পাল্টা জবাবের সময় কি আসে নি?
প্রকাশ : ৩০ মে ২০১৬, ১৭:৪৩
একটা মেয়েকে সমাজ, ধর্ম, পরিবার প্রায় সব দিক দিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে। আমাদের দেশে মেয়ে জন্মটা একটা অভিশাপ। মেয়ে জন্মের পর মেয়ে হয়ে বেড়ে উঠাটা আরও বড় অভিশাপ। কোন পিতাই চায় না তাদের সন্তানাদি কেবল মেয়ে থাকবে। বাংলাদেশে অনেক পরিবারে দেখা যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলে সন্তান না জন্মায় ততক্ষণ পর্যন্ত সন্তান নিতেই থাকে। কেউ কেউ পুনর্বিবাহ করে। যদিও ছেলে সন্তান না জন্মানোর দায় পুরোটাই স্বামীর, তবুও দোষটা আলটিমেটলি স্ত্রীর উপরেই পড়ে। পর পর মেয়ে জন্মানোটা অশুভ হিসেবে বিচার করা হয় আমাদের সমাজে। কোন পরিবারে ছেলে জন্ম হয়ে গেলে, মেয়ের জন্মটা সেই পরিবারের জন্য খুশির খবর হতে পারে। যেহেতু মেয়েকে তার পিতার পরিবারে থাকতে দেওয়া হয় না, স্বামীর বাড়িতেও তাকে প্যারাসাইটের মত জীবন যাপন করতে হয়, সেজন্যই মেয়ে জন্মানোটাকে আমরা অত্যন্ত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখি।
পুত্র সন্তান জন্মানো পছন্দের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ শেষ বয়সে সন্তান উপরে নির্ভরশীলতা। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণীতে এমন অনেক উদাহরণ দেখা যায়, শেষ জীবনে পিতা মাতা কন্যার উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে থাকে, কারণ পুত্র সন্তানেরা বাবা মায়ের দেখাশোনার দায়ভার নিতে চায় না। যদি মেয়েদেরকে বিয়ের পর নিজ বাড়ি ত্যাগ করতে না করতে হতো এবং মেয়েরা যদি সম্পত্তিতে পূর্ণ অধিকার পেতো, তবে মেয়ে জন্মটা আমাদের ধার্মিক সমাজের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য হতো।
একটা ছেলে শিশু এবং মেয়ে শিশু জন্মের পর প্রথম আট দশ বছর কোনরকম বিচার বৈষম্য-হীনভাবেই বেড়ে উঠে। এরপর থেকে মেয়েদের উপর যে সকল বিধিনিষেধ জারি করা হয়, তার জন্য এরপর থেকেই একটা মেয়ে মানসিকভাবে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগে। শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাগুলো এড়িয়ে গিয়ে সুষ্ঠু মনের বিকাশটা তাদের আর ততোটা হয়ে উঠে না। সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা-ই করতে যায় সেখান থেকেই বাধা আসে। পড়াশোনার পাশাপাশি তাকে সবসময় একটা বিষয় মাথায় রাখতে হয়, কিছুদিন পর তাকে তার বাড়িছাড়া হতে হবে। যতোই পড়ালেখা করে বড় চাকরি করুক না কেন, তাকে একদিন পরের বাড়ি যেতে হবে, সেটাই হবে তার আসল নিবাস, সেটাই তার নিয়তি। এমনকি মরার পরে তার কবরটাও হবে সেই পর-নিবাসে। সে তার জীবদ্দশায় কখনোই জানতে পারে না তার আসল ঠিকানা কি! ভাল স্ত্রী না হতে পারলে তাকে আবার বাবার বাড়ি ফিরে আসতে হবে, তা হবে আরও বেশি নিগ্রহের জীবন। অনেক সময় বড় অংকের যৌতুক, শারীরিক নির্যাতনসহ স্বামীর বহুগামিতা, চরিত্রহীনতাকে মেনে নিয়েও তারা চায় তার সংসার বন্ধনটা অটুট থাকুক। এমন এক দোদুল্যমান নির্ভরহীনতা আর ভরসাহীনতায় প্রতিটা মেয়েই চায় যত কষ্টই সহ্য করতে হোক না কেন; তার সংসারটা যেন টিকে থাকে। আসলে টিকে থাকে না, প্রতিনিয়ত ত্যাগ, স্বামী সন্তানের অত্যাচার, হতাশা, মানসিক নির্যাতন স্বীকার করে নিয়ে নিজেরাই টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে মাত্র। এর একটু অন্যথা হলেই জীবনে যুক্ত হয় ঘোর ঘোর অশনি।
এত এত সব প্রতিবন্ধকতা মেনে নিয়ে কেউ কেউ সামনে এগিয়ে যেতে চায়, কেউ কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, কেউ কেউ গলার স্বর উঁচু করে, কেউ কেউ সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজের মত জীবন বেছে নেয়। তখনি তার উপর নেমে আসে আরেক ধরনের অত্যাচার। তা হল নষ্টা, ভ্রষ্টা, পতিতা। যদিও আমাদের সমাজে পতিতালয় বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষের এন্টারটেইনমেন্টের জন্য পুরুষেরাই বানিয়েছে এবং টিকিয়ে রেখেছে, তবুও কোন মেয়ে নির্ধারিত নিয়ম থেকে একটু সেদিকে যেতে চাইলেই পুরুষেরা তাকে 'বেশ্যা' বলে 'চরিত্রহীন নারী' বলে সমাজ ছাড়া করতে চায়। যার উদাহরণ সমাজে অহরহই বিদ্যমান। কোন মন্দির মসজিদ ভেঙ্গে গেলেও সমাজের অত বড় ক্ষতি হয় না যতটা ক্ষতি হয় কোন মেয়ে চরিত্রহীন খেতাব পেলে। একটি নির্ধারিত ফরমেটে সেই চরিত্রের নির্ধারণও করে দেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কোন ভয়ংকর প্রাণীও এতোটা নিষ্ঠুর নয় যতোটা নিষ্ঠুর আচরণ এ সমাজেরা পুরুষ নারীর সাথে করে।
মানুষ হিসেবে না জন্মে কুকুর বেড়াল হিসেবে জন্মালেও এতোটা অপমান, অবহেলা, নির্যাতন, অত্যাচার, মানসিক বৈপরীত্য সহ্য করতে হয় না, যতোটা সহ্য করতে হয় নারী হয়ে জন্মালে। নারীর পেটে জন্ম নিয়ে নারীকে এমন অপমান করার মত স্পর্ধা পুরুষেরা কিভাবে রাখে তা ভাবলে রীতিমত অবাক হতে হয়। সভ্যতার বিকাশ এখানে এসেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মানুষ কি আদৌ মানবিক হতে পারে? না পারে না। মানুষের মত নির্দয়, লোভী, স্বার্থপর অন্য কোন প্রাণী হতে পারে না। যার ভুক্তভোগী এবং শিকার কেবলমাত্র নারী।
লেখক: প্রবাসী লেখক