যে প্রীতি আগুনের যে লতা বিপ্লবের
প্রীতিলতা: আগুনের প্রীতি, বিপ্লবের লতা
প্রকাশ : ০৮ মে ২০১৬, ২০:৪৯
সেমিওটিকসের মজাটা যত না চিহ্নে, তার চেয়ে ঢের বেশী প্রতীকে। কেননা চিহ্নের অর্থ কোন বস্তুর ভৌত অবস্থানের পক্ষে সরাসরি এবং তা সীমিত। যেমন, ‘আসাদের শার্ট’ যখন চিহ্ন তখন আসাদ একটি ছেলের নাম, যার কোন শার্টের বিষয়ে উল্লেখ করা হচ্ছে। অথচ প্রতীক হলো তাই যা কোন আইডিয়া, কোন বস্তুগত অস্তিত্ব বা প্রক্রিয়াকে উপস্থাপন করে অথচ যে চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করে, সেই চিহ্নের সাথে ওই বস্তু বা আইডিয়ার সরাসরি কোন মিল নাও থাকতে পারে, হতে পারে কোন বিমূর্ত ধারণার প্রকাশের জন্য কোন ভৌত বস্তুর উপস্থাপন। তাই ‘আসাদের শার্ট’ যখন প্রতীক তখন সেটি নির্দেশক হয়ে ওঠে উনসত্তরের গণ-অভ্যূত্থানের। সেদিক থেকে প্রতীক তাই-ই যা যাপনজাত কোনও অনুভূতিকে বা বস্তু সত্যকে আইডিয়ায় পাল্টে দেয়, পরে যা আবার একটি নির্দিষ্ট ইমেজের চেহারা পায়, অথচ শেষের রুপান্তরটা ইমেজের মধ্যে আইডিয়াকে ধবংস করে ফেলে না। এসব প্রতীক ভাষাতে অর্থাৎ শব্দের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে, নানা ধরণের ইমেজের মাধ্যমে বা চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে পারে। কাজেই প্রতীক হলো অদৃশ্য কোন একটা কিছুর দৃশ্যমান চিহ্নবিশেষ, যা ন্যারেটিভের অন্যান্য অংশের উপর নির্ভরশীল না হয়েও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মানুষ দীর্ঘদিন অর্থ আরোপ করে করে কোন বিমূর্ত আইডিয়াকে অর্থবহ করে, প্রতীকায়িত করে। মা-এর সাথে স্নেহ, কিংবা দেশের প্রতীক। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার সাথে দেশের সার্বভৌমত্ব বা গর্বের সম্পর্ক নির্মাণ করে। এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় নিত্যনতুন ভাষা তৈরী হয়, অনুভব তৈরী হয়, প্রতীক নির্মিত হয়। তবে এসব প্রতীক নির্মাণের পেছনে শক্ত ইতিহাস থাকে, সেই ইতিহাস নির্মিত হয় মানুষের যুথবদ্ধ চেষ্টা, শ্রম, ঘাম, আবেগ, মেধা আর সংগ্রামে।
বাংলাভাষায় প্রীতি অর্থ মমতা, ভালোবাসা। আর লতা বলতেই সেই চারিত্র্যকে বুঝি যা অন্যকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠে। অর্থাৎ, চিহ্ন অর্থে প্রীতিলতা হলো ভালোবাসা আশ্রয় করে যে লতা বেড়ে উঠেছে কিংবা ভালোবাসাময় লতা। স্নেহের পুত্তলি কোন কন্যার যথার্থ নাম তাই হতেই পারে প্রীতিলতা। অথচ সেই প্রীতিলতাই আমাদের সামষ্টিক চেতনায় একুশ বছর বয়সী এক মেধাবী তুখোড় আগুনকন্যার প্রতীক যিনি ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছেন। যিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে আত্মাহুতি দেয়া ভারতবর্ষের প্রথম বিপ্লবী নারী। প্রতীক হয়ে উঠেছেন বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনে প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে অংশ নেয়া সকল মুক্তিকামী মানুষের প্রবল অস্তিত্বের, তাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খার। প্রীতিলতার কারণেই ‘প্রীতি’ শব্দটি হয়ে উঠলো আগুনময়, সাংসারিক স্নেহমমতার উপরে উঠে দেশমাতৃকার পরাধীনতার শেকলভাঙার এক লড়াকু সৈনিকের দেশকে ভালোবেসে জীবন উৎসর্গকারীর নাম। আর ‘লতা’ শব্দাংশটি প্রীতির সাথে যুক্ত হয়ে পরাশ্রয়ী অস্তিত্বের আইডিয়াকে দূর করে আগুনের হলকা ছড়ানো এক বিপ্লবীর প্রতীকে পরিণত হলো। যিনি বিপ্লবী কাজে নিজেকে তৈরী করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং প্রিয়তম সম্পদ জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। এই প্রতীকের জয়গান করেই আমরা বোঝার চেষ্টা করবো কেমন করে তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের প্রতীক হয়ে উঠলেন। কেনোই বা তাকে আমরা তার আত্মাহুতির ৮০ বছর পরে স্মরণ করছি, স্মরণ করবো যুগ যুগ ধরে। আর সে’কারণেই যে রাজনৈতিক পাটাতনে প্রীতিলতার বীরকন্যা হয়ে ওঠা, সেই রাজনৈতিক পাটাতনটি একটু পরখ করা দরকার।
পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের কাজ মাস্টারদা সূর্যসেন নারী বিপ্লবীদের দিলেন!
ফরাসী বিপ্লবের সাফল্য, ‘প্যারী-কমিউন’-এর ব্যর্থতা, জার্মানী ও ইতালিতে জাতীয়তাবাদী অভ্যূত্থান- এসব ঘটনার কথা ইংরেজী সাহিত্যের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতবর্ষের বাংলা মুলুকেও আসতে শুরু করেছিলো। পূর্ণেন্দু দস্তিদার (১৩৭৪ বঙ্গাব্দ: ১)-এর ভাষায়, “শাসক ও বণিক ইংরেজের আফিসে সেরেস্তায় যারা চাকুরী করতে থাকে, তারা ইউরোপে ধনতন্ত্রের নূতন অভিযান তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে নূতন জাতীয়তাবোধেরও সন্ধান পায়।”১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের কারণে মঙ্গল পান্ডে ও ঈশ্বরী পান্ডের ফাঁসির পরে ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম চট্টগ্রামের ৩৪নং রেজিমেন্ট বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। হাবিলদার রজব আলী খাঁ-র নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বিদ্রোহী সিপাহীদের সরকারী কোষাগার থেকে তিন লক্ষ টাকা লুট, জেলখানার কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে সৈন্যদের ব্যারাক পুড়িয়ে দেয়া এবং অস্ত্রাগার ধ্বংস করে দেয়ার মধ্য থেকে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই-এর যাত্রা সেই অভিযাত্রা নানা পথে, নানা কৌশলে স্বদেশী আন্দোলনে প্রত্যক্ষ সশস্ত্র সংগ্রামে রুপ নিলে তার অভিঘাত ছড়িয়ে পড়েছিলো বাংলার ঘরে ঘরে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। তবে পূর্ব বাংলায় এই স্পন্দনটি সবচেয়ে বেশী প্রকাশিত হয়েছিলো বীর চট্টগ্রামে।
আবদুল হক দোভাষ, দেশপ্রিয়, শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী , মহিমচন্দ্র দাস, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, নেলী সেনগুপ্তা, অস্ত্রাগার দখল ও অন্যান্য বিপ্লবী সংঘর্ষের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্ত্তী, অস্ত্রাগার দখল ও জালালাবাদ যুদ্ধের অন্যতম নেতা লোকনাথ বল, মাস্টারদা সূর্যসেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, বিপ্লবী নেতা গণেশ ঘোষ, আলীপুরে ফাঁসিতে শহীদ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, মাখন ঘোষাল, অর্ধেন্দু দস্তিদার, আনন্দ গুপ্ত, প্রভাস বল, অমরেন্দ্র নন্দী, নরেশ রায়, মনোরঞ্জন সেন, রজত সেন, ত্রিপুরা সেন, বিধু ভট্টাচার্য, নির্মল লালা, মধু দত্ত, পুলিন ঘোষ, মতি কানুনগো, শশাঙ্ক, জিতেন দাসগুপ্ত, রয়েছেন নাম-না-জানা অসংখ্য বিপ্লবী। এই বিপ্লবীদের ধারণ করার পাশাপাশি চট্টগ্রাম ধারণ করেছে অনেক নারী বিপ্লবীকেও। এমনই দুই বিপ্লবী নারী কল্পনা দত্ত এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার। দু’জনেই তুখোড় ছাত্রী। তখনকার দিনে চট্টগ্রাম শহরের একমাত্র উচ্চ ইংরেজী বালিকা বিদ্যালয় ড. খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় থেকে দুজনেই পাশ করেছেন। প্রীতিলতা ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কয়েকটি বিষয়ে লেটারসহ প্রথম বিভাগে পাশ করে ঢাকা ইডেনে আই.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। পরে ওখান থেকে মেয়েদের মধ্যে বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করে ২০ টাকা হারে বৃত্তি পান এবং বেথুন কলেজে পড়তে চলে যান। মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে পরিচালিত ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি বা ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনীতে তারা শুধু যোগই দেননি, নিয়মিত বিপ্লবী কাজের পাশাপাশি এই দুই তরুণ নারী বিপ্লবী ‘কাজ’ অর্থাৎ অপারেশনের দায়িত্ব চাইতেন সর্বাধিনায়ক নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনের কাছে। বলে নেয়া দরকার, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি বা ভারতীয় প্রজাতান্ত্রিক বাহিনী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে এদেশ থেকে উৎখাতের ডাক দিয়েছিলো। অস্ত্রাগার লুন্ঠন, জালালাবাদযুদ্ধসহ নানা বিপ্লবী কাজের মধ্য দিয়ে এই বাহিনী ততদিনে বৃটিশ রাজের ত্রাসে পরিণত হয়েছে। অসংখ্য অপারেশনের অন্যতম ছিলো পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা, যে ক্লাবের প্রবেশ দরজায় লেখা ছিলো, ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’।
পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য প্রথমে বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীর উপর দায়িত্ব দেয়া হয়। নানা কারণে পর পর দুইবার এই তরুণ বিপ্লবী পাহাড়তলী ক্লাব আক্রমণ করতে ব্যর্থ হন। এই বেদনা সহ্য করতে না পেরে শৈলেশ্বর চক্রবর্তী একদিন রাতে কাট্টলীর সমূদ্রতীরে গিয়ে রিভলবার চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার আগে তিনি নিজের ব্যর্থতার কথা প্রকাশ করে চিঠি লিখে যান মাস্টারদা সূর্যসেনকে। এরপর মাস্টারদা স্থির করেন নারী বিপ্লবীদের দিয়েই এই কাজ করাতে হবে। এই চিন্তা থেকেই তখন তিনি বলেছিলেন: “বাংলার বীর যুবকদের আজ অভাব নাই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ, কালারপুল পর্যন্ত এদের দীপ্ত অভিযানে দেশের মাটি বারে বারে বীর যুবকের রক্তে সিক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার ঘরে ঘরে মায়ের জাতিও যে শক্তির খেলায় মেতেছে, ইতিহাসে সে অধ্যায় আজও অলিখিত রয়ে গেলো। মেয়েদের আত্মদানে সে অধ্যায় রচিত হোক এই-ই আমি চাই। ইংরেজ জানুক, বিশ্বজগত জানুক, এদেশের মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধে পিছনে নেই।”
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর
বিপ্লবী কাজে নারীদের দায়িত্বপূর্ণ অংশগ্রহণের ব্যাপারে মাস্টারদার সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেয়া হয় প্রীতিলতাকে। তার নেতৃত্বে এই বিপ্লবী স্কোয়াডের অন্য সদস্যরা ছিলেন শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, সুশীল দে, প্রফুল্ল দাস, মহেন্দ্র চৌধুরী। প্রীতিলতা বিপ্লবীদের নিয়ে ক্লাবের খুব কাছেই অবস্থান নিতে পারেন। এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাবের ভেতর থেকে এক দেশীয় বাবুর্চির পাঠানো সংকেতের সাথে সাথে তিন দিক থেকে ক্লাব আক্রমণ করা হয়। বিলিয়ার্ড রুমের দিকে একদল, পেছন দিক থেকে একদল এবং প্রীতিলতার সাথে একদল। প্রথমে বোমা, তারপর রাইফেল এবং সবশেষে রিভলবার দিয়ে তারা এই আক্রমণ চালিয়েছিলেন। এই সফল আক্রমণের শেষে প্রীতিলতা হুঁইসেল বাজিয়ে সকলকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ দিয়ে সবশেষে যখন তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন পাগড়ি মাথায় সামরিক পোষাকে, প্রায় পৌঁছে গেছেন পাহাড়তলী রেলওয়ে কারখানার উত্তরদিকের ছোট হাঁটাপথে, যেখান থেকে রেলের ওভার-ব্রিজ আর পাহাড়তলী বাজার হয়ে তার উদ্দিষ্ট কট্টলী গ্রাম দূরে নয়, সে’সময়ই নালার মধ্যে শুয়ে থাকা এক ইংরেজ যুবক হঠাৎ প্রীতিলতাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে গুলি এসে প্রীতিলতার হাতে লেগে বুকের পাশ দিয়ে চলে যায়। প্রীতিলতা সাথে সাথে ওই ইংরেজকে গুলি করেন। কিন্তু তার ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। রক্তস্রোতে তার স্বাভাবিক পোষাক ভিজে, সামরিক পোষাকও ভিজতে শুরু করলে ধরা পড়ার আশংকায় প্রীতিলতা ‘পটাসিয়াম সায়ানাইড’-এর ছোট মোড়ক নিজের মুখে দিয়ে নিথর হয়ে যান।
এ প্রজন্মের তরুণ যারা এই লেখাটি পড়বেন, তাদের জন্য একটি ছোট নোট প্রয়োজন যে এসব বিপ্লবীদলে কোন অপারেশনে যাবার সময় পটাসিয়াম সায়ানাইড দিয়ে দেয়া হতো কারণ ইংরেজের কাছে ধরা পড়লে অতিরিক্ত অত্যাচারে যদি কেউ গোপন তথ্য ফাঁস করে দেন তা’হলে গোটা দলই বিপদে পড়ে যেতে পারে। তেমন বুঝলে বিপ্লবীরা যেন বরং জীবন উৎসর্গ করতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যেই এই ব্যবস্থা রাখা হতো। বিশেষ করে, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা নেয়া হতো তাদের উপর শারীরিক নির্যাতনের অন্য মাত্রার কথা বিবেচনা করে।
প্রীতিলতার প্রাণহীন দেহ বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকার পর পুলিশ, মিলিটারি ও গোয়েন্দা কর্মচারিরা ঘটনাস্থলে আসে। এই মৃতদেহ কোন নারীর হতে পারে, সেই ধারণাও কারো ছিলো না। সরকারী ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করলে মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় হাসপাতালে।
কলিকাতায় ইংরেজদের প্রধান সাপ্তাহিক ‘ইংলিশম্যান’-এ এই অভিযানের যে বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিলো, সেখানে বলা হয়েছিলো, প্রায় ৫৩জন ইংরেজ নরনারী ঐ আক্রমণে হতাহত হয়েছিলেন। আর পত্রিকার সংবাদদাতা প্রীতিলতার শৌর্যবীর্যের উচ্ছসিত প্রশংসা করে তার নামের আগে ‘অসম সাহসিক’, ‘বীর নারী’ এসব বিশেষণ প্রয়োগ করেছিলো।
ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে যখন তার সামরিক পোষাক মৃতদেহ থেকে খোলা হয় তখনই প্রকাশ পায়, দেহটি একজন নারীর। তার দেহ তল্লাসীর পর যে জিনিসগুলো পাওয়া যায় তা হলো:
১। মাথার পাগড়ি- এটি খোলার পরই তার দীর্ঘ চুল মাটিতে এলিয়ে পড়ে;
২। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবের প্ল্যান;
৩। শহীদ রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফটো;
৪। প্রীতিলতার ফটোসহ ‘ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মি’র চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি সূর্যসেন স্বাক্ষরিত লাল রঙের ইস্তেহার;
৫। একটি হুইসেল;
৬। প্রীতিলতার নিজের হাতে লেখা বিবৃতি;
(পূর্ণেন্দু দস্তিদার, ১৩৭৪ বঙ্গাব্দ; ১৯৬৯/২০০৮)
ভাষাই নির্মাণ করে সত্য, তাই প্রীতিলতার এই বিবৃতি পাঠ অত্যন্ত জরুরী। এই বিবৃতি আমাদের দেখাবে কোন প্রণোদনায় এই মেধাবী নারী বিপ্লবীকাজ সাধন করতে জীবন উৎসর্গ করলেন। মোট নয়টি স্তবকে বিন্যস্ত এই বিবৃতিই তার রাজনৈতিক আকাঙ্খা ও রাজনৈতিক জীবনকে পাঠ করার ব্যাপারে আমাদের সবচেয়ে সঠিক পথটি দেখাতে পারে। টেক্সট-এর ব্যক্ত-নিহিত সংকেতলিপিই তাহলে পাঠ করা যাক।
প্রীতিলতার নিজের হাতে লেখা বিবৃতি
প্রথম স্তবক: পরিচয় ঘোষণা
“আমি বিধিপূর্বক ঘোষণা করিতেছি, যে প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া, অত্যাচারের স্বার্থসাধনে নিয়োজিত সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনের উচ্ছেদ সাধন করিয়া আমার মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করিতে ইচ্ছুক, আমি সেই ভারতীয় রিপাবলিকান আর্মির চট্টগ্রাম শাখার একজন সদস্যা।”
এই স্তবকে তিনি দ্বিধাহীনভাবে দেশবাসীকে জানালেন যে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শক্তিকে উচ্ছেদ করে মাতৃভূমি ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তনে ইচ্ছুক, একটি সুসংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর তিনি একজন সদস্য। পরিচয়ের এই স্পষ্টতা একটি বিপ্লবী পার্টির সদস্যের প্রথম চারিত্র্যলক্ষণ। এই পরিচয় দাখিলের মধ্য দিয়ে তিনি তখন বেথুন কলেজে বাংলা, দর্শন, সংস্কৃত ও ইংরেজীতে পড়া এবং ডিসটিংশন নিয়ে বি.এ. পাশ করা নন্দনকানন মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক নন আর। কিংবা অল্প বেতনের মিউনিসিপ্যাল আপিসের কেরানী শ্রী জগবন্ধু ওয়াদ্দাদারের বড় কন্যাও নন। তার একমাত্র পরিচয় তিনি স্থাপন করলেন একটি সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর সদস্য বলে। আর কিছু নয়।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তবক: দেশপ্রেমের নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে এবং কাজ করেছে তার সংগঠন
“এই বিখ্যাত ‘চট্টগ্রাম শাখা’ দেশের যুবকদের দেশপ্রেমের নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করিয়াছে। স্মরণীয় ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিল এবং উহার পরবর্তী পবিত্র জালালাবাদ ও পরে কালারপুল, ফেনী, ঢাকা, চন্দন নগর ও ধলঘাটের বীরোচিত কার্যসমূহই ভারতীয় মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে এক নূতন প্রেরণা জাগাইয়া তুলিয়াছে। আমি এইরুপ গৌরবমন্ডিত একটি সঙ্ঘের সদস্যা হইতে পারিয়া নিজেকে সৌভাগ্যবতী অনুভব করিতেছি।”
তাঁর বিপ্লবী দলের তিনি একজন গর্বিত সদস্য এবং এই দলের সদস্য হতে পেরে তিনি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেন। কারণ দু’টি। প্রথমত, দেশের যুবকদের নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে তার দলের চট্টগ্রাম শাখা। দ্বিতীয়ত, শুধু চেতনাতেই উদ্বুদ্ধ করেনি, বিভিন্ন স্থানে এই বাহিনী যেসব অপারেশন চালিয়েছে তার উল্লেখ করে জানিয়েছেন, এসব ‘বীরোচিত কার্যসমূহই’ নূতন প্রেরণা জাগিয়েছে মুক্তিকামী বিদ্রোহীদের মনে। চেতনার সাথে কার্যক্রম যুক্ত করার এই প্রক্রিয়াই বুঝি পারে প্রীতিলতা, কল্পনার মত মেধাবী মেয়েদের সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসাবে নিজেকে ঘোষণা দিতে। তিনি জানেন এবং জানান দেন, তিনি যা করছেন তার শক্ত ও প্রকৃত ভিত্তি রয়েছে।
চতুর্থ ও পঞ্চম স্তবক: এ যুদ্ধ স্বাধীনতার, এ যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী
“আমার দেশের মুক্তির জন্যই এই সশস্ত্র যুদ্ধ করিতেছি। অদ্যকার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অংশ। বৃটিশ জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নরনারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সকল অধঃপতনের একমাত্র কারণ। সুতরাং তাহারাই আমাদের একমাত্র অন্তরায়। যদিও মানুষের জীবন সংহার করা অন্যায়, তবু বাধ্য হইয়া বড় বড় সরকারী কর্মচারীর ও ইংরেজদের জীবন সংহার করিতে আমরা অস্ত্র ধারণ করিয়াছি। মুক্তিপথের যে-কোনো বাধা বা অন্তরায় যে-কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন, দেশের মুক্তির জন্য তার যুদ্ধ। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার দেশের স্বাধীনতা হরণ করেছে। ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ সেই মুক্তিযুদ্ধেরই একটি অংশ। বৃটিশ রাজশক্তি তার দেশকে রাজনৈতিকভাবে পরাধীন করেছে এই সত্য জানাই শেষ নয়। তিনি জানেন, এই পরাধীনতার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক তাৎপর্য। বৃটিশ রাজের সাম্রাজ্যবাদী শোষণই যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের মূল কারণ সে বিষয়েও ছিলো না ন্যূনতম অস্পষ্টতা। আর তাই মুক্তিপথের যে-কোন বাধাকে দূর করার সংগ্রামে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
ষষ্ঠ স্তবক: বিপ্লবী দলের সাধারণ কর্মী হিসাবেই ‘কাজ’ চেয়েছেন, শিরোধার্য করেছেন নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত
“আমাদের দলের মহামান্য ও পূজনীয় নেতা মাস্টারদা অদ্যকার এই সশস্ত্র অভিযানে যোগ দিবার জন্য যখন আমাকে ডাক দিলেন, তখন আমি নিজেকে যথেষ্ট সৌভাগ্যবতী মনে করিয়াছিলাম। মনে হইল, এতোদিনে আমার বহু প্রত্যাশিত অভীষ্ট সিদ্ধ হইল এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব লইয়া আমি এই কর্তব্যভার গ্রহণ করিলাম। এই উন্নত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতৃত্ব যখন আমার মত একটি মেয়েকে এই গুরুভার অর্পণ করেন, তখন এতগুলি কর্মঠ ও যোগ্যতর ভাইয়েরা বর্তমান থাকিতে অভিযানের নেতৃত্বের ব্যাপার একজন ভগিনীর উপর কেনো ন্যস্ত হইবে, এই বলিয়া আমি আপত্তি জানাইলাম এবং একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে ঐ কাজে যাইতে চাহিলাম। কিন্তু আমি পরে পূজ্য নেতার আদেশ শিরোধার্য করিয়া লইলাম।”
এটি সেই সময়ের কথা যখন এই বিপ্লবী দলে নানা ধরণের সামাজিক ও বাস্তব অসুবিধার বিবেচনায় নারীদের পূর্ণ সদস্যপদ দেয়া হতো না প্রকৃত দায়িত্ব দিয়ে। তিনি এবং কল্পনা দত্ত বিপ্লবী দলের নারী সদস্য হিসাবে বারে বারেই ‘কাজ’ চেয়ে এসেছেন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের কাছে। যে কোন কাজ দলীয় সদস্য হিসাবে দায়িত্ব নিয়ে করাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। ফলে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব তাঁর উপরে অর্পণ করা হলে তিনি খুশী হয়েছেন, একইসাথে বিচলিত হয়েছেন দলের অভিজ্ঞ পুরুষ সদস্যদের বাদ দিয়ে তাকে দেয়ায়। কেননা, তাঁর উদ্দেশ্য কাজ করা, নেতৃত্ব দখল নয়। তবে যে কোন বিপ্লবী দলের নিয়ম অনুযায়ীই তিনি নেতৃত্বের আদেশ শিরোধার্য করেছেন। বিপ্লবী অপারেশনের দায়িত্ব নিয়েছেন শৃঙ্খলার সাথেই।
সপ্তম ও অষ্টম স্তবক: দেশবাসীর কাছে তাঁর কৈফিয়ত! ভগিনীরা কেনো উহা পারিব না?
“আমি মনে করিতেছি যে, আমি দেশবাসীর নিকট আমার কাজের কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। দুর্ভাগ্যবশতঃ এখনও হয়তো আমার প্রিয় দেশবাসীর মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাঁহারা বলিবেন যে ভারতীয় নারীত্বের উর্ধ্বতন আদর্শে লালিত একটি নারী কি করিয়া নরহত্যার মত এই ভীষণ হিংস্র কাজে লিপ্ত হইল। দেশের মুক্তি সংগ্রামে নারী ও পুরুষের পার্থক্য আমাকে ব্যথিত করিয়াছিল। যদি আমাদের ভাইয়েরা মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হইতে পারে, আমরা ভগিনীরা কেন উহা পারিব না? ইতিহাসে অনেক উদাহরণ আছে, রাজপুত রমণীরা অসীম সাহসের সহিত রণাঙ্গণে যুদ্ধ করিতেন এবং স্বদেশের স্বাধীনতা ও নারীত্বের মর্যাদা রক্ষার জন্য তাহারা শত্রুর প্রাণ-সংহার করিতে কিছুমাত্র দ্বিধাবোধ করিতেন না। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এইরুপ আরো কত নারীর বীরত্বগাঁথায় পূর্ণ। তবে কেন আমরা, আজিকার ভারতীয় নারীরা বিদেশীর দাসত্বশৃংখল হইতে নিজের দেশকে পুনরুদ্ধার করিবার জন্য এই মহান যুদ্ধে যোগদান করিব না? যদি বোনেরা ভাইদের সঙ্গে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারে, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে যোগদানে তাহাদের বাধা কি? সশস্ত্র বিদ্রোহে অন্য দেশের বহু নারী যোগদান করিয়াছে, তবে কেনো ভারতীয় নারীরা বিপ্লবের এই পন্থাকে অন্যায় বলিয়া মনে করিবে?”
স্বাধীনতা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধের সাথে সাথে প্রীতিলতাকে লড়াই করতে হয়েছে জগদ্দল পাথরের মত চেপে থাকা হাজার বছরের প্রথার সাথে। এই প্রথা পুরুষতান্ত্রিকতার প্রথা। যে প্রথা সামাজিক সব কোড বা সংকেতলিপির মধ্য দিয়ে খোদাই করে রেখেছে ভারতীয় নারীত্বের মহিমাময় ‘লক্ষণ-সীমা’। নরহত্যার মত একটি ‘ভীষণ হিংস্র কাজ’ মাস্টারদা, অম্বিকা চক্রবর্তী, বিনয়-বাদল-দীনেশ বা পুরুষ বিপ্লবীদের জন্য শৌর্যের হলেও নারীর জন্য খুবই হতমানকারী এক কাজ। ভারতীয় নারীত্বের কল্যাণময়ী স্নিগ্ধতার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক যেনো এই সংহারকারী রুপ। প্রীতিলতাকে তাই কৈফিয়ত দিতে হয়েছে। তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন কারণ তার উদ্দেশ্য সুদূর প্রসারী। মানুষকে নিয়েই তার কাজ, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাই তার সাধনা। তাই তিনি এড়াতে পারেন না জনমানসকে প্রস্তুত করার দায়িত্ব। জনগণের কাছে তার ‘কৈফিয়ত দেবার বাধ্য’তার ঘোষণা তাকে দেয় সেই বিপ্লবীর মর্যাদা যিনি নিজের বৈপ্লবিক চেতনা এবং কাজের সম্প্রসারণ করেন দেশবাসীর মধ্যে, যাদের মধ্যে এই চেতনা তখনো জাগরুক নয় ।
তিনি শুধু বিপ্লবী কাজে নিজের অংশগ্রহণের কৈফিয়তই যে দেন, এমন নয় বরং একাধারে বিপ্লবী এবং ইন্টেলেকচুয়ালের দায়িত্ব পালন করেন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী স্বাধীনতার সংগ্রামে নারীর সশস্ত্র অংশগ্রহণের অনিবার্যতাকে একটি দার্শনিক ভিত্তি দেবার মধ্য দিয়ে।
প্রথমত, তিনি পৃথিবীর এবং ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর নারী সংগ্রামীদের যুদ্ধ-ইতিহাস তুলে ধরেন নারীর অংশগ্রহণের ডিসকোর্সকে একটি গ্রহণযোগ্য পাটাতন দেবার জন্য।
দ্বিতীয়ত, তিনি ভারতীয় ইতিহাসে নারীর যুদ্ধ অংশগ্রহণকে দোহাই মেনে প্রশ্ন তোলেন, তবে কেনো বর্তমানের ভারতীয় নারীরা যুদ্ধে অংশ নিতে পারবেন না?
সবশেষে তিনি প্রশ্ন তোলেন, বোনেরা যদি ভাইদের সাথে কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দিতে পারেন, তবে সশস্ত্র বিদ্রোহে নয় কেনো?
এই প্রশ্নগুলো প্রীতিলতাকে জনপরিসরে নিয়ে আসতে হয়, কারণ তখন পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মেয়েদের, বিশেষত অবিবাহিত মেয়েদের অংশগ্রহণের পথে সামাজিক বাধা ছিলো দুস্তর। মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মেয়েরা তখনও খুব অল্পই পড়াশুনা করার সুযোগ পেয়েছে। চট্টগ্রামের মত মফঃস্বল শহরে একটিমাত্র বালিকা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়। শহরে যারা থাকেন, যেমন উকিল, ডাক্তার, সরকারী কর্মচারী ও অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়েরা কিছু কিছু সংস্কারের বাঁধ ভেঙ্গে মাত্র এই স্কুলে পড়ছে। গ্রামের মেয়েদের পড়া তখন প্রাইমারী স্কুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ - বড়জোর তখন কেউ কেউ সামান্য মধ্য ইংরেজী স্কুলে পড়ছে। তখন সহশিক্ষা মাত্র বহু বিরোধিতার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে শুরু হয়েছে (১৯২৬ সাল থেকে)। ছেলেমেয়েদের সহজ সামাজিক মেলামেশাও তখন সহনীয় ছিলো না। সেই পরিসরে, নারীর সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণের মানসিক প্রস্তুতির ডাক দিতে হয় বৈ কি এই নারী বিপ্লবীকে। দিতে হয় কৈফিয়ত। এবং ‘আপনি আচরি ধর্ম জীবেরে শিখাও’-এর মত করেই প্রীতিলতা জগতকে দেখান কীভাবে নারী বিপ্লবী কাজে অংশ নেবে এই বাংলা মুলুকে।
নবম স্তবক: শেষ ডাক তার নারীদের উদ্দেশ্যেই!
“নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন- এই আশা লইয়াই আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।।”
(স্বাক্ষর) প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার
২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ ইং
পরাধীন ভারতবর্ষের একজন বিপ্লবী এবং নারী হিসাবে তার ডাক শেষ পর্যন্ত নারীদের উদ্দেশ্যেই। ভারতীয় নারীর সহস্র বিপদ এবং বাধা সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রেখেই তিনি বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে নারীর যোগদান এবং তার জন্য নিজেদের তৈরী করার ডাক পাঠান। ঘোষণা করেন নারীর কঠোর সংকল্পের কথা। এই প্রস্তুতি এবং অংশগ্রহণ একই সাথে দেশমাতার মুক্তিসংগ্রামের জন্য যেমন জরুরী, তেমনি জরুরী নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য। তার বার্তা তিনি অগ্রগামী নারী হিসাবে সব নারী-পুরুষের ভেতর ছড়িয়ে দিয়ে আত্মদানে এগিয়ে যান আশা নিয়ে, একজন প্রকৃত বিপ্লবীর মত। প্রীতিলতা একজন আমূল বিপ্লবী।
বীরকন্যা, চট্টগ্রামের ‘রানী’ (প্রীতিলতার ডাকনাম) প্রীতিলতা শৈশবে ঝাঁসীর রানী লক্ষীবাঈ-এর ইতিহাস পড়ে নিজেকে কল্পনা করেছেন ঝাঁসীর রানীর মতোই যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার। এবং মাত্র একুশ বছর বয়সের মধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াকু বিপ্লবী এবং সমাজ পরিবর্তনের অকুতোভয় যোদ্ধা হিসাবে। তার এই হয়ে ওঠা কেবল পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব দখলের মধ্যেই যে প্রকাশিত, তেমন নয়, বরং তার বিপ্লবী কার্যক্রমের রয়েছে এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। সেই অংশটুকু আমাদের জানা থাকা প্রয়োজন।
প্রীতিলতার বিপ্লবী সত্তার ধারাবাহিকতা
চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির কেরানী শ্রী জগবন্ধু ওয়াদ্দাদার ও তাঁর স্ত্রী প্রতিভা ওয়াদ্দাদারের কন্যা প্রীতিলতার বিপ্লবী প্রীতিলতায় উত্তরণ কোন হঠাৎ আলোর ঝলকানি নয়, নয় কোন হঠকারি সিদ্ধান্ত বরং তাঁর বিপ্লবী সত্তার ধারাবাহিকতা একজন প্রকৃত বিপ্লবীর ক্রমশ উত্তরণের।
মাত্র তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়েই তিনি শোনেন ‘টাইগার পাস’ এলাকায় স্বদেশী ‘ডাকাত’দের রেলওয়ে কারখানার কর্মচারিদের বেতন লুট করার লোমহর্ষক কাহিনী। কোন অজানা কারণে সেইসব ‘ডাকাত’দের ধরিয়ে দেবার পোস্টার শহরের দেয়ালে দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিলে তার বড়ভাই মধু যখন ডাকাতদের ধরিয়ে দিয়ে পুরস্কার পাবার আশায় মগ্ন, তিনি তখন ঘোর পক্ষপাতি থাকেন সেইসব ‘ডাকাত’দের, না বুঝেই। তার মাস খানেক পরে সেই ডাকাতদল ধরা পড়ার খবরে যখন সারা শহর উদ্বেলিত, তখন তিনি বন্ধু রেণুর বাড়িতে দেখে এলেন ধৃত ডাকাতদের দুজনকে। একজন উমাতারা উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ের শিক্ষক সূর্যসেন, অন্যজন পোর্ট আপিসের কেরানী অম্বিকা চক্রবর্তী। এই দুই নিরীহ ডাকাতের বিচারের গল্প শোনেন তিনি তার এক খুড়তুতো ভাই-এর কাছে। এই ভাইটি দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের গোপন দলের সদস্য। এই দাদার কাছে গল্প শোনার পাশাপাশি স্কুলের শিক্ষক উষাদি তাকে পড়তে দেন ‘ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাঈ’। প্রীতিলতা তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী।
১৯২৪ সালে ‘বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স’ জারি হলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। চট্ট্রগ্রামের বিপ্লবীদের দুটি শাখা ‘যুগান্তর’ এবং ‘অনুশীলন’ তখন জমজমাট কাজ করছে। ইতিমধ্যে ‘বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স’-এর আওতায় বিপ্লবী সন্দেহে ধরপাকড় শুরু হলে প্রীতিলতার সেই দাদা আত্মগোপনে যাবার আগে কিছু বই রেখে যান প্রীতির জিম্মায়। সেসব বই-এর ভেতর চারখানা বই ‘দেশের কথা’, ‘বাঘা যতীন’, ‘ক্ষুদিরাম’ আর ‘কানাইলাল’ প্রীতি পড়েছিলেন গভীর আগ্রহে। তার ভেতর এই বিপ্লবী কর্মকান্ডে যোগ দেবার প্রবল ইচ্ছা তৈরী হলেও বার বার তার সেই বিপ্লবী দাদার কাছে শুনেছেন মেয়েদের বিপ্লবী দলে নেয়া হবে না।
১৯২৭ সালে মেধাবী প্রীতিলতা প্রথম শ্রেণীতে পাশ করে পড়তে যান ঢাকার ইডেন কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বোর্ডের মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর চলে যান কলকাতার বেথুন কলেজে পড়তে। ঢাকায় পড়তে গিয়ে তিনি যুক্ত হন লীলা নাগের নেতৃত্বে পরিচালিত দীপালি সংঘে। কলকাতায় বেথুন কলেজে পড়তে গিয়ে যুক্ত হন কল্যাণী দাস পরিচালিত ছাত্রী সংঘে। বিপ্লবের ডাকে তিনি দর্শন অনার্সে ভর্তি হয়েও ১৯৩১ সালে ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাশ করে চলে আসেন চট্টগ্রামে।
১৯২৯ সালে প্রীতিলতা মাস্টারদা সূর্যসেনের রিপাবলিকান আর্মির গোপন সদস্য হয়েছেন। তিনিই সূর্যসেনের দলের প্রথম নারী সদস্য। চট্টগ্রামে ফিরে তিনি যোগ দেন নন্দনকানন স্কুলে, শিক্ষক হিসাবে। এই বিপ্লবী দলের সদস্য হিসাবে তার প্রথম কাজ ছিলো চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের চারজন মেয়েকে নিয়ে একটি চক্র গঠন করা। এই চক্রের উপর দায়িত্ব ছিলো কলকাতা থেকে বোমার খোল লুকিয়ে নিয়ে আসা। সেই কাজে তার চক্র খুবই সফল হয়েছিলো। প্রীতিলতার উপর বিভিন্ন সময়ে আরো যেসব দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো, তার মধ্যে রয়েছে টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিস ধ্বংস করা। তিনি অংশ নিয়েছেন জালালাবাদ যুদ্ধে, যেখানে তার দায়িত্ব ছিলো বিস্ফোরক সরবরাহ করা। ১৯৩০ সালে এক অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় তাকে কলকাতার আলীপুর জেলে গিয়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত স্বদেশী রামকৃষ্ণের সাথে দেখা করার। রামকৃষ্ণ তখন জেলের ভেতর নির্জন কক্ষে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেও প্রীতিলতা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পেরেছিলেন। এসব কাজের মধ্য দিয়ে তার প্রতি দলের যে আস্থা তৈরী হয়, তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৩২ সালের ১৩ জুন তিনি ধলঘাটে দেখা করতে যান মাস্টারদার সাথে। কিন্তু সেখানে পুলিশ বাড়ি ঘিরে ধরলে মাস্টারদা এবং প্রীতিলতা যদিও পালাতে সক্ষম হন এবং প্রাণে বাঁচেন কিন্তু প্রীতিলতার নাম উঠে যায় পুলিশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায়। মাস্টারদা’র নির্দেশে তিনি তখন আত্মগোপনে চলে যান। সেই আত্মগোপন অবস্থাতেই তিনি পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব পান। সাফল্যের সাথে সে দায়িত্ব তিনি পালন করেন এবং ধরা পড়া আসন্ন জেনে পটাসিয়াম সায়ানাইড পান করে জীবন উৎসর্গ করেন। এইসব কাজ তিনি করেন তার ২১ বছর বয়সের মধ্যে।
তাঁর জীবনের দিকে তাকালে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে শুরু করে অর্থাৎ তার বুঝে ওঠার সময় থেকেই প্রতিটি মূহুর্ত ছিলো বৈপ্লবিক জীবনধারায় নিজেকে গড়ে তুলবার জন্য প্রস্তুতি, নির্মাণ এবং বিকাশের। এই ধারাবাহিকতাই লিখিয়ে নেয় তাকে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের গোপন ইস্তেহার। তিনি নিশ্চিত মৃত্যুকে জেনে মাত্র ২১ বছর বয়সে বিপ্লবের জন্য আত্মাহুতি দেবার পাশাপাশি দেশবাসীর করণীয় নির্দেশ করে যান। পৃথিবীর ইতিহাসেই এতো অল্প বয়সে এই প্রজ্ঞা, অর্ন্তদৃষ্টি, বৈপ্লবিক চেতনা, গণমানুষের চেতনার স্তর অনুযায়ী বার্তা দেয়া এবং বিপ্লবের কাজকে অগ্রগামী করার জন্য জীবন দেয়া- এতগুলো বিষয়কে সাফল্যের সাথে ধারণ, বহন ও পরিণতি দেয়ার দৃষ্টান্ত বিরল।
প্রীতিলতাকে পাঠ করা আজ শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, জরুরী
প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসের ৮০ বছর পার করছি আমরা এ’বছর। প্রীতিলতা এবং তার মতো মৃত্যুভয়হীন সাধারণ মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর তরুণদের এই আত্মদান, গভীর দেশপ্রেম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে যে মৃত্যুভয়হীন পথে চালিত করেছিলো, তার রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে অপরিসীম, সে’বিষয়ে দ্বিমত প্রায় কারোরই নেই। কিন্তু এসব তরুণ প্রাণের আত্মদানকে দেখা হয় অতীত ইতিহাসের উপাখ্যান হিসাবে। এ’খানেই ইতিহাস পাঠের বিভ্রম। ইতিহাসকে যদি বর্তমানের সাপেক্ষে পাঠ না করা হয়, বা না করা যায় তবে সেই পাঠ তাৎপর্যহীন হতে বাধ্য।
কতটা পাল্টেছে পরিস্থিতি আসলে? সাদা চোখে দেখতে গেলে পাল্টেছে অনেকটাই। এমনকি সেই পরিস্থিতিই আর নেই, এমনও মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। বৃটিশরাজ আমাদের দেশ আর প্রত্যক্ষভাবে শাসন করছে না। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়ে প্রথমে পাকিস্তান ও ভারত, এবং পরে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণ করেছে। ফলে, মাস্টারদা কিংবা প্রীতিলতাকে অতীত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে সম্মান জানানোর মধ্যে যারা সীমাবদ্ধ রাখতে চান, তাদের দোষ দেয়া যাবে না যদি না এই সময়ের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বরুপটিকে আমরা ধরতে পারি।
সাম্রাজ্যবাদী, ঔপনিবেশিক শক্তি দৃশ্যত আমাদের আর শাসন করছে না ঠিকই। কিস্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়া দেশগুলো তাদের স্বাধীনতাকে বন্ধক দিতে বাধ্য হয়েছে প্রথমত, উন্নয়ন সহযোগী দেশ বা ব্লকের ঋণ সাহায্যের অর্থনীতির কাছে, দ্বিতীয়ত, বুদ্ধিবৃত্তিক সাহায্যের জন্য পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিদের কাছে। দেশে দেশে নতুন ধরণের উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। স্নায়ূযুদ্ধের অবসানের পর মুক্তবাজার অর্থনীতির লাগামহীন ঘোড়া দেশে দেশে একদিকে বিরাজনীতিকীকরণের, বিরাষ্ট্রীয়করণের আদর্শ প্রচার করেছে, করছে আর ঋণ সাহায্যের অর্ধেক প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়নের নামে দেশের বুদ্ধিজীবিদের ব্যস্ত রেখেছে সেইসব প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবনা লেখায়। আর এইসব হট্টগোলের মধ্যে দেশের জাতীয় সম্পদের উপর হামলে পড়েছে বহুজাতিক কর্পোরেশন। এসব বহুজাতিক কর্পোরেশনের ক্ষমতা আমাদের মত দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার চেয়ে ঢের বেশী। ফলে এসব বহুজাতিক কর্পোরেশনের প্রচার-প্রপাগান্ডা মেশিনের তলায় একদিকে চাপা পড়ে যাচ্ছে বহুজাতিক কর্পোরেশনের লুটপাটের কাহিনী, অন্যদিকে সম্মতি আদায় করা হচ্ছে বিনোদন কারখানার অলীক, মোহময়, ভোগবাদি জীবনদর্শনে। ফলে যে প্রতিরোধ থাকবার কথা ছিলো, তা ভেসে যাচ্ছে।
নারীর অস্তিত্বের সংকট আজ যে কোন সময়ের চেয়ে প্রকট। একদিকে ধর্মীয় মৌলবাদের বিস্তার, অন্যদিকে বিশ্ব পুঁজির দাপট। দেশে দেশে নারী প্রশ্নে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকির ব্যবস্থা উঠে যাচ্ছে মুক্তবাজার অর্থনীতির মুনাফার প্রতিযোগিতায়। নারীর নিজস্ব রাজনীতি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে সৌন্দর্য ইন্ডাস্ট্রির ত্বক ফর্সা করা, দাঁত সাদা রাখা আর ওজন কমানোর রাজনীতিতে। পুরুষতান্ত্রিক মুক্তপুঁজির রাজনীতি নারীর প্রয়োজনীয় লড়াইকে কোন ছাড় তো দিচ্ছেই না, নারীর নিজস্ব রাজনীতি গড়েই উঠতে পারছে না। ফলে প্রতিরোধের ধারাটি ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। যে সাম্রাজ্যবাদ দৃশ্যমান ছিলো, সেই সাম্রাজ্যবাদ অদৃশ্যমান হয়েছে, হয়েছে শক্তিশালী। এ হলো কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসনের যুগ, যা অপ্রতিরোধ্য বা ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে মানুষ। অন্যদিকে দেশীয় রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গ, মানুষের মৌলিক মানবিক অধিকারের বিষয়গুলো সাব্যস্ত হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এবং অন্যান্য দেশের সাপেক্ষে যাদের উপর আমরা শ্রমশক্তি রপ্তানির ব্যাপারে নির্ভরশীল। মানুষের প্রতিরোধহীন পরাভবকে রবীন্দ্রনাথ গণ্য করেছিলেন মনুষ্যত্বের অপমান হিসাবে, অথচ নিয়োজিত পূঁজির জয়োল্লাসের কাছে চাপা পড়েছে মানুষের প্রতিরোধ স্পৃহা।
নতুন এই পরিস্থিতিতে কেবল নারীর জন্যই নয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তরুণ প্রজন্মের জন্য প্রীতিলতার জীবন এবং বিবৃতিটি হয়ে উঠতে পারে পথপ্রদর্শক। অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে।
প্রথমত, দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তিপথের সন্ধান ও প্রতিষ্ঠায় তার আপোষহীন ঘোষণায়। যেমনটি তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিপথের যে-কোনো বাধা বা অন্তরায় যে-কোনো উপায়ে দূর করার জন্য আমরা সংগ্রাম করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।”
দ্বিতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য চিহ্নিত করতে পারার স্পষ্ট প্রজ্ঞায়। “বৃটিশ জোরপূর্বক আমাদের স্বাধীনতা ছিনাইয়া লইয়াছে। ভারতের কোটি কোটি নরনারীর রক্তশোষণ করিয়া তাহারা দেশে নিদারুণ দুর্দশার সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধ্বংসের এবং সকল অধঃপতনের একমাত্র কারণ।”
তৃতীয়ত, নারীকে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের বৃহত্তর পাটাতনে সামিল হবার তীব্র আহবানে। “নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়াছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন-এই আশা লইয়াই আমি আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।” এবং সবশেষে, এইসব কাজ পরিচালনার জন্য ভ্যানগার্ড পার্টি এবং তার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে সংযুক্ত থাকার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে।
প্রীতিলতার জীবনীকার পূর্ণেন্দু দস্তিদার (যিনি নিজে বিপ্লবী এবং প্রীতিলতার সম্পর্কে দাদা) যখন দেউলি বন্দীশিবিরে শাস্তি ভোগ করছেন, তখন প্রীতিলতা নিয়মিত তাকে চিঠি লিখতেন। একবার চিঠিতে একটি নিজের লেখা কবিতাও পাঠিয়েছিলেন, গোয়েন্দা পুলিশের সেন্সর এড়িয়ে যে দুটি লাইন তিনি পড়তে পেরেছিলেন, তা হলো:
‘আঁধার পথে দিলাম পাড়ি
মরণ-স্বপন দেখে।”
রাজনৈতিক প্রতিরোধের লড়াইয়ে তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক দুই দিক থেকেই তার জীবন অনন্য সম্ভাবনার পথ দেখাতে পারে। আসুন পাঠ করি তা’হলে তার জীবনকে, পাঠ করি তার রাজনৈতিক আকাঙ্খাকে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেই তার জীবন, চেতনা আর আত্মদানকে। তার জীবন এবং বিবৃতি আজকের দিনে কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, জরুরী। ভীষণ জরুরী। যে দেশে প্রীতিলতার মত ২১ বছরের নারী জাতীয় স্বাধীনতার লড়াই, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই এবং নারীমুক্তির স্পষ্ট ডাকটি দেশবাসীকে পৌঁছে দিতে পারেন নিজের জীবনকে দৃষ্টান্ত হিসাবে তৈরী করে, মরণের স্বপ্ন দেখেই আঁধার পথ পাড়ি দিতে পারেন, সেই দেশের তরুণ প্রজন্মের সত্যিই কি অনুকরণ করার মত ব্যক্তিত্বের অভাব বোধ করার কথা?
যে প্রীতি আগুনের যে লতা বিপ্লবের, সেই প্রীতিলতাকে ভালোবাসা।
[লেখাটি ২০১২ সালে মাসিক অনন্যা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। ]
লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়