মার্গারিটা মামুন ও আমাদের পরধনে পোদ্দারি
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০১৬, ১৪:৫৯
গতকাল থেকে খুব হৈচৈ হচ্ছে, স্বনামধন্য ও শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা গলা বাড়িয়ে বাঙালি বাঙালি বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে, দেশের পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী সংবর্ধনা জানাচ্ছেন মেয়েটিকে। বলছিলাম, বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অলিম্পকে স্বর্ণ জয়ী মার্গারিটা মামুনের কথা। তাকে নিয়ে আমার আলাদা কোন গর্ব নেই। ভালোলাগা আছে, এই সমান ভালোলাগা আছে রুশ টেনিশ তারকা শারাপোভার জন্যও। বাঙালি সমাজ খুব পরের ধনে পোদ্দারি করতে পছন্দ করে। এখন আমরা মার্গারিটারর ক্ষেত্রে যা দেখছি তা মিথ্যা আত্মতুষ্টি। পরের ধন দিয়ে পোদ্দারি। এটা মাইকেল মধুসূদনের সেই কথাই, 'পরধনে লোভে মত্ত কুক্ষনে আচরি'। অথচ এই মেয়ের বাবা বেশ অনেক বছর আগে আমাদের দেশের অলিম্পিক কমিটিকে নাকি তার মেয়ের কথা জানিয়েছিলেন কিন্তু আমাদের কর্তারা এতে তেমন আগ্রহ দেখাননি। আমরা এই রকম একটি আত্মতুষ্টির বা পোদ্দারির ঘটনা এর আগে দেখেছিলাম, ব্রিটেনের 'ইন টু দ্যা লাইটস অফ হোয়াট উই নো' খ্যাত লেখক, জিয়া হায়দার রহমানের ক্ষেত্রে। তাকে নিয়েও আত্মতুষ্টিতে ভুগেছে এই সমাজ। অথচ ঐ লেখক নিজেই বলছেন আমি বাঙালি না ব্রিটিশ। যে মেয়েটিকে নিয়ে কথা বলা হচ্ছে, সে কি নিজেকে বাঙালি ভাবে? তার না ভাবা কোন অপরাধ নয়। কিন্তু আমরা যদি মিথ্যা তুষ্টি লাভ করি সেটা খারাপ। পরধনে লোভে মত্ত হই সেটা খারাপ হবে।
এই মেয়েটি বাংলাদেশে না আসায় বরং ভালো হয়েছে। সে এগিয়ে গিয়েছে। আমরা এর আগে দেখেছি, সাফ স্বর্ণ জয়ী শুট্যার আসিফকে এই দেশের পুলিশ কিভাবে পিটিয়েছিল। এতে আমাদের কোন লজ্জা লাগেনি। এই মেয়ে যে ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছে, সেই রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে কাপড় ও শারীরিক অঙ্গ ভঙ্গিমা একটা বিশেষ বিষয়। বাংলাদেশে কোন মেয়ে এই কাপড় পড়ে রিদমিক স্টাইল করলে তাকে ধর্ষণ করার সম্ভাবনা থাকতো খোদ এই দেশের অলিম্পিক কমিটির লোকদের দ্বারাই। ৯০ ভাগ মুসলিম এই দেশে রিদমিকের অপূর্ব দেহ শৈলীর কসরত উপস্থাপনার এই মেয়েকে নিয়ে এখন পোদ্দারি করছে সবাই, কিন্তু এই মেয়েই যদি বাংলাদেশে এই কাপড় পড়তো তাহলে কাজ সারছিলো।
দুই দিন আগে আমরা দেখেছিলাম, ইন্ডিয়ার এক মেয়ে পিভি সিন্ধু অলিম্পিকে ব্যাডমিন্টনে দুর্দান্ত পরিশ্রম করে রূপা জিতেছে। এটা এই অঞ্চলের সকল মেয়ের জন্যই সৌভাগ্য। ১২০ কোটি মানুষের ভারতে পিভি সিন্ধু একজন। সে অনেক পুরুষের থেকে অনেক সক্ষম ও এগিয়ে থাকা একজন মানুষ; নারী নয়। এই মেয়েটি কেবল ভারত নয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশে সহ সকল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্যই সুখবর বয়ে এনেছে। আপনি টেনিস খেলোয়াড় মেয়েগুলোর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকান। দুর্দান্ত ভালো লাগবে এদেরকে আপনার। আনা কুর্নিকোভা, মার্টিন নাভ্রাতিলোভা, মারিয়া শারাপোভা, সেরেনা বোনদ্বয়, সাবেক মার্টিনা হিংগিস। খেলার মাঠে এদের টান টান পেশিবহুল হাত পা দেখলে রক্ত হিম হয়ে আসে। পুরুষের মত মেয়েদেরও শারীরিকভাবে এতো ক্ষিপ্রগামীতা আছে তা অ্যাথলেট মেয়েদের না দেখলে বুঝা যাবে না। যে মেয়েদের এতো ক্ষমতা আছে আমরা কেবল মাত্র এদের শরীর আমাদের পুংদণ্ড ক্ষেপিয়ে দেবে এই ভয়ে ঘরের মধ্যে রেখে দিয়েছি। অথচ চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে, গড়পড়তার স্বাভাবিক পুরুষের চেয়ে একজন অ্যাথলেট নারী শারীরিক সক্ষমতায় এগিয়ে। আবার নারী ও পুরুষের জন্মগতভাবে মস্তিস্কের ওজনের কিছুটা তারতম্য থাকলেও এতে নারীর মাদাম কুরী হবার সম্ভাবনা আটকায় না। কিন্তু আটকে যায় সামাজিক কারণে।
