নারীর সাফল্য বনাম টানাপোড়েনের যন্ত্রণা
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ২০:৩৬
কন্যা বিদায়ের কষ্ট পাচ্ছি।
এমন কত দিন গেছে ভোর ছয়টায় উঠে অফিসের জন্য তৈরি হয়েছি। আমার মেয়ে বিছানা হাতড়ে আমাকে খুঁজেছে। আমি সন্তর্পণে পাখীকে ডেকে দিয়েছি, ও এসে নহলীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। আমি নিশ্চিন্তে অফিসে গিয়েছি।
এমন কত দিন গিয়েছে সারাদিন অফিস শেষে অফিসিয়াল পার্টি। আমি অফিস থেকেই ফ্রেশ হয়ে বের গিয়েছি। পাখীকে বলেছি আমার ফিরতে দেরী হবে রে। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে নির্ভর করা কণ্ঠ শুনেছি "কোন অসুবিধা নাই আন্টি, নহলী আমার সাথে ঠিক আছে"।
কতদিন দুপুরে পাখী ফোন করে ধমক দিয়েছে, "আন্টি খেয়েছেন? এখনও খান নাই? আপনার গ্যাস্ট্রিক হবে না তো কার হবে?" আমার মা- বাবা, ভাই-বোন, স্বামী বা বন্ধু নয় এ পৃথিবীতে একজন মানুষই ছিল যে আমার দুপুরে খাওয়া না খাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হতো, সে পাখী। ওকে আমি বলতাম, নহলী আর কতটা তুইই আমার আসল মেয়ে রে। আমার এই চাকরী, আমার চ্যালেঞ্জ তুই না থাকলে সামলাতে পারতাম না।
সেই পাখী। ১৪/১৫ বছর বয়স। ওর বিয়ে। ছেলে বিদেশ যাবে লন্ড্রীর কাজ নিয়ে। ওকে বিয়ে করে শাশুড়ীর সেবার জন্য গ্রামে রেখে যাবে। পাখীরও পূর্ণ সম্মতি। ফলে আমার আর কিছু করারও নাই।
আমি কিভাবে অফিস আর বাড়ি সামলাবো ভেবে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে আরও কর্মজীবী নারীদের কথা ভাবি। পাখী কি সবার জোটে? একটা সময় ছিল সস্তাশ্রমের এইসব পাখীদের দিয়ে করানো হতো দাসত্ব। বছরে কয়েক সেট কাপড়, তিনবেলা খাবার, কিছু তেলসাবানের বদলে আমাদের আপাদমস্তক সুখী করার সব শারীরিক পরিশ্রম তারা করে যেতো। সুখের কথা, সময় বদলেছে। পাখীরা এখন অত সস্তা নয়। ভাত-কাপড় ছাড়াও সম্মান আর স্বীকৃতি যে একটা মানুষের প্রয়োজন তা এদেশের অন্তত: কর্মজীবী মায়েরা বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, এই কঠিন শহর আর সমাজে আর কেউ নয়, কাঁধে নির্ভরতার হাতটা রাখে পাখীরাই। তাই তারা পাখীদের শুধু পরিবার নয় বরং নিজের অংশ মনে করে।
কিন্তু যারা পান না এই সুবিধাটুকু? রিপোর্টের জন্য ডেকেয়ার সেন্টার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কয়েক মায়ের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। প্রত্যেকটা নারী লিটারালি কাঁদলেন। কেউ ক্যামেরার সামনে লুকালেন সে কান্না কেউ আবার লুকালেনও না। এক মা বললেন,
"আপা ইউএসএইড সাপোর্টেড একটা প্রোজেক্টে ৩০০০০ টাকা বেতনের চাকরী করতাম। বাচ্চারা বড় হতে লাগল, বাসায় দেখার কেউ নাই, স্কুলে নেয়ার কেউ নাই, কাজের যে লোক আছে তাদের কাছে কি খায় না খায়, সারাদিন মুখ শুকনা করে ঘুরে, আমার মনে হলো সংসারটাই জরুরী, স্বামীও বললেন, চাকরী ছাড়াই ভালো। ছেড়ে দিলাম। না অর্থনৈতিক কোন সমস্যা হয় না, যখন যা চাই স্বামী দেয়, কিন্তু এতো কান্না পায়! আমার জীবনটা কই? আমি যাতে প্রায়োরিটি দিলাম তাই কি আমার প্রায়োরিটি ছিল?"
ভদ্রমহিলাকে আমি ডিলেমা থেকে বের করার চেষ্টা করি, রিপোর্টিংও করি। বলি, কেন এরকম মনে হচ্ছে আপনার? আপনি সন্তান লালন করছেন মানে তো সমাজ বিকাশেও ভূমিকা রাখছেন।
উত্তরে তার হাহাকার এখনও আমার কানে বাজে,
"কিন্তু আমার জীবন! আমার কাজের জায়গা?"
স্কুলের সামনে বসা কয়েক মায়ের ইন্টারভিউ করি। বিরক্ত বিধ্বস্ত নারীগণ। বলেন, এইযে এইভাবে দিনের পর দিন পার করছি সময়, বাচ্চা কোথাও নিশ্চিন্তে রাখতে পারবো এমন ব্যবস্থা কি করতে পারে না?
কে এই ব্যবস্থা করবে আমি আসলেই জানি না। শুধু এইটুকু জানি, এদেশে বাচ্চার শুকনো মুখ, বাচ্চার একাকীত্ব-এইসব শুধু মায়েদের চোখেই পড়তে হয়। বাবাদের অত চোখে না পড়লেও চলে। ইউরোপের কিছু কিছু দেশে প্রসূতি মায়েদের ট্রেনিং-এ শেখানো হয়, বাচ্চা রাতে কাঁদলেও কোলে না নিতে। অন্তত: ১৫ মিনিট। তার বেশি হলে কোলে নেয়ার নির্দেশনা। ব্যক্তি স্বতন্ত্রতার শিক্ষা দেয়া হয় ছোটবেলা থেকেই। শিল্পনির্ভর নগরায়নের লক্ষ্যে এই ব্যাক্তিস্বতন্ত্রতার চাষবাস হয় সেদেশে। এই চাষাবাদ ভালো না খারাপ তা নিয়েও গবেষণা হচ্ছে বিস্তর। যৌথজীবনের সৌন্দর্য অস্বীকার করায় এখন সমালোচনা হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে পরিবারহীনতা ভোগাচ্ছেও সেসব দেশের মানুষদের।
কিন্তু এদেশের মেয়েরা যারা শুধুই বাচ্চা পালতে হবে বলে বুকে পাষাণ চেপে ছেড়ে দেয় কষ্ট করে পাওয়া চাকরিটি অথবা ভয়ংকর রকম ওয়ার্ক লোড নিতে পারবেন না বলে ছাড়েন কতজন। কত মেয়ে বাচ্চা হওয়ার পর আর ফিরতেই পারে না কর্মক্ষেত্রে। কত মেয়ে নিজেকে ক্ষইয়ে দশভূজা হয়। সেদিন আমার এক সহকর্মী যার কয়েকমাসের বাচ্চা কিন্তু রাতের শিফটে কাজ করতে হয়, বলছিল,
"আপা কতদিন একটু আরাম করে ঘুমাই না। আরাম করে ঘুমাতে হলে চাকরিটাই ছাড়তে হবে। কোনটা যে জরুরী আপা সেটাই মাঝেমধ্যে গুলিয়ে ফেলি।"
আমারও মনে হয়, এই দেশে মেয়েদের চাকরী বা বাইরে কাজ করা না করার ব্যাপারটা অনেকটা প্রায়োরিটি সেটিং এর উপর নির্ভর করে। "আপনার কাছে বাচ্চা আগে না টাকা কামাই" এ ধরনের বক্তব্যের মুখোমুখি হতে হয়। অথচ চাকরী বা কাজ তো শুধুই টাকা কামাই নয়, এটা আইডেনটিটি। নারী উন্নয়ন নীতিতে খুবই অবহেলার সাথে লেখা আছে প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী কর্মক্ষেত্রে ডে কেয়ার সেন্টার রাখতে হবে। সরকারীভাবে যে কয়টা আছে সেগুলোর চেহারা দেখলে যেকোন মায়ের আসলেই চাকরী ছাড়তে ইচ্ছা করবে। বেসরকারীগুলোও এতই অপ্রতুল যে উল্লেখের মধ্যেই আনার মতো নয়।
এখন এই যে আমাদের মন্ত্রী-মিনিস্টার, আমাদের নারীবান্ধব সরকারি নীতি তারা নারীর সাফল্য উদযাপন করেন ঢোল পিটিয়ে, কিন্তু কর্মজীবী নারীর প্রতিদিনের যন্ত্রণা আর দোলায়মানতার ভাগ নেন কখনও? পাখীরা চিরকাল তো সার্ভিস দেবে না, তাদেরও নিজের জীবন হবে। তাহলে সমাধানটা কি? এবং কে দেবেন সমাধান?
লেখক: সাংবাদিক