনো তুলনা নেই। (সেটি মোটেও এক কথায় শেষ করা যাবে না, আমাকে কোনো একসময় গুছিয়ে লিখতে হবে।) কাজেই তারা কীভাবে সারা দেশের সব মেডিকেল পরীক্ষার্থীর ভর্তিপরীক্ষা নিয়েছেন আমি সেটা খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।
আমি এখন আগের থেকে আরও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি এই দেশে সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি (বা দুই-একটি) সমন্বিত ভর্তিপরীক্ষা নেওয়ার মাঝে বিন্দুমাত্র সমস্যা নেই। তার জন্যে মাত্র একটি কাজ করতে হবে, সেটি হচ্ছে সবাই মিলে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া। (আমি অবশ্য এটাও জানি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কখনও নিজ থেকে সেই সিদ্ধান্ত নেবে না তাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করতে হবে।)
ন্যাড়া বারবার বেল তলা যায় না, কিন্তু আমি ন্যাড়া অবস্থায় একাধিকবার বেলের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েও কেন এখনও বেলতলায় যাচ্ছি তার একটা বড় কারণ আছে। অনেকে কারণটি অনুমানও করতে পারবেন, সেটি হচ্ছে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এই দেশের সব ভাইস চ্যান্সেলরদের একটি সভায় তাদের অনুরোধ করেছেন সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলে একটি ভর্তিপরীক্ষা নিয়ে ছেলেমেয়েদের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে। আমাদের দেশের শিক্ষিত ভাইসচ্যান্সেলররা একেবারে নিজের চোখে দেখেও ছেলেমেয়েদের কষ্টটি কোনোদিন অনুভব করতে পারেননি, কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনে থেকেও ছেলেমেয়েদের কষ্টটি অনুভব করেছেন, সেজন্যে তাঁর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
এখন কী হবে আমি জানি না। অনুমান করছি, রাষ্ট্রপতির এই অনুরোধটিকে বাংলাদেশের ভাইস চ্যান্সেলররা হেলাফেলা করে ফেলে রাখতে পারবেন না। লোকদেখানোর জন্যে হলেও তাদের এটা নিয়ে বসতে হবে, আলোচনা করতে হবে এবং এর পক্ষে কিংবা বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা যদি পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাদের আগে থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি। এই দেশের উচ্চশিক্ষার জন্যে এর থেকে বড় কাজ আর কিছু হতে পারে না।
আর যদি এর বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নেন? কিংবা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নেন যেটা দিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুরোধটি বিবেচনা করা হবে কিন্তু নানা ধরনের যুক্তি দেখিয়ে সবাইকে বোঝানো হবে যে এটি আসলে করা যাবে না, তখন আমরা কী করব?
তখন শুধু বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই কি আমরা থেমে থাকব?
লেখক: লেখক ও অধ্যাপক, কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ, শাবিপ্রবি