আমরা আফগানিস্থান ও ইরানের ক্ষেত্রে দেখেছি, '৬০ ও '৭০ এর দশকে সেই দেশের মেয়েরা খেলাধুলা, বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা সহ ব্যাক্তিস্বাধীনতার নানান দিকে এগিয়ে ছিলেন কিন্তু তাদের এই যাত্রায় রণেভঙ্গ দিয়েছে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামী বিপ্লব। এই সব নারীরা আজ আটকে গেছেন সব দিক থেকে। আজকের যে বাংলাদেশ, দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তবু আমাদের শংকার শেষ নেই, কিভাবে আমাদের নারীরা এগুবে। দেশে একটা নারীনীতি বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না, সকল ধর্মের নারী পুরুষের জন্য বিয়ের একটা ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড প্রণয়ন করা যাচ্ছে না, নারীদের সম্পত্তিতে আজো সমানাধিকারের বিষয় নিয়ে কথা বলা যাচ্ছে না, হিন্দু কমিটির নেতারা বিয়ের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন মানছেন না, এই দেশের কোন নারী ধর্ষিত হলে তার বিচারের কোন মানবিক ভরসাস্থল আজো পাওয়া যায়নি, এখনো এই সমাজের নারীর নিজস্ব কোন 'রুম' নেই, তার সাথে ক্রমাগত এই দেশে বেড়ে চলছে নারী ও পুরুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে রক্ষনশীলতার চর্চা। সবকিছুই তারা এখন সামাজিক বিদ্যার পরিবর্তে ধর্মবিদ্যা দিয়ে মাপছেন। এইভাবে আমাদের সমাজ খুব খোলসাবৃত হচ্ছে দিনের পর দিন।
আফসানা নামের একটি মেয়ের ধর্ষণ নিয়ে আমরা সোচ্চার হচ্ছি না, সম্ভাবনাময় তনুরা হারিয়ে গেছে অথচ আমরা একটা স্বীকৃত সমাজের বেড়ে ওঠা মেয়ে মার্গারিটাকে নিয়ে পোদ্দারি করে বেড়াচ্ছি। কি ভয়ানক আত্মপ্রতারণাময় প্রপঞ্চে ডুবে আছি আমরা!
কিন্তু আপনি ময়মনসিংহের কলসি সুন্দর গ্রামের আমাদের কিশোরী মেয়েদের দিকে তাকান, কি অসাধারণ প্রতিভা এদের ফুটবল খেলায়। সাফ গেমসে কেউ দাঁড়াতে পারেনি তাদের সাথে। আমাদের নারীদের আমরা এখনো সক্ষমতার সিঁড়িতে চড়ার সুযোগ দিচ্ছি না, যদিওবা কিছু দেয়া হচ্ছে সেটার সাথে অনেক 'কিন্তু' যোগ করে দিচ্ছি। দৃশ্যমান অনেক বন্ধনে সে আবদ্ধ তো আছেই তার বাইরেও অনেক অদৃশ্য বন্ধন থেকেও রেহাই পাচ্ছে না। তাকে বলা হচ্ছে, বাইরে যাও কিন্তু রাত করে ফিরো না, কাজে যাও কিন্তু এতো ছুটোছুটি করো না, সংসার গুছিয়ে পরে সব করো, ইত্যাদি 'কিন্তু'বর্গ আটকে দিচ্ছে তার নতুন স্তরের অগ্রযাত্রা। আমরা তাদেরকে এখনো পূর্ণ স্বীকৃতি দিচ্ছি না।
যে মেয়েটা রিদিমিক জিমন্যাস্টিকস এ স্বর্ণ জিতেছে সে একটি পূর্ণ স্বীকৃত সমাজের মেয়ে। আমরা যদি আমাদের নারীদের স্বীকৃতি দেই, সুযোগ দেই তাহলে এই মিথ্যা আত্মতুষ্টি আমাদের করতে হবে না। আমাদের মেয়েদেরই সামর্থ্য আছে মার্গারিটা মামুন হবার। তখন আর আমাদের ধার করে গর্বিত হতে হবে না, আমাদের স্বীকৃত মেয়েরাই বাঙালীর সৃজনশীলতার পরিচয় এনে দেবে। স্বীকৃত সমাজের মার্গারিটা মামুনকে নিয়ে তখন আর পোদ্দারি করতে হবে না আমাদের, সমাজ প্রস্তুত থাকলে হাজারো মেয়েরাই তখন মার্গারিটা মামুন বা পিভি সিন্ধু হয়ে উঠবে।
লেখক: গবেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট