জীবনের দামে আমরা চিনি চাই না
প্রকাশ : ১৪ নভেম্বর ২০১৬, ২১:৫৬
ঐতিহাসিকভাবেই গুড় ও চিনি দেশী পণ্য। তাল, খেজুর, গোলপাতা কি আখ থেকে গুড় ও চিনির মতো প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উদ্ভাবন হয়েছিল এ অঞ্চলেই। ষোড়শ শতকে বাংলার উন্নত মানের চিনি সুপরিচিত ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ চিনি রফতানি করত। ১৭৯৫ সালে এ রফতানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ২০ হাজার ও ১৮০৫ সালে ৩৩ লাখ ২৪ হাজার মণ। আগে থেকেই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আখ অঞ্চল। ব্রিটিশ আমলে ঐতিহ্যবাহী খেড়ি কুশল, সোম কুশল ও গেণ্ডারির আবাদ হতো এখানে। সেই আখ গরু দিয়ে মাড়াই করে তৈরি হতো চিনি-গুড়।
আর এই চিনি উৎপাদনের জন্যই গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫ নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরহিমপুর মৌজার ১ হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয় তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। এলাকাটি সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম নামে পরিচিত। অধিগ্রহণের ফলে ১৫টি আদিবাসী গ্রাম ও পাঁচটি বাঙালি গ্রাম উচ্ছেদ হয়। কথা ছিল অধিগ্রহণের নামে গ্রামের মানুষের কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া এ জমিনে আখ চাষ হবে। আখ ভিন্ন অন্য কোনো ফসল চাষ বা চিনিকলের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সম্পর্কহীন কোনো কিছু করা হলে কেড়ে নেয়া এসব জমি আবারো ভূমি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। চিনিকল কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ও অব্যস্থাপনার দরুন ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ কারখানার উত্পাদন বন্ধ হয়ে যায়। চিনিকল কর্তৃপক্ষ নানাভাবে অধিগ্রহণকৃত জমি বহিরাগত প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দিতে শুরু করে। জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু আদিবাসী ও বাঙালিরা পুরো ঘটনাটি প্রশাসনের নজরে আনে। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ গাইবান্ধা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকা সরেজমিন তদন্ত করেন। তদন্তকালে তারা উল্লিখিত জমিতে ধান, তামাক ও মিষ্টি কুমড়ার আবাদ দেখতে পান। এরই ভেতর গাইবান্ধা জেলা প্রশাসন গত ১০ মে উক্ত ভূমিতে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয় সরকার বরাবর। বাপ-দাদার জমিনে অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে আদিবাসী-বাঙালি ভূমিহীনদের ভূমি আন্দোলন তৈরি হয়েছে। আন্দোলন দমাতে চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও গাইবান্ধা প্রশাসন ভূমিহীনদের সংগ্রামে খুন-জখম-হামলা-মামলার বাহাদুরি চালিয়ে যাচ্ছে।
অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া জমিনে ভূমি-উদ্বাস্তু প্রায় চার হাজার পরিবার মাদারপুর মৌজার কুয়ামারা পুকুরের উত্তর ও দক্ষিণে এবং নরেঙ্গাবাদ মৌজার বাছুরমারী পুকুরের উত্তর-পশ্চিমপাড়ে ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস শুরু করে। সাঁওতালরা তাদের মানঝিথান তৈরি করেছে, বাঙালি মুসলমানরা মসজিদ তুলেছে, জমিনে খেসারি কলাইসহ শস্য ফসল বুনেছে। চলতি বছরের ১ জুলাই চিনিকল কর্তৃপক্ষ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা পাঁচটি মৌজা পরিদর্শন করে নিজেদের জমিনে নতুনভাবে বসতি স্থাপনকারী ভূমি মালিকদের ঘরবাড়ি তুলে চলে যাওয়ার কথা বলেন। ১২ জুলাই মিল কর্তৃপক্ষ পুলিশ ও লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশের গুলিতে বেলোয়া গ্রামের মাঝি হেমব্রম, বুলাকিপুর গ্রামের মাইকেল মার্ডি, গুচ্ছগ্রামের সোবান মুরমু ও বেলোয়া গ্রামের মুংলী টুডু চারজন গুলিবিদ্ধ হন এবং অনেকেই আহত হন। তার পর তো এই ৬ নভেম্বরের ভয়ঙ্কর মর্মস্পর্শী ঘটনা। গণমাধ্যমে ছবি এসেছে, পুলিশ নিরীহ আদিবাসী গ্রামের দিকে বাহিনীসমেত বন্দুক তাক করে আছে। আগুন দেয়া হচ্ছে ছাপড়া ঘরে, পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
৬ নভেম্বর রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল কর্তৃপক্ষ তাদের শ্রমিক-কর্মচারী ও ভাড়াটে মাস্তান বাহিনী নিয়ে হামলা চালায় গোবিন্দগঞ্জের সাপমারা ইউনিয়নের মাদারপুর গ্রামের নিরীহ আদিবাসী ও বাঙালিদের ওপর। চিনিকল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশের ভাষ্য, তারা জমি থেকে বীজ-আখ কাটতে সেখানে গিয়ে ‘অবৈধ দখলদারদের’ উচ্ছেদ করেছে। পুলিশ ও চিনিকলের আক্রমণে নিহত মঙ্গল মার্ডী (৫০) এবং শ্যামল হেমব্রমের (৩৫) লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশ মঙ্গল মার্ডীর মরদেহ নিয়ে গেছে। মুংলী সরেন ও রুবেন সরেন নামে দুই সাঁওতাল প্রবীণকে ঘটনার পর থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হামলায় মারাত্মকভাবে জখমপ্রাপ্ত দিজেন টুডু ঢাকায় চক্ষু হাসপাতালে এবং চরণ সরেন ও বিমল কিসকু রংপুর মেডিকেল কলেজে চিকিত্সাধীন আছেন। মাঝি হেমব্রমকে এ পর্যন্ত দুবার গ্রেফতার করা হয়েছে।
চিনি উত্পাদনের জন্য রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকল দীর্ঘ ৫৬ বছর ধরে স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের জমি কেড়ে তাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে চলেছে। অথচ চিনি উত্পাদনের জন্য মিল কর্তৃপক্ষ কি রাষ্ট্র কখনই আন্তরিক ছিল না। তাই বারবার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে কারখানা। ২০০৪ সালে বন্ধের পর ২০০৬ সালের ১৬ জুলাই মিলটি পুনরায় চালু করার নির্দেশ দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০০৭-০৮ মৌসুমে ৩৩ দিন চালু থাকে এবং ৫ হাজার ৩২৫ টন চিনি উত্পাদন হয়। ২০১৩-১৪ মৌসুমে ৫ হাজার ২৬৮ এবং ২০১৪-১৫ মৌসুমে ২ হাজার ৪৪০ টন চিনি উত্পাদন হয়। বছরে ১৫ থেকে ৪৫ দিন কারখানা চালু থাকে। ২০১২-১৩ মৌসুমের ৫৬তম আখ মাড়াই কার্যক্রম উদ্বোধনের পর মাত্র ১০ ঘণ্টা পরেই বন্ধ হয়ে যায় চিনিকলের কার্যক্রম। রংপুর (মহিমাগঞ্জ) চিনিকলে প্রচুর চিনি অবিক্রীত থেকে যায়। ২০১৩ সালে ৩ হাজার ২৪৬ টন চিনি বস্তাবন্দি হয়ে দুই বছর ধরে গুদামে পড়ে গলে গেছে। রংপুর চিনিকল আখচাষী কল্যাণ গ্রুপের সভাপতি তখন গণমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন, চিনি শিল্প সংস্থার ভুল নীতির কারণে এত চিনি অবিক্রীত থেকে যায়। একটি হিসাবে দেখা যায়, তিন বছরে প্রায় ৩১ কোটি টাকার চিনি অবিক্রীত ছিল। শুধু তা-ই নয়, মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দিতেও সমস্যা করে। চিনিকলে কর্মরত প্রায় ৮১২ শ্রমিক তিন মাসের বকেয়া বেতন-ভাতা, বোনাস ও পোষণ ভাতার দাবিতে ২০১৫ সালের ১২ জুলাই মিল চত্বরে বিক্ষোভ ও ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন।
বর্তমান সরকার বলছে, তারা চিনি শিল্প রক্ষায় দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। আসলেই কি তা-ই? রংপুর চিনিকলের বাস্তবতায় আমরা কী দেখি? সেখানে তো নিয়মমতো আখই চাষ করা হয়নি, জমিন সব লুটপাট হয়ে গেছে। আখ উত্পাদনে রাষ্ট্র কখনই আন্তরিক ছিল না, রংপুর চিনিকলও চিনি উত্পাদনে তত্পর ছিল না। এটি ভূমি-উদ্বাস্তু কৃষক বা আন্দোলনকারীদের বক্তব্য নয়। এটি সরকারি প্রতিবেদনেরই ভাষ্য। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরো খোলাসা হয়। ২০১১-১২ সালে রংপুর চিনিকলের জন্য চাষীর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় আট হাজার একর এবং খামারের জমিতে শূন্য। চাষীর জমিতে আখ চাষ করে ওই বছর ৩ হাজার ৯৫৭ একর জমিতে আখ চাষের প্রকৃত অর্জন হয়। দেখা যায়, একই অর্থবছরে ইক্ষু মাড়াই লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয় ৭০ হাজার টন কিন্তু অর্জিত হয় ৪০ দশমিক ৯৪ টন। চিনি উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয় ১৫ হাজার টন কিন্তু অর্জিত হয় মাত্র ১০ দশমিক শূন্য ৭ টন। আরেকটি বিষয়ও স্পষ্ট করা জরুরি, চিনিকলের এই আখ কতটা নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে চাষ করা হচ্ছে। হাতে গোনা কিছু আখ চাষ হলেও তার পুরোটাই রাসায়নিক বিষনির্ভর। এভাবে চাষ হওয়া আখ থেকে তৈরি চিনি আমরা সরাসরি খাই, চিনি তো আর কেউ ধুয়ে খায় না। উল্লিখিত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১১-১২ সালে আখ চাষের জন্য ১ হাজার কেজি কার্বোফুরান, ৬৩০ কেজি ক্লোরপাইরিফস ও ৬৭৮ কেজি কার্বোডাজিমের মতো ভয়াবহ রাসায়নিক বিষ ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত চিনিকল কর্তৃপক্ষ টেন্ডার নোটিস দিয়ে আখ চাষ করাত, তখন আশপাশের অনেক ভূমি-উদ্বাস্তু মানুষও অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নেয়া নিজেদের জমিতে আখ চাষ করত। তখন দৈনিক মজুরি ছিল দেড় টাকা। কিন্তু চিনিকল কর্তৃপক্ষ যখন আখের জমি ইজারা দেয়া শুরু করে তখন এভাবে আখ আবাদ বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে দেখা যায়, রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলে যা চলছে, এ পুরো প্রক্রিয়াটিই দেশের রাজস্ব ও শিল্প খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বরং সরকার ও আইন সম্পর্কে ভূমিবঞ্চিত হাজার হাজার মানুষের মনে এক ধরনের বঞ্চনা ও ক্ষোভ জমা হচ্ছে দিনের পর দিন।
চিনিকল ও পুলিশি হামলায় চুরমার হয়ে যাওয়া মাদারপুর মৌজার আদিবাসী ও বাঙালিরা এখন নিঃস্ব ও নিরন্ন। ঘর নেই, খাবার নেই, খাবারের কোনো সংস্থানও নেই। দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কারখানাগুলোয় দিনের পর দিন চিনি বস্তাবন্দি হয়ে পচে গলে যায়। সেখানে প্রশাসন কি জনপ্রতিনিধিরা নিশ্চুপ থাকে। আর আজ আখ চাষের মিথ্যা সাফাই দিয়ে জমি লিজ ও সাবলিজের বাণিজ্যকে চাঙ্গা রাখতে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্মে প্রশ্নহীনভাবে একের পর এক আদিবাসীদের খুন-জখম-উচ্ছেদ করা হচ্ছে। মানুষের জীবনের দামে আমরা কোনোভাবেই চিনি চাই না।
লেখক: গবেষক