আজব শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি কামনা করছি
প্রকাশ : ০১ জুন ২০১৬, ১৫:২৪
কয়েকদিন আগে মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের জিপিএ৫ প্রাপ্ত ছাত্রদের নিয়ে বানানো প্রতিবেদনটি সকলেই দেখেছেন। ভিডিওটি দেখে আসলেই খুব দুঃখ পেয়েছি। সাধারণ কিছু বিষয় আমরা পারি না! ক্ষোভে-দুঃখে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম স্টুডেন্টদের বিরুদ্ধে, পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি এটি করা আমার মোটেই উচিত হয়নি। নিজেও এসএসসি পাশ করেছি কিছু বছর আগে। তাই ওইসব ছাত্রদের প্রতি ছুঁড়ে দেয়া ঘৃণা আর অপমান আমার গায়েও এসে লেগেছে। অনেক সময় সাধারণ কিছু প্রশ্ন মানুষ নার্ভাস হয়ে ভুল করে ফেলে। এরকম কিছু ঘটনা আমাদের প্রায় সবার জীবনেই ঘটে থাকে। এ নিয়ে আমরা পরে মনে মনে হাসি। কিন্তু এসকল ছাত্রদের তো নিজেদের ভুলের কথা মনে করে নিজের মনে হাসার কোন উপায় নেই, সমগ্র দেশ তাদের নিয়ে হাসছে। এই অপমান সহ্য করতে না পারে তাদের কেউ যদি আত্মহত্যা করে এর দায় কি আমরা নিব?
পীথাগোরাসের উপপাদ্য আমরা পড়েছিলাম ক্লাস এইটে। আমাদের অংক বইয়ে উপপাদ্য ২৪ ছিল সম্ভবত পীথাগোরাসের উপপাদ্য। সেটা উপপাদ্য২৪ হিসেবেই লেখা ছিল। অংক বইয়ের কোথাও পীথাগোরাস কে, এ সম্পর্কে কোন তথ্য ছিল না। সেক্ষেত্রে কোন ছাত্র যদি জানতে না পারে যে সে, যেই উপপাদ্য২৪ লিখে পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছে, সেটা আসলে পীথাগোরাসের সৃষ্টি তবে তাকে কিন্তু দোষ দেয়া যায় না। যেই সাংবাদিক পীথাগোরাস কে সেটা জিজ্ঞেস করেছেন, সেই সাংবাদিককে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, পীথাগোরাসের পুরো নাম কী? আমি নিশ্চিত তিনি উত্তর দিতে পারবেন না।
হুট করে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে, স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলবেন অনেকেই। আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম না জানাটা কোন অপরাধ না। রাষ্ট্রপতিকে বছরে কয়বার খবরের পাতায় পাওয়া যায়? আপনারাই ভাবুন। বর্তমান বাংলাদেশের বিরোধী দল কোনটি জানতে চাইলে ৮০ ভাগ মানুষ বলবে বিএনপি। অথচ বর্তমান বিরোধী দল হল, জাতীয় পার্টি। বিরোধী দলের নেতার নামটি কয়জন পারবে এ নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, বাংলাদেশে রওশন এরশাদকে কয়জন চেনে?
হুমায়ুন আহম্মেদের ‘আজ রবিবার’ নাটকটিতে দাদু ক্যারেক্টারটি তার নাতনী টাইপের একজনকে কোন একটা প্রশ্ন করে, নাতনী সেটার উত্তর দিতে পারে নি। এ নিয়ে দাদু সম্ভবত নাতনীকে ‘কিছুই পারিস না’ জাতীয় কিছু কথাবার্তা বলছিলেন। এরপর নাতনী দাদুকে একটা প্রশ্ন করে, দাদু সেটার উত্তর দিতে পারে নি। তখন নাতনী দাদুকে বলে, আমি যেমন অনেককিছু জানি না, তুমিও তেমন অনেক কিছুই জানো না। মুস্তাফিজ’কে তার বোলিং প্রতিভার জন্য মাথায় মুকুট পরাচ্ছি। তারকা খেলোয়াড় মুস্তাফিজকে যদি ওই প্রশ্নগুলো করা হতো, তাহলে তিনিও এসকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। তাঁকে এসব প্রশ্নের উত্তর পারতেই হবে, এমন কোন কথা নেই। তিনি যেই বিষয়ে দক্ষ, সেই বিষয়ে তিনি সেরা। প্রত্যেকেরই নিজের কোন আগ্রহের বিষয় থাকে। নিজের পছন্দের সাবজেক্টে সবাই সেরা। অথচ আমরা সবাইকে সব বিষয়ে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেই। কেন? সবাইকে কেন সবকিছু পারতে হবে?
সাক্ষাতকারটিতে ছয়জন স্টুডেন্টের ছবি দেখা গেলেও, মূলত সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল তের জনের কাছ থেকে। তের জনেকে ১০ টি করে প্রশ্ন করা হলে, এরমধ্যে ছয়জন যদি ছয়টি প্রশ্নের উত্তর ভুল করে, তবে এখানে অস্বাভাবিক কিছু তো দেখি না। ক্যামেরার সামনে নার্ভাস হয়ে আমি হলে তো কথাই বলতে পারতাম না।
প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অন্যদেরকে করা সব প্রশ্নের উত্তর আমি পারতাম কিন্তু নিজেরটার উত্তর ঠিকমত দিতে পারতাম না। একবার বায়োলজি পরীক্ষার প্র্যাক্টিক্যালে, আমার আগের রোলের স্টুডেন্টটি’কে তেলাপোকার বৈজ্ঞানিক নাম জিজ্ঞেস করা হলে, সে তেলাপোকার ইংরেজি বলে। শুনে আমি হেহে করে হেসে ফেলি, কারণ তেলাপোকার বৈজ্ঞানিক নাম আমি জানি। কিন্তু যেই মুহূর্তে, টিচার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হাসলে কেন? তুমি বলতো এটার উত্তর? আমি ঘটনার আকস্মিকতায় ও টিচারের ঝারি শুনে পুরাই ব্ল্যাংক হয়ে যাই, পারিনি উত্তর দিতে। এরকম হয়। এটা অস্বাভাবিক কিছু না।
আমার বাসার ক্যামিস্ট্রি স্যার আমাকে পড়া জিজ্ঞেস করতেন প্রতিদিন, একটা প্রশ্নে আটকে গেলে দাঁড় করিয়ে রাখতেন, বলতেন এক পা তুলে দাঁড়াও, এরপর বলতেন, দুই পা তুলে দাঁড়াতে পারলে শাস্তি মাফ করে দিবো, দাঁড়াও তো। দুই রুমের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে আমাকে তিনি এসব মজা করতেন। পাশের রুমে আমার ছোট বোনের টিচার পড়াতেন। আমার ছোট বোন হাসতো, তার টিচার হাসতেন। আমার রাগ হতো, কিন্তু করার কিছুই ছিলও না। শেষে, আমি ঠিক করি, আমি আর পড়া শিখব না। স্যার পড়া জিজ্ঞেস করার আগেই, ‘সরি, পারব না’ বলে আমি কানে ধরে দাঁড়িয়ে যাই। তারপর স্যারকে জিজ্ঞেস করি, স্যার পা তুলে দাঁড়াব নাকি উঠ বস করব। এরপর আমার বাবা মা সেই টিচার’কে বাতিল করতে বাধ্য হয়। ওই সময়টুকু আমি প্রচণ্ড এক ম্যান্টল টর্চারের মধ্যে ছিলাম। স্যার নানারকম অদ্ভুত কথাবার্তা বলতেন, মজা নিতেন, আর আমাকে নানাভাবে বিব্রত করার চেষ্টা করতেন। এরকম ম্যান্টল টর্চারের মধ্যে বাংলাদেশের অনেক স্টুডেন্টই দিন পার করছে। আমার এক ছোট ভাইয়ের তো মানসিক সমস্যা শুরু হয়েছে, পড়ার চাপ আর বাবা-মা-শিক্ষকদের দুর্ব্যবহারের কারণে।
আমি যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমি কলেজের জন্য বাসা থেকে বের হতাম, সকাল সাড়ে ছয়টায়। ফিরতাম দুপুর সাড়ে তিনটায়। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে সাড়ে চারটার দিকে পরিশ্রান্ত হয়ে যেতাম। কিন্তু ছয়টায় আবার ক্যামিস্ট্রি স্যার, মাঝখানের সময়টুকু স্যারের পড়া শিখে নিতাম। ছয়টা থেকে আটটা সেই স্যার পড়িয়ে গেলে, নয়টা থেকে এগারোটা আরেকজন স্যার পড়াতেন ফিজিক্স ও ম্যাথ। এরপর স্যারের হোমওয়ার্ক, কলেজের হোমওয়ার্ক করে, খেয়ে দেয়ে গভীর রাতে কম্পিউটার নিয়ে বসতাম। ঘুমাতে ২টা বাজুক কিংবা ৪টা, উঠতে হবে ছয়টা বাজার পনের মিনিট আগে। এই ছিল আমার ডেইলি রুটিন। এটা কেবল আমার না, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার শিকার প্রতিটি স্টুডেন্টের ডেইলি রুটিন। আমি ফাঁকিবাজ টাইপে স্টুডেন্ট ছিলাম বলে, এরমধ্যেই সময় বের করে নিতাম নিজের জন্য। আর কলেজের সময়টুকু পুরোটায় বন্ধুদের সাথে আনন্দ করে কাটাতাম বলে এইরকম কঠিন অবস্থায়ও মুখে হাসি ছিলও। ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, কড়া নিয়মকানুন, আর নিয়ম ভাঙতে পারার আনন্দটাই ছিল অন্যরকম। মুখস্থ করার কাজটা আমাকে দিয়ে হতো না। আমার ফিজিক্স স্যার লক্ষ্য রাখতেন, পড়া লেখার চাপে যেন আমার মানসিক কোন রোগ সৃষ্টি না হয়, আমি যেন কোনভাবে হতাশ না হই। স্যারের জীবনে এমন ঘটেছিল। স্যারের এক স্টুডেন্টেরও পড়ার চাপে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের কলেজের অনেক ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্টই মানসিক কোন সমস্যায় ভুগছে বলে মনে হতো। তাদের সারাদিনের কথাবার্তার বিষয় কেবল পড়া, কে কত নম্বর পেলো, সবচেয়ে বেশি যে পেয়েছে সে কোন স্যারের কাছে পড়ে, সে কোন টেস্ট পেপার পড়ে এসব। আমাদের স্কুলের ফার্স্ট গার্লকে আমি কখনো কথা বলতে দেখিনি, সারাদিন বইয়ের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ‘বিড়বিড়’ করতো।
এসকল কথা বলছি কারণ, অনেকের মনে হতে পারে, বর্তমানে গোল্ডেন জিপিএ৫ এসব পাওয়া কোন ব্যাপার না, না পড়লেও পাওয়া যায়, আসলে তা নয়। আমি এও প্রমাণ করতে চাইছি না যে, জিপিএ৫ পাওয়া ছাত্ররা একেকজন মেধায় অনন্য। তবে এখনের স্টুডেন্টরা পড়ালেখার পিছনে যেই সময় ব্যয় করে আমাদের বড়রা কিন্তু এত সময় মোটেই ব্যয় করতেন না। তারা বিকেল হলে মাঠে ঠিকই খেলতে যেতেন। এখন খেলার মাঠ কই? আর সময় কই? রেজাল্ট যাইহোক, সেটার পিছনে ছুটতে গিয়ে বর্তমানে স্টুডেন্টরা তাদের শৈশব-কৈশোরের আনন্দময় সময় গুলো হারিয়ে ফেলছে। একধরণের বিশ্রী প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখে প্রকৃত শিক্ষা থেকে অনেক দূরে রয়েছি আমরা। এজন্য মোটেই স্টুডেন্টরা দায়ী নয়, দায়ী শিক্ষাব্যবস্থা। দায়ী আমাদের শিক্ষকেরা, আমাদের বড়রা। লেখাপড়াটা আমাদের কাছে ভয়ের বা যনন্ত্রনার বিষয়। লেখাপড়া কি আসলেই তাই? মোটা মোটা বই মুখস্থ করে, সেসব পরীক্ষার খাতায় বমি করাটাই কি শিক্ষা? মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় আপনারা এরচেয়ে ভালো কিছু আশা করেন কী করে? স্টুডেন্টদের ভুল নিয়ে হাসাহাসি না করে বরং এ থেকে পরিত্রাণের কার্যকরী কোন উপায় বের করাই আমাদের গুরুজনদের দায়িত্ব। দায়িত্ব এড়িয়ে কেবল কয়েকজন শিক্ষার্থীর অজ্ঞতা নিয়ে উপহাস করলে আপনাদের প্রতি ছাত্রদের আস্থার জায়গাটি আর থাকবে না।