সেক্সুয়্যাল হ্যারাসমেন্ট ও একটি প্রতিবাদ

প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০১৬, ০১:১৫

চ্যাপ্টার ওয়ান: ২৭ অক্টোবর ২০১৫

সন্ধ্যায় অফিস থেকে বের হয়ে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম। অফিস থেকে কাছে হয় তাই ল্যাব এইডে গেলাম গুলশান দুই এর। গলায় শব্দ একেবারেই নেই তাই নওশীন ও রনি (সহকর্মী ছোট ভাই-বোন) নিজ দায়িত্বে এবং অনেকটা জোর করেই রিকশা ঠিক করে দিয়ে গেলো। গিয়ে ফ্রন্ট ডেস্ক এর এক ছেলেকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম গলার ভালো ডাক্তার কে আছে? একটা কার্ড দিয়ে বলল লিফটের তিনে যান। গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম সে ডাক্তার নেই। আবার নিচে নেমে সেই ছেলেটাকেই জানালাম। জিভ কেটে বলল "স্যরি"। এবার আরেকটা কার্ড দিয়ে বলল "প্রথমে যার কার্ড দিয়েছিলাম উনি বেশী ভাল। উনি তো নেই, একে দেখাতে পারেন"। উঠলাম উপরে। জানলাম ডাক্তার আসতে আরো মিনিট চল্লিশ লাগবে। হিমশীতল 'অপেক্ষা ঘর'। একটু ভাবলাম, অপেক্ষা না করে ইউনাইটেড হসপিটালে যাবো কিনা। আরো দুইবার রিককশা ঠিক করতে হবে ভেবে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। যতভাবে সম্ভব ওড়না-স্কার্ফ সব পেঁচিয়ে বসে থাকলাম পঞ্চাশ মিনিট মতন। ডাক আসলো।

মাঝবয়সী ডাক্তার। প্রথমে আমাকে পাশের চেয়ারে বসানোর কায়দাটাই পছন্দ হলো না। ইগ্নোর করলাম। যতটুকু সম্ভব ফ্যাস ফ্যাস করে বললাম "প্রব্লেমটা লিখে এনেছি একটু পড়ে দেখেন প্লিজ"। পড়ে তারপর আমার গলা চেক করলেন, নাক চেক করলেন, কান চেক করলেন। স্টেথোটা বসালেন যখন তখন সন্দেহ হলো। এই প্রথম দেখলাম কোন ডাক্তার রোগীর দুই গালে হাত দিয়ে জ্বর দেখেন। বললেন "অনেক তো জ্বর"। আর আমাকে তিনবার করে বললেন ইজি হয়ে বসতে। আমি জানি আমার জ্বর আছে কিন্তু মোটেই তা অনেক নয়। 

জানতে চাইলেন আগের আর কোন হিস্ট্রি আছে কিনা। আর এসিডিটি হয়ে বুক জ্বলে কিনা। উত্তর দিলাম- "গত সপ্তাহেই পেটের প্রব্লেম এর জন্য ওষুধ খেয়েছি, তিনদিনের এন্টিবায়োটিক শেষ। সারভিপেপ এখনো খাচ্ছি। ডাক্তার চেক করে বলেছিলো ইনফেকশন আছে কিন্তু টেস্ট করানোর সুযোগ হয়নি"। অলমোস্ট লাফ দিয়ে উঠলো ডাক্তার।

-পেটে ইনফেকশন? কোথায়?
-পেটের ডান পাশটাতে কোন একটা পয়েন্টে চাপ দিলে বেশ ব্যথা পাচ্ছিলাম।
-আসেন তো দেখি (বেড দেখিয়ে দিলেন)

এক মূহূর্ত ভাবলাম, কী হচ্ছে? নাক, কান, গলার ডাক্তার পেট কেন চেক করবে? উঠে যেতে যেতে টের পেলাম সে চট করে দরজাটা লক করে দিলো। আমার সমস্ত স্নায়ু মনে হল টানটান এবং প্রস্তুত প্রয়োজনে যে কোনো আঘাত করতে। গেলো সে পর্ব। খুব কিছু হলো না, পেটে সে যা চাপ দিয়ে দেখলো তা একেবারেই প্রফেশনাল মনে হলো না, কেমন এলোমেলো।

ডেস্কে ফিরে এসে কাশি এবং কাশির সময় পেটে টান পড়ার সূত্র ধরে বসা অবস্থাতেই আবার পেট চেক করলেন, জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে। ফ্যাসফ্যাস করেই কাঠ কাঠ গলায় জানতে চাইলাম ‘গলার প্রব্লেমটা কী?’ যুগান্তকারী উত্তর দিলো ‘আপনার ঠান্ডা লেগেছে’। আবার জানতে চাইলাম, ‘এত বাজে অবস্থা কেন?’ ‘ওই তো, ঠান্ডা লেগেছে’। চোখ মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করলাম, "প্রব্লেমটা গলার কোথায়"? উত্তর পেলাম ‘ভোকাল কর্ডে’। আরো কয়েকদিন পর গলার অবস্থা ভালো হলে কী কী টেস্ট করবেন সেগুলো বললেন।

বের হয়ে আসলাম। টাকা দিলাম। নিচে নেমে সেই ছেলেটাকে একটা স্লিপে লিখে দিলাম- "Do not refer Dr. X to any woman or girl. I did not find him comfortable or professional. I felt strange and awkward at his approach". সে আমাকে অনুরোধ করলো তাদের জিএম এর সাথে কথা বলতে। স্লিপটা আমার সামনেই সে জিএম কে দেখালো। ইশারা ও আধা ভাষায় আমি বিস্তারিত তাকে জানালাম আর অনুরোধ করলাম যেন সে এ ব্যাপারে স্টেপ নেয়। তার চেহারাটা অনেকটা থতমত হলেও আমাকে আশ্বাস দিল।

বের হয়ে একবার মনে হলো বাসায় চলে যাই। আর ভাল্লাগছেনা। তারপর মনে হলো, এই লোকের ওষুধ তো আমি খাবো না। আমার সমস্যা আমি ওই লোকের কারণে ইগ্নোর করব কেন? রিকশা নিলাম ইউনাইটেডের জন্য। সারাটা পথ মনে হচ্ছিল পরের জন কেমন হবে আগে থেকে বুঝার উপায় কী? পরিচিত ডাক্তারেরও তো সেম রেকর্ড আছে। আগের ঘটনাগুলোও মনে পড়তে লাগলো। গলার কাছের দলা পাকানো কান্নাটা মনে হচ্ছিল গলার ব্যাথাটাকে কিছুক্ষণ পর পর ছাপিয়ে যাচ্ছে।

নিশ্চয়ই অনেক ভালো ডাক্তার আছেন এ দেশে। কিন্তু বোঝার উপায় কি? কত কত মেয়েগুলি যায় ডাক্তারের কাছে। ইউনাইটেডে তথ্যঘরে জিজ্ঞেস করলাম রোগীদের কাছে ডাক্তার সম্পর্কে রিফ্লেকশন নেয় কিনা ওরা। কিভাবে বুঝে কোন ডাক্তার মেয়েদের পক্ষে নিরাপদ। কিছু বলতে পারলো না যে ছেলেটা ওখানে ছিলো, খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেলো বেচারা।

প্রচন্ড মাথা ব্যথা হচ্ছে। ঘুম প্রয়োজন। বিশ্রাম প্রয়োজন। সকালে ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট আছে।

চ্যাপ্টার টু: ২৯ অক্টোবর ২০১৫

জিডি করে আসলাম গুলশান থানায়। জিডি করার পর থানা থেকেই পরামর্শ দিল ল্যাব এইডে যেতে। ওখানে পুলিশের লোক থাকবে। বললাম- আমার দিক থেকে যা করার আমি করলাম এর পর আপনাদের পেশাদারী দায়িত্ব অনুযায়ী যা করার করেন। আশ্বাস আসলো- কোন সমস্যা হবে না; যেহেতু অভিযোগটা আপনার, আপনি উপস্থিত থাকলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা সুবিধাজনক হবে। প্রথমে একটু ইতস্তত করলাম আবার ওই লোকের চেহারা দেখতে হবে ভেবে। তারপর ভাবলাম ওরেও ওর চেহারাটা দেখানো দরকার, এতদূর আসছি যখন বাকিটাও থাকি। বড় ভাইয়ার পরামর্শ নিয়ে নিলাম যাবো কিনা। সবুজ বাতি পাওয়া গেল। রিকশায় রওনা দিলাম। সাথে ছিল রুমি (দেবর) আর হবু জা। রনি (আমার স্পাউস) কে এসএমএস করে জানালাম।
তারপর সোজা ডাক্তারের রুমে। খুব 'সুবোধ' চেহারা নিয়ে বসে আছে। তাকে জিডির কপি পড়ায়ে তার ভাষ্য জানতে চাইলেন উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা। খুব ভাব ডাক্তারের। সে তার ভাষ্য শুরু করল এভাবে-
“উনি অপেশাদার আচরণ বলতে কী বুঝাচ্ছেন আমি জানি না, ডাক্তার হিসেবে আমি কিভাবে রোগী দেখবো সেটা তো রোগীর বলার কথা না। ডাক্তার তো রোগ বুঝার প্রয়োজনে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা করতে পারেন। এখন উনি যে এত 'সেন্সিটিভ' সেইটা তো আমি জানতাম না। জানলে হয়তো সতর্ক থাকতাম”। 
-আমি আপনার কাছে গলার সমস্যা নিয়ে আসছি আপনি পেট চেক করলেন কেন?
-সমস্যার তো নানা রকম সংযোগ থাকে একটার সাথে আরেকটার। ডাক্তার তো সে অনুযায়ী দেখতেই পারে। আপনি এত 'সেন্সিটিভ' জানলে আমি হয়তো সে অনুযায়ী দেখতাম (দ্বিতীয়বারের মত, পরেও সে আরো কয়েকবার এই কথা বলেছে)।
- আপনি দরজা লক করলেন কেন?
-দরজা লক করেছি আমাদের এখানে ছেলে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা রুমে যাওয়া আসা করে, চেকাপের সময় কেউ ঢুকলে আপনার খারাপ লাগতে পারে তাই (পুরুষরা বেঁচে গেলো, সে নিজেকে পুরুষ মনে করে না)"।
- (আমি পারলে হাহা করে হাসতাম গলায় জোর থাকলে...কী যুক্তি!!) নিয়ম এটেন্ডেন্ট রাখার আর আপনি দরজা লক করে দিলেন তার যুক্তি দিচ্ছেন?
-হ্যাঁ, অন্য সময় থাকে মহিলা এটেন্ডেন্ট, সেইদিন ছিল না। এই জন্য আপনি অস্বস্তি বোধ করে থাকতে পারেন, আমার 'হয়তো' আরো সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
-আপনি আমার 'জামার ভেতর দিয়ে' পেট চেক করলেন কেন?
-রোগীকে বেডে চেক তো করতেই হতে পারে..ব্লা ব্লা
-বেডের কথা হচ্ছেনা, আমি বেড থেকে ডেস্কে ফেরার পর আপনি কেন...(আমি একই প্রশ্ন আবার করলাম)
-কাশির সাথে পেটে ব্যথা হলে পেট তো...ব্লা ব্লা
-প্রথম কথা, পেট চেক করার পর আপনি নিজে আমাকে বলেছেন কাশি হলে পেটে টান পড়বেই, এটা খুব সাধারণ ব্যাপার। এই কথা বলার আগে আপনার তাহলে পেট চেক করা লাগলো কেন? দ্বিতীয়ত, জামার ভেতর দিয়ে কেন? আমি এক সপ্তাহ আগে পেটের সমস্যা নিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছি, সে খুবই প্রফেশনালি একজামিন করেছে, তার তো প্রয়োজন পড়েনি জামার ভেতর দিয়ে চেক করার। আপনার কেন প্রয়োজন পড়ল?
-আপনি এত সেন্সিটিভ....ব্লা ব্লা ব্লা... আমি পিজি হস্পিটালের হেন....ব্লা ব্লা ব্লা.....জেনারেল সেক্রেটারি ব্লা ব্লা ব্লা....১০ বছর ধরে ল্যাব এইডে..ব্লা ব্লা ব্লা...কেউ কখনো কমপ্লেইন করেনি....ব্লা ব্লা ব্লা... আপনি এত ব্লা ব্লা ব্লা
-আমি পুলিশ কর্মকর্তাকে অনুরোধ করলাম আমার প্রশ্নের উত্তর চাইতে। উনি ডাক্তারকে বললেন যে আমি জিডিতে যা লিখেছি এখানেও বার বার জানতে চাইছি বেড থেকে ফেরার পরের বিষয়টা; সুতরাং উনি যেভাবে বলছেন, জামার ভেতর হাত দেওয়ার ব্যাপারে আপনার কী বলার আছে বলেন।
-বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর সে বলল,
"আমি এরকম কিছু করিনাই, এটা উনার ভুল ধারণা"।
-এতক্ষণ আমি কখনো পুলিশ কর্মকর্তা আর কখনো রুমির মাধ্যমে কথা বলছিলাম। এবার আমার গলা চিরে মনে হল শব্দ হলো- "হোয়াট"!!

তারপর কথা কাটাকাটি। বের হয়ে কথা। আলাদা রুমে কথা। কী করনীয়। এর মধ্যে রনিও এসেছে। আমি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বললাম। উনারা জানালেন তারা আমার প্রথমদিনের অভিযোগের ভিত্তিতেই ওয়ার্নিং দিয়েছেন। তবে এখনই উনাকে হাসপাতালে প্রবেশাধিকার না দেওয়ার ব্যাপারে অপারগতা জানিয়ে বললেন প্রয়োজনে আমার সামনে আরো কঠোরভাবে তাকে বলা হবে এবং ভবিষ্যতে কড়া নজর রাখা হবে। বাকী রইল এই লোকের বিষয়ে এখন আমার কী স্ট্যান্ড। জানালাম-এই লোক এখন দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে সে যে অন্যায় আচরণ আমার সাথে করেছে তার জন্য এবং সাথে এই প্রমিজ করবে যে ভবিষ্যতে আর কোন মেয়ের সাথে এ ধরনের আচরণ করবে না।

অনেক সময় লেগেছে। স্যরি বলে কিন্তু বাকিটা বলতে নারাজ। স্যরিতেও 'যদি' আমার কোনো আচরণে..., 'কিন্তু' আমি... এমন বিভিন্ন রকম হেয়ালি। আমি এ ধরনের বায়বীয় 'স্যরি' মানতে নারাজ। এক পর্যায়ে সে বলে উঠলো "আপনি আমাকে ডিক্টেট করতে পারেন না"। জীবনে প্রথম টেবিল চাপড়ে বললাম, "আমিই পারি; কারণ সেকচুয়াল হ্যারাসমেণ্টের কেস এ আমার স্টেক অনেক বেশী। অন্যায়টা আপনি করেছেন এবং আধা স্বীকার করেন বা না করেন-আমিও আমার অভিযোগের ব্যাপারে কনফিডেন্ট আর আপনিও জানেন আপনি কী করেছেন। সুতরাং আপনি ক্ষমা চাইবেন এবং এই প্রমিজ সহই চাইবেন যেন আর কেউ আপনার কাছে এসে এই অন্যায়ের মুখে না পড়ে। তা না হলে আমি ফার্দার স্টেপ নিব"।

আরো বেশ কিছুক্ষণ বাকবিতণ্ডা হলো। এক সময় বলল, এখন আইনের লোকের সামনে কথা হচ্ছে ভবিষ্যতে নাকি পারসোনাল লেভেলে কথা হবে (আমি জানি না সে কী বোঝাতে চাইলো কিন্তু তক্ষনি আমি তাকে বলে রেখেছি কোন পারসোনাল লেভেল এর কথার প্রশ্নই আসে না তার সাথে)। আরো বেশ কিছুক্ষণ আমি একই পয়েন্টে জেদ ধরে থাকাতে শেষমেষ এক পর্যায়ে সে নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলল, অবশ্যই আর কোন মেয়ের সাথে সে এমন অন্যায় আচরণ করবে না এবং এ ব্যাপারে সে সতর্ক থাকবে। বেশ জোরেই বলল। স্বস্তি হলো।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিকে আরো একবার কার্যকর পদক্ষেপের অনুরোধ আর পুলিশ কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে আসলাম। 
বের হয়েই মনে হচ্ছিল চলে আসার আগে লোকটাকে বাড়ি ফিরে আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখতে বলা উচিত ছিল। 
ফেরার পথটা রনি আর আমি দুজন দুজনের হাত ধরে ছিলাম। আকাশে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার স্বস্তির নিশ্বাস!

0Shares
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত