রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও প্রকৃত তথ্য

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৩:৫২

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: “বায়ু প্রবাহ সুন্দরবনের বিপরীত দিকে, সুন্দরবনের উল্টো দিকে প্রবাহিত হবে।” 

প্রকৃত তথ্য: বছরে অন্তত চারমাস বাতাস বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর যাই হোক বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তন করার দাবী নিশ্চয়ই কেউ করবেন না! সরকারি ইআইএ রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি– বছরের এই ৪ মাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে: 

“Only during November to February, prevailing wind flows towards South and rest of the year it flows mostly towards North. In most of the time of a year, emissions from power plant shall not reach the Sundarbans except November to February.” [সূত্র: রামপাল ইআএ পৃষ্ঠা- ২৮৪] 

সুন্দরবনের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য এই চার মাসই যথেষ্ট। তাছাড়া ঘূর্ণি বাতাস ঝড় ইত্যাদি নানা কারণেই এই চারমাস ছাড়াও বছরের অন্য সময়েও বাতাস সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হতে পারে। আরেকটি বিষয় হলো, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষণ শুধু বায়ুবাহিত নয়, যে বাতাস চার মাস ধরে সুন্দরবনের দিকে প্রবাহিত হবে বলে কেবল চার মাসই পরিবেশ দূষণ ঘটবে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পানিদূষণ, শব্দদূষণ, ছাইয়ের দূষণ, কয়লা পরিবহণের কারণে দূষণ সারা বছর ধরেই ঘটবে যার সঙ্গে বাতাসের দিকের কোনো সম্পর্ক নেই।   

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: দূষিত বা গরম পানি পশুর নদীতে ফেলা হবে না।  

প্রকৃত তথ্য: পশুর নদীতে যে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ ডিগ্রী বেশি গরম পানি ফেলা হবে সেটা খোদ কোম্পানি স্বীকার করছে। [সূত্র:http://www.prothom-alo.com/opinion/...] প্রকৃত পক্ষে আরো বেশি গরম পানি ফেলার আশংকা রয়েছে কারণ কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্র বিষয়ে জাইকার একটি রিপোর্টে থার্মাল ইফ্লুয়েন্ট নির্গমনের ফলে পানির তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং এর ফলে মাছের ক্ষতি হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

[সূত্র:http://open_jicareport.jica.go.jp/pdf/12233847.pdf]   

আর ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মাধ্যমে দূষিত পানি পরিশোধন করে নদীতে নির্গমনের কথা বলা হলেও কার্যকারিতা নিয়ে আশংকা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৭২ টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে ১৮৮টি থেকে নদীতে পানি নির্গমনের বেলায় আর্সেনিক, বোরন, কেডমিয়াম, সীসা, পারদ এবং সেলিনিয়ামের কোন সীমা বা মাত্রা মেনে চলা হয় না। 
[সূত্র:http://action.sierraclub.org/site/DocServer/ClosingTheFloodgates-Final.pdf?_ga=1.209408273.2015114875.1470569568] 

নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট থেকেও দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা, কেনটাকি, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও সহ ১০টি রাজ্যের ২১টি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নদী ও জলাভূমিতে ফেডারেল ড্রিংকিং স্ট্র্যান্ডার্ডের চেয়ে ১৮গুণ বেশি আর্সেনিক সম্পন্ন পানি নির্গত করেছে। আর ঢাকার নদীগুলোতে প্রতিদিন ৯০ হাজার ঘনমিটার তরল বর্জ্য কোন ধরণের পরিশোধন ছাড়াই ডিসচার্জ করা হয়। ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা হয় না, কারণ প্রতিঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন করতে ৩০ টাকা করে লাগে! [সূত্র: বণিক বার্তা, ২ এপ্রিল, ২০১৬] শুধু বেসরকারি কারখানা নয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশনের (বিসিআইসি) ১৪টি কলকারখানার ১০টিতেই নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা। সাতটিতে নেই কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি)। আর পাঁচটি কারখানার কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রই নেই। গত মে মাসে পরিবেশ অধিদপ্তরের তৈরি করা প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।

[সূত্র: http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/959209/] 

এইরকম একটা অবস্থায় কিভাবে ভরসা রাখা যেতে পারে যে, ঢাকা থেকে বহু দূরে সুন্দরবনের প্রান্তে ঠিকঠাক মতো পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলা হবে! 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: (বনাঞ্চলের ২৫ কিমি এর মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করা বিষয়ে ভারতের গাইড লাইন প্রসঙ্গে) “ভারতের মতো বিশাল দেশের সাথে তুলনা করা আমাদের খাটে না” 

প্রকৃত তথ্য: কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ কোন দেশের আয়তনের উপর নির্ভর করেনা অর্থাৎ দেশের আয়তন বড় হলে দূষণ বেশি হবে আর আয়তন কম হলে দূষণ কম হবে এরকম মনে করার কোন যুক্তি নেই। ফলে ভারতে ২৫ কিমি সীমার মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র যদি নিরাপদ না হয় তাহলে বাংলাদেশ ছোট দেশ হওয়ার কারণে সেই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরাপদ হয়ে যাবে- এটা কোন যুক্তি হতে পারেনা। বরং ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি ও বনাঞ্চল-নদী-কৃষি-জীবন-জীবিকা ইত্যাদি জালের মতো পরস্পরের ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকার কারণে এখানে বরং ক্ষতি আরো বেশি হওয়ার কথা, সেই কারণে ভারত থেকে আরো বেশি সাবধান হওয়া দরকার।  

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: কয়লা পরিবহনের বেলায় শব্দ আলো দূষণ সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখা হবে, কাভার্ড বার্জে করে কয়লা পরিবহন করা হবে। 

প্রকৃত তথ্য: রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লার জাহাজ চলাচলের ফলে সুন্দরবনের যে বিপদ সম্পর্কে আমরা এতদিন ধরে বলে আসছি, খোদ কোল ট্রান্সপোর্ট ইআইএ রিপোর্টেও তার অনেকগুলোই উঠে এসেছে: যেমন- জাহাজ থেকে কয়লার গুড়ো ও ধুলা ছড়ানো, জাহাজ ডুবে তেল ও কয়লা ছড়ানো, কয়লার জাহাজ থেকে বর্জ্য নি:সরণ, আলো দূষণ, জাহাজ রুটের মধ্যে থাকা ডলফিন অভয়ারণ্য সহ বিপন্ন প্রায় বণ্য প্রাণী আরো বিপন্ন হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু ইআইএ রিপোর্টে এইসব ক্ষতি ও ঝুকি মোকাবেলার জন্য দায়সারা ভাবে আইএমও কনভেনশান মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, কয়লার জাহাজ ধীরে চালানোর কথা বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় সিটি না বাজানোর কথা বলা হয়েছে, জাহাজের বর্জ্য যত্রতত্র না ফেলার কথা বলা হয়েছে, কয়লার স্বপ্রজ্জ্বলন এড়ানোর জন্য অগ্নি প্রতিরোধক পিচ্ছিলকারক ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে… যেগুলোর ব্যবহার ও বাস্তবায়ন ভীষণ অনিশ্চিত।সবচেয়ে বড় কথা এগুলো বাস্তবায়িত হলেও সুন্দরবনের বিপদ কমবেনা কারণ- জাহাজ চলাচল করলে দুর্ঘটনা ও দূষণের ঝুকি থাকবেই, জাহাজ চলাচল রুটের ডলফিন অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবেই, জাহাজের ঢেউ, শব্দ, আলো ইত্যাদির মাধ্যমে জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হবেই। 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বিদ্যুৎকেন্দ্রের শব্দ ১৪ কিমি দূরে যাবে কি ভাবে?

প্রকৃত তথ্য: বিদ্যুৎকেন্দ্রের শব্দ ১৪ কিমি দূরে সুন্দরবনের মধ্যে যাবে না কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে জাহজে করে যে কয়লা পরিবহন করা হবে, কয়লা লোড আনলোড করা হবে, ড্রেজিং করা হবে তার ফলে সুন্দরবনের মধ্যে শব্দ দূষণ ঘটবে। 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বিদ্যুতের দাম ৮.৮৫ টাকা সঠিক তথ্য নয়। 

প্রকৃত তথ্য: প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আট টাকা উপরে সরকারি রিপোর্টেই বলা হয়েছিলো এবং সে সময় এফজিডির মতো ব্যয়বহুল টেকনোলজি ব্যবহার ছাড়াই এই হিসেবটি করা হয়েছিলো। ফলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আরো বাড়বে। 

the cost of electricity production has been estimated as BDT. 8.49 per kwh for first full year and BDT. 8.04 per kwh for levelised cost of energy. (সূত্র: রামপাল ইআইএ পৃষ্ঠা-৪১৩) 

সস্তায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলে সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, তাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকী লাগবে। Institute of Energy Economics & Financial Analysis  এর হিসেব অনুসারে ভর্তুকী না দিলে ইউনিট প্রতি খরচ পড়বে ৯.৫৪ টাকা!

The Rampal power plant would require a levelized tariff of Tk9.54/kWh (US12.1c/kWh) in the absence of any subsidies. 

[সূত্র:http://ieefa.org/wp-content/uploads/2016/06/Risky-and-Over-Subsidised-A-Financial-Analysis-of-the-Rampal-Power-Plant-_June-2016.pdf]

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: ”বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। সেখানকার মানুষের বর্তমান পেশা সুন্দরবন থেকে চুরি করে গাছ কাটা, গাছ কাটতে গিয়ে বাঘের পেটে যাওয়া”  

প্রকৃত তথ্য: এটা সুন্দরবনের চারপাশে থাকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিদারুণ অপমানজনক এবং অসত্য একটি কথা। বাস্তবে দরিদ্র জনগণ অর্থাৎ মৌওয়াল, বাওয়ালি, জেলেসহ সুন্দরবন অঞ্চলের দরিদ্র জনগণ সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থান বা ইকোসিস্টেমের অংশ হিসেবে যুগ যুগ ধরে সুন্দরবনের সঙ্গে সহাবস্থান করছে। সুন্দরবনের আসল বিপদ হল বিভিন্ন লুটেরা কর্তৃক সুন্দরবনের গাছ লুট, বাঘ-হরিণ শিকার, বন্যপ্রাণি পাচারসহ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো কথিত উন্নয়ন প্রকল্প যেসবের হাত থেকে প্রিয় বনবিবিকে রক্ষা করতে সুন্দরবনের দরিদ্র মানুষ প্রতিনিয়ত লড়াই করছে। আর ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ পর্যায়ে ৪ হাজার অস্থায়ী কর্মসংস্থান এবং পরিচালনা পর্যায়ে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৬০০ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও পরিচালনায় মূলত কারিগরী জ্ঞান সম্পন্ন লোকের কর্মসংস্থান হয় বলে এসব কর্মসংস্থানের খুব সামান্যই স্থানীয় জনগণের ভাগ্যে জুটবে। চার থেকে সাড়ে চার বছরের নির্মাণ পর্যায়ে বড় জোর মাটি কাটা, মালামাল পরিবহণ, নির্মাণ কাজের শ্রমিক ইত্যাদি কিছু অস্থায়ী মজুরি ভিত্তিক কর্মসংস্থান জুটতে পারে স্থানীয় কিছু মানুষের। কিন্তু পরিচালনা পর্যায়ে যে ৬০০ কর্মসংস্থান হবে তার বেশিরভাগই কারিগরী হওয়ার কারণে সেখানে খুব কম সংখ্যক স্থানীয় মানুষেরই কাজ জুটবে। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও চালু হলে কি পরিস্থিতি হবে তার লক্ষণ কিন্তু এখনই ধরা পড়ছে। কৃষি জমি থেকে যাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের পরিস্থিতি কি? তাদের কি অনেক উন্নয়ণ হয়েছে? সাপমারী ও কৈগরদাসকাঠী মৌজায় ৮টি ইউনিয়নের ৪০টি গ্রামের ২ হাজার পরিবার এই প্রকল্পের কারণে ইতিমধ্যেই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। আর বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে মাটি পানি বাতাস মারত্মক দূষিত হয়ে সুন্দরবন ও তার চারপাশের জলাভূমির উপর নির্ভরশীল জেলে, কৃষক, বাওয়ালী, মউয়াল সহ কয়েক লক্ষ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। উদাহরণ স্বরুপ মৎসজীবিদের জীবিকা বিনষ্ট হওয়ার কথা খোদ কোল ট্রান্সপোর্ট্ ইআইএ রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে:
 
স্থানীয়দের জীবিকার উপর প্রভাব: কয়লা পরিবহনের ফলে পশুর নদীতে নৌচলাচল বৃদ্ধি পাবে। ফলে নৌপথে জেলের মাছ ধরতে পারবে না। ফলে তাদের কিছু অসুবিধায় পড়তে হবে যদি নৌপথে মাছ ধরা নিষিদ্ধ [হয়]।”(কোল ট্রান্সপোর্ট ইআইএ সামারি, পৃষ্ঠা-৪) 

[বিস্তারিত: https://bifpcl.com/wp-content/uploads/2016/08/Coal-Transport-EIA.pdf]  

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে। উন্নত প্রযুক্তি অসম্ভবকে সম্ভব করে। রিয়েলটাইম মনিটরিং এর ব্যবস্থা থাকবে। ইএসপি এফজিডি উচু চিমনী ব্যবহার করা হবে। 

প্রকৃত তথ্য: কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুষণ বিষয়টা এরকম যে কোন টেকনোলজি ব্যবহার করেই সেই দূষণ শতভাগ দূর করা যায় না। উদাহরণ স্বরুপ এফজিডির কথাই ধারা যাক। এফজিডি ব্যবহারে করে বিপুল অর্থ ব্যায়ের মাধ্যমে বাতাস থেকে সালফার অপসারণ করা সম্ভব হলেও তার ফলে পানি দূষণ বেড়ে যায়।  এফজিডি বা স্ক্রাবার ব্যবহারের বিপদ হলো-কয়লা ও লাইমস্টোন থেকে ‘এফজিডি ওয়েস্ট ওয়াটার’এ চলে আসা দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ( ক্লোরাইড, সালফেট, বাইকার্বনেট), ভাসমান কঠিন পদার্থ(জিপসাম, ফ্লাই অ্যাশ), অ্যামোনিয়া, বিষাক্ত ভারী ধাতু যেমন আর্সেনিক, মার্কারি, সেলেনিয়াম, বোরন ইত্যাদি। ব্যবহৃত কয়লা ও লাইমস্টোনের ধরণ অনুযায়ী এসবের মাত্রা বিভিন্ন রকম হয় বলে এসব পরিশোধণের কোন একক ‍“ওয়ান-সাইজ-ফিট-ফর-অল” পদ্ধতি নেই, এগুলো পরিশোধন করাও দূরহ ও ব্যয়সাপেক্ষ।

[সূত্র: http://www.powermag.com/flue-gas-desulfurization-wastewater-treatment-primer/?pagenum=2] 

নিউইয়র্ক টাইমসের Cleansing the Air at the Expense of Waterways শীর্ষক রিপোর্ট অনুসারে [লিংক: http://www.nytimes.com/2009/10/13/us/13water.html?_r=0] বায়ু দূষণমুক্ত করার জন্য স্ক্রাবার ব্যবহার করা হবে জেনে ২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভিনিয়ার হ্যাটফিল্ড’স ফেরী(Hatfield’s Ferry) কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের ভুক্তভোগীরা খুশীই হয়েছিলেন। কিন্তু তারা দেখলেন স্ক্রাবার ব্যবহার করার ফলে বাতাস কিছুটা দূষণ মুক্ত হচ্ছে, কিন্তু তার বদলে দূষিত হচ্ছে পানি! এ প্রকৃয়ায় সৃষ্ট বিপুল পরিমাণ তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী মননগাহেলা (Monongahela) নদীতে যে নদী ৩ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের খাওয়ার পানির যোগান দেয়। তাইতো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৫ মাইল বা ২৪ কিমি দূরে বসবাসকারি ফিলিপ কোলম্যানের উপলব্ধি- “মনে হচ্ছে তারা আমাদেরকে নি:শ্বাসের মাধ্যমে বিষ গ্রহণ থেকে মুক্তি দিয়েছে, বিনিমিয়ে আমাদেরকে সেই বিষ পানির সাথে পান করতে হচ্ছে।” (সুন্দরবনের দূরত্ব কিন্তু ১৪ কিমি এবং পশুর নদী ঠিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশ দিয়ে গেছে!) 

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বড় পুকুরিয়ায় সাবক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন ক্ষতি হচ্ছে এরকম কথা একবারও কেউ লিখতে পারে নাই। 

প্রকৃত তথ্য: এই বক্তব্যরে মধ্যে অনকেগুলো ভুল ধারণা আছ। প্রথমত, আমরা জানি না কোন সমীক্ষার ভিত্তিতে তিনি এই কথা বলছেন।বাস্তবে কেউ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশপাশে গেলেই দেখতে পাবেন পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহ উদাহরণ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারপাশের কৃষিজমি কয়লা দূষণে রীতিমত কালো রঙ ধারণ করেছে, মাটির নিচের পানির স্তর নেমে গেছে, ছাইয়ের পুকুরে গাদা করে রাখা বিদুৎ কেন্দ্রের ছাই পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। ২০১৪ সালে রাজশাহী ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি থেকে গবেষণা হয় বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে। গবেষণা থেকে দেখা যায়-
 
১)কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ঘন্টায় ৯ ঘনমিটার হারে দূষিত পানি নিকটস্থ তিলাই নদীতে ডিসচার্জ করা হচ্ছে কোন ধরণের পরিশোধন ছাড়াই;
২)ছাইয়ের পুকুরে থাকা তরল বর্জ্যে অতিরিক্ত বোরন, আর্সেনিক, পারদ পাওয়া গেছে যা চুইয়ে মাটিতে মিসছে যার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে এবং ক্রমশ ব্যবহারের অনুপযোগি হচ্ছে;
৩)বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সালফার ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড ও ধুলোকণার ইমিশনের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি;
৪)আশপাশের ১৪ শতাংশ মানুষ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে অ্যাজমা, এলার্জি, চর্মরোগ সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। গবেষকদল নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকের সাথে কথা বললে তারাও বলেছেন ২০০৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকে এইসকল অসুখ বেড়েছে।
৫) ফ্লাই অ্যাশের কারণে আশপাশের মাটির ক্ষারত্ব বেড়ে গেছে যা মাটিতে বসবাসকারী কেচোর জন্য ক্ষতিকর।
৬)৪৭.৩৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফসলের উৎপাদন হ্রাস, বাতাসে ও গাছের পাতায় ছাইয়ের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন।

[সূত্র: https://globaljournals.org/GJRE_Volume14/7-Study-of-Environmental.pdf ]

দ্বিতীয়ত, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনা করাই সঠিক নয়। কারণ বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছোট আকারের এবং বড়পুকুরিয়ার পাশে সুন্দরবনের মতো স্পর্শকাতর বনাঞ্চল নেই। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট যার মধ্যে আবার কার্যত ১২৫ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটই কেবল চালু থাকে। অথচ রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট যা বড়পুকুরিয়ার কার্যকর (১২৫ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ গুণেরও বেশি। ফলে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফলে তার দশগুণেরও বেশি ক্ষতি হবে।  

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: বড় পুকুরিয়ায় জমি উর্বর হচ্ছে, ফসলের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে।(বেগুন ক্ষেতে ছাই ছিটিয়ে জমি উর্বর করার উদাহরণ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী)  

প্রকৃত তথ্য: প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত কাঠ পুড়িয়ে তৈরী জৈব ছাই এবং খনিজ কয়লা পুড়িয়ে তৈরী ছাইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে অবগত নন। কয়লা পুড়িয়ে তৈরী ছাই বিষাক্ত বলে এই ছাইয়ের মাধ্যমে জমি উর্বর করার চিন্তা বিপদজনক। ভারতের পরিবেশ মন্ত্রাণলয়ের এক্সপার্ট এপ্রাইজাল কমিটি গত ৬-৭ ডিসেম্বর ২০১০ এ কৃষি জমিতে ফ্লাই অ্যাশের ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলে:  

“Regarding use of Fly Ash in agriculture, the Committee also expressed its strong reservations considering that the available information is limited and not supported by long term scientific study. Considering that fly ash is reported to contain about 48 elements including radioactive elements and toxic heavy metals (in mild dose), the Committee advocated that unless scientific study rules out long term adverse health impacts, as such, this method of fly ash disposal shall not be resorted to.” 

বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ফসলের ফলন বাড়ছে কথাটি সঠিক নয়। সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণের কারণে কয়েক আশপাশের কয়েক কিমি এলাকার নারিকেল গাছে এখন আর নারিকেল হয় না। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভূগর্ভের পানি নীচে নেমে যাওয়ার কারণে পানি সংকট ও স্থানীয় জনগণের অসন্তোষের খবর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বরাবর বিশেষ সংস্থা থেকে চিঠি দিয়ে পর্যন্ত জানানো হয়েছে।  

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য: পৃথিবীর বহু দেশে শহরের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে যেগুলো থেকে কোন ক্ষতি হচ্ছে না(কয়েকটি দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি প্রদর্শন)  

প্রকৃত তথ্য: প্রধানমন্ত্রী ভারতের সাথে বাংলাদেশের তুলনা দিতে রাজী নন, কিন্তু কঠোর পরিবেশ আইন মেনে চলা হয় এরকম দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা কিন্তু ঠিকই দিলেন। অথচ বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা হলো, যেসব দূষণ কারিগরি ভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য সেগুলোও নিয়ন্ত্রণ করা হয় না যেকারণে বুড়িগঙ্গা শীতলক্ষা কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ ঘনমিটার পানি পরিশোধণ না করেই ফেলা হয়। আরেকটা মুশকিল হলো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছবি দেখে বোঝার কোন উপায় নেই দূষণ হচ্ছে কি হচ্ছে না। সব গাছ পালা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে সমান ভাবে ক্ষতি গ্রস্থ হয় না। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে গাছপালা থাকা মানেই যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে কোন ক্ষতি হচ্ছে না- এরকম ধরে নেয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী যে কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কথা বলেছেন সেগুলো সম্পর্কে খোজ খবর করলেই দেখা যাবে সেগুলোর প্রকৃত অবস্থা কি। যেমন: ইউসেস্কো ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট হা লং বে’র পাশ্ববর্তী ভিয়েতনামের Quang Ninh কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বন্যা ও জলোচ্ছাসের সময় বিপুল পরিমাণ কয়লা দিয়েন দিয়েন ভং নদীতে ভেসে গেছে, ব্যাপক নদী দূষণ ঘটেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সহ আরো কিছু কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য হা লং বে’ও মারাত্মক দূষণের শিকার হয়েছে।     

[সূত্র: http://english.vietnamnet.vn/fms/business/137524/coal-industry-suffers--25-million-in-damages-after-floods-in-quang-ninh.html http://www.ecowatch.com/toxic-floods-from-coal-mines-and-power-plants-hit-vietnams-ha-long-bay-1882080179.html

শহরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলে আশপাশে কি ধরণের সমস্যা হতে পারে তার নজির Quang Ninh প্রদেশে যথেষ্টই রয়েছে। the pollutants started to flow into the Cam River days after the plant opened. Dust generated by the plant also blankets the area, choking residents.... 

[বিস্তারিত: http://vietnamnews.vn/environment/243668/power-plant-pollution-engulfs-residents.html]   

ছবিতে যেমনই দেখা যাক, তাইওয়ানের Taichung কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে দুনিয়ার অন্যতম দূষণকারী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলা হয়। এই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে তাইওয়ানের মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চলে বায়ু দূষণ এত বেড়েছে যে এক পর্যায়ে আন্দোলনের মুখে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।   

[সূত্র: http://www.taipeitimes.com/News/taiwan/archives/2016/03/07/2003641014 http://focustaiwan.tw/news/asoc/201511150019.aspx]   

 [এই লেখায় কেবল কারিগরী দিকগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।]    

লেখক: প্রকৌশলী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে jagoroniya.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরণের দায় গ্রহণ করে না।
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত