মনস্তত্বে যখন বদরুলের চিন্তাধারা!
প্রকাশ : ০৮ অক্টোবর ২০১৬, ১৪:৫৪
কথাটা কিন্তু সত্যি। আমাদের চারপাশে অনেকের মনের ভেতরেই আস্ত বদরুল।
আমি পোস্টটা পড়েই ভদ্রলোকের ওয়ালে যাই। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে তাই যাই। উনসত্তর জন মিউচুয়াল ফ্রেন্ড তার আর আমার। আর সে নারীদের হ্যারাসমেন্টের বিরুদ্ধে বেশ কিছু কাজ করছে বলে নানান কিসিমের পোস্টে জানাচ্ছে। ইস্টিশন ব্লগ খুলে দেয়ার দাবীতে আমাদের বন্ধুদের কর্মসূচীতেও সে যোগ দিচ্ছে।
স্কয়ার হাসপাতালে মূমূর্ষ খাদিজা সম্পর্কে লিখছে, ‘এই ঘটনায় বদরুলের দোষ যদি হয় ৫০ ভাগ তাহলে খাদিজার দোষ ৩০ ভাগ আর পরিবারের দোষ ২০ ভাগ। কারণ এই মেয়েটার ছয় বছর ধরে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বদরুলের সাথে, তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক জানতে পেরে পরিবার তাকে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার জন্য চাপ দেয়। বাংলাদেশে যত রিলেশনশিপ ভেঙে যায় তার পেছনে ৯০ ভাগই মেয়েরা দায়ী। নারীবাদপীড়িত মিডিয়ায় এসব কথা আসে না’ ইত্যাদি।
আমার তেমন অবাক লাগেনা। ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছি যেকোন ঘটনার পেছনে, এমনকি ভয়াবহ অপরাধ করা পুরুষের পেছনেও নারীই থাকে মূল কারণ। একটা জেন্ডার ইনসেনসেটিভ সমাজে আমার জন্ম। আমি জন্মেছি এবং দিনে দিনে সমাজ সংসার আমাকে ‘মেয়েমানুষ’ করে তুলেছে। তাই এসব কথা আমাকে বিশেষ অবাক করে না। কিন্তু আমরা লড়াইটা করছি এইসব পরিবর্তনের জন্যই তো। লড়াই এর যেসব টুলস আর সহযোদ্ধা আমাদের আছে বলে মনে করছি, তা কি আসলেই আছে? যে ছেলেটা ইস্টিশন ব্লগ খুলে দেয়ার জন্য স্লোগান দেয় সে কিভাবে কুপিয়ে মারা একটা মেয়ের চরিত্রে দোষ খোঁজে? এটাই কি এখন আমাদের সমাজের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এর মূল চেহারা? এরকম মনের ভেতর বদরুল নিয়ে কতজন ঘুরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে?
খাদিজা কি বদরুলের সাথে প্রেম করেছিল? ধরে নিলাম করেছিল এবং ৬ বছর ধরে তার বদরুলের সাথে প্রেমের সম্পর্কে ছিল। তারপর সে আর থাকতে চায়নি সম্পর্কে। এটা কেন এত বড় অপরাধ হবে? যেকোন কারণেই তো সম্পর্ক ভাঙতে পারে। খাদিজা প্রতারণাও করতে পারে। নারী যদি মানুষ হয় তবে তার মধ্যে লোভ, ক্ষোভ, কাম, তৃষ্ণা, ঘৃণা সব থাকবে। সে তো মানুষই, দেবী বা শয়তান তো নয়। সাধারণ মানুষের যেসব দোষ-ত্রুটি থাকে, খাদিজারও তাই থাকবে। মানুষের সম্পর্ক ভাঙবে, মানুষ নতুন করে কারো হাতে হাত রাখবে। কখনও সে হারিয়ে যাওয়া প্রেম পুষেও রাখবে বুকে। পুষে রাখা প্রেম কি প্রেমিক বা প্রেমিকাকে কুপিয়ে খুন করতে শেখায়? বলবেন তো একেকজনের মনের গঠন, প্রকৃতি একেকরকম। হ্যাঁ এই জায়গায় আমি আপনার সাথে একমত। একেকজন তো একেকরকম হবেই। কেউ হারিয়ে যাওয়া প্রেম বুকে পুষে রেখে কবিতা লিখবে, গান গাইবে,কেউ হয়তো ফেরোসাস হয়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রতারণার শিকার হলে পুরুষ নারীকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা, শারীরিকভাবে মারধর করা এবং তারপরে কুপিয়ে মারার মানসিকতায় চলে যায়, কোন নারীকে এরকম ঘটনায় যেতে আমরা কালেভদ্রে দেখি। কেন? কারণটা কি পুরুষতন্ত্র নয়?
হ্যাপি রুবেলের ঘটনা আপনাদের মনে পড়ে? রুবেল খেলে যতটা না তারচেয়ে বেশি নায়ক হয়ে উঠেছিল এই ঘটনায়। সে ‘ব্যাটার মতো ব্যাটা’ উপাধি পেয়েছিল আর হ্যাপি হয়েছিল বেশ্যা। বেশ্যা না হলে এই ঘটনা নিয়ে কেউ আদালত পর্যন্ত যায়? এরকমই ছিল সমাজের ভাবনা। রুবেল যখন মাঠে বল করেছে, কেউ তারে প্রতারক বলে নাই, হ্যাপির সাথে সে যে অন্যায় করেছে এই কথা কেউ বলে নাই। সবাই ব্যাপারটাকে বেশ লাইটলি ডিল করেছে। দুজন প্রপ্তবয়স্ক নারী পুরুষের ঘটনা এভাবে সামনে আনায় হ্যাপির সমালোচনাও করেছেন নারী-পুরুষ সমান অধিকারে বিশ্বাসী সুশীলজনেরা। ধরেন এরকম প্রতারণার অভিযোগ রুবেল হ্যাপির ক্ষেত্রে আনলে কি হতো ভাবুন তো? না কি অভিযোগ টভিযোগের ধার আজকের সমাজের পুরুষরা আর ধারেন না, সোজা কোপ!
এইসব ঘটে ওই একটা কারণেই। নারীকে মানুষ হিসেবে না দেখায়। সিমন দ্যা বুভেয়ার এর সেই বিখ্যাত লাইন। নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে। নারীও ধীরে ধীরে মানবশিশু থেকে নারীতে রূপান্তরিত হয়, সমাজও তার স্বার্থে সেই হিসেবে তৈরি করে। এই সেদিনই একই সাথে দৌড়াচ্ছি নিউজের কাজে, আমার সহকর্মী বলল, আপা এতো বড় ব্যাগ নিয়ে আসেন খাবারদাবার নিয়ে আসতে পারেন না?
আমি বলি, কি খাবার-দাবার?
সে বলে, ক্যান পিঠাআঠা বানায়ে আনবেন।
আমি বললাম বাড়ি গিয়ে আপনি পিঠা বানান অফিস শেষে?
সে বলল, আমি বানাবো কেন? পুরুষমানুষ!
ডিউটি আওয়ার তারচেয়ে আমার কম নয়, তার পদও আমার চেয়ে বড় নয়, সে কোনমতেই আমার চেয়ে বেশি শিক্ষিত নয় কিন্তু সে আশাই করে আমি ‘পিঠাআঠা’ বানিয়ে আনবো, এইটা আমারই কাজ। একসংগে চলি-ফিরি, কাজ করি বা কমান্ড করি, সমাজ এখনও আমাকে বা আমাদেরকে স্রেফ ‘পিঠাআঠা’ বানানো নারী হিসেবেই দেখে।
কোপ খাই আর যা খাই, যতদিন মনের ভেতর বদরুল নিয়ে ঘুরবে এই সমাজ, এসবের বিরুদ্ধে লড়াইটাও জারি থাকবে।
লেখক: সাংবাদিক