আইন তুমি কার?
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৬:৪৭
আইন কার জন্য? কারা তৈরী করে? আর কারাই বা প্রয়োগ করে আইন? আইন তুমি কার?
খবরটার জন্য চাতক পাখির মতো সকাল থেকে অপেক্ষা করছি। এই বুঝি একটা ভালো খবর শুনতে পাবো। কি হবে? ১৪ বছরের কারাদণ্ড? হয়তো আজকেই একটা দৃষ্টান্ত তৈরী হবে। কালকে সকালের খবর হবে,
গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহান ওরফে নিত্যকে ১৪ বছরের কারাদন্ড দিয়েছে আদালত।
না হয়নি...
গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহান ওরফে নিত্যকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত।
গত ১০ বছরে বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় কোন শাস্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি৷ বাংলাদেশে তো গৃহকর্মীদের নাগরিক বলেই মনে করা হয় না। কোন দেশে থাকি আমরা? বাংলাদেশে সাধারণ হিসেবে ২০ লাখ গৃহকর্মী থাকার কথা বলা হয়৷ গত ১০ বছরে ৮৯৯ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে৷ ইন্সটিউট অফ লেবার স্টাডিজ-এর হিসাব মতে, গত বছর ৫১ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ঢাকায় নির্যাতনের শিকার হন ৩৪ জন৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব মতে, ২০১৩ সালে অন্তত ১০০ জন গৃহকর্মীবিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন৷ এদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন৷ যাদের মধ্যে আবার ২০ জনের বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে৷
শারীরিক নির্যাতনের পর মৃত্যু হয়েছে ১৫ জনের৷ অন্যান্য নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ৩২ জনের৷ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনজন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে আরো তিনজনকে৷ এছাড়া আত্মহত্যা করেছেন আটজন এবং গর্ভপাতকালে মুত্যু হয় একজনের৷ পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের শেষ চার মাসে ১০৭ জন গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন৷
‘ডোমেস্টিক ওয়াকার্স রাইটস নেটওয়ার্ক'-এর হিসাব অনুযায়ী ২০০১ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শুধু ঢাকা শহরেই ৫৬৭ জন গৃহকর্মীরঅস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে৷ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে গৃহকর্মীদের মধ্যে প্রায় ৩০ ভাগের বয়স ৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে৷ এই শিশুদের মধ্যে ১৭ ভাগই কোনো না কোনো ধরণের নির্যাতনের শিকার৷
যে কেউ এই সংখ্যার সাথে দ্বিমত করে আমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। কারণ যাতে পয়সাওয়ালারা ধরা না খায় সেই রাস্তা খোলা রাখা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে ‘ডোমেস্টিক ওয়ার্কার রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড প্রটেকশন অ্যাক্ট' নামে একটি আইনের জন্য কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন আন্দোলন করে আসলেও, তাতে সরকার এখনো সাড়া দেয়নি৷ আইন কি আর ছালা পড়া মানুষের জন্য? সকল আইনই তো ভদ্রলোকের জন্য।
এখানে যে সকল তথ্য দেয়া হয়েছে সে সকল তথ্যই থানায় দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে। ভাবুন যারা থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারে নাই বা করে নাই সেই সংখ্যাটা কত?
পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ সালে আট জন গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন৷ আর ২০১৪ সালের শেষ চার মাসে ১০৭ জন গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন৷ তাছাড়া ১২ বছরে অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ৫৬৭ জন গৃহকর্মীর৷ তারা আত্মহত্যা করেছে না খুন করা হয়েছে?
ক্রিকেটার শাহাদাৎ ও তার স্ত্রী বেকসুর খালাস। আমি জানতে চাই কত টাকা দিয়ে এই রায় কিনে নেয়া হয়েছে? অনেকেই বলবেন মামলার স্বাক্ষী পাওয়া যায় নাই। তাহলে আমরা হ্যাপির যে সব কথা মিডিয়াতে শুনেছি বা ছবি দেখেছি সেগুলো মিথ্যা?
হ্যাপিরা বিচার পায় না। কেনো পায় না? উত্তর তো সহজ। গৃহকর্মীরা কি মানুষ? টাকা যেহেতু দেয়া হয়, ঘুমের জায়গা দেয়া হয় সুতরাং হালকা মারধর, একটু আধটু গালি গালাজ, আগুনের ছ্যাঁকা এগুলো তো বোনাস।
ভাবছেন মামলা তো হচ্ছে। আরে হ্যাঁ তা তো হচ্ছে। কিন্তু সেই মামলা চালানোর মতো আর্থিক ক্ষমতা নাই নির্যাতিত বা নিহতের পরিবারের৷ তাই তারা শেষ পর্যন্ত সমঝোতা করেন বা মামলা চালাতে পারেন না৷
আমি হতাশ আমরা হতাশ, এই বিচারহীনতা দেশে আর কত। কি হলে বা কিভাবে প্রমাণ হতো হ্যাপি নির্যাতিত হয়েছে? হ্যাপি মারা গেলে? শাহদাৎ এর বাসায় লাশ পাওয়া গেলে? অবশ্য তাও হতো না। হয়তো তখন আমরা শুনতাম হ্যাপি বাসা থেকে পালিয়ে গেছে। ধন্যবাদ শাহদাৎ ও স্ত্রী লাশটা গুম করে ফেলেনি বা ফেলতে হয় নি। আমরা জীবিত হ্যাপিকে পেয়েছি।
"আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।"
লেখক: আইন-অধিকার কর্মী