শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা
প্রকাশ : ১৯ মে ২০১৯, ১৭:০৫
স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বলতে আমরা মূলত বুঝে থাকি ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে জাতির জনক মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করার কথা। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্ত স্বদেশ ভূমিতে ফিরে আসার ঘটনা ছিল বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের আরেক আশীর্বাদ এবং বিজয়ের পূর্ণতা।
কিন্তু ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত দেশি-বিদেশি শক্তির গভীর ষড়যন্ত্রের ধারায় তাদের এ দেশীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের উপস্থিত সকল সদস্য। এর ফলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের পরিপন্থি পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক-প্রতিক্রিয়াশীল ধারার প্রত্যাবর্তন ঘটে। স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বিদেশে থাকায় শেখ হাসিনা ও তাঁর আপন বলতে একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানা সেদিন প্রাণে বেঁচে যান। ওয়াজেদ মিয়ার জার্মান ভিসার মেয়াদ শেষ হলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর আতিথেয়তায় পরবাসী জীবন কাটান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সামরিক শাসক জিয়া শেখ হাসিনার দেশে ফেরার উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাখে।
১৯৮১ সালে ফেব্রুয়ারির ১৪, ১৫ ও ১৬ তারিখে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী করা হলে ঐ বছরেরই ১৭ মে তারিখে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। এদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান। সে হিসেবে ১৭ মে তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস।
ওই দিনটি ছিল রবিবার। বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে তাকে একনজর দেখার জন্য কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরেবাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে লাখো জনতার ঢল নামে। সেদিনের গগনবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল, আর অবিরাম মুষল ধারে ভারী বর্ষণে যেন ধুয়ে-মুছে যাচ্ছিল বাংলার মাটিতে পিতৃ হত্যার জমাট বাঁধা পাপ আর কলঙ্কের চিহ্ন। শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান ছুঁয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন হাজার হাজার মানুষ। বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সব সদস্যের রক্তে ভেজা বাংলার মাটি স্পর্শ করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই সময় উন্মত্ত জনতা সামরিক শাসক জিয়ার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিভিন্ন স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। ঝড়-বৃষ্টির আকাশ কাঁপিয়ে শেখ হাসিনাকে বহনকারী ট্রাকের চার পাশে স্লোগান ওঠে-
পিতৃ হত্যার বদলা নিতে/লক্ষ ভাই বেঁচে আছে
শেখ হাসিনার ভয় নাই/রাজপথ ছাড়ি নাই।
তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেদিন কুর্মিটোলা থেকে মানিক মিয়া এভিন্যু পর্যন্ত। লাখ লাখ লোকের সংবর্ধনায় তিনি জনতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।”
সংবর্ধনার পর শেখ হাসিনা তাঁর পরিবারের সদস্যদের রক্তে রঞ্জিত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের ৩২ নম্বর বাসায় প্রবেশ করতে চাইলে জিয়ার বাহিনী তাঁকে তাঁর পৈত্রিক বাসায় প্রবেশ করতে দেয়নি। তখন তিনি বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে কোরআন তেলাওয়াত করেন। জিয়া বেঁচে থাকা পর্যন্ত প্রত্যেক দিন তিনি বাসার সামনে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতেন; তাতেও বিন্দুমাত্র দয়া হয়নি খুনি শাসকের।
সেদিনের শাসক গোষ্ঠী শেখ হাসিনার দেশে ফেরার বিষয়টিকে কতোটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল জানি না। আমাদের দেশের নানা মহলও কতোটা শেখ হাসিনাকে নিয়ে আশাবাদী হতে পেরেছিল সেটিও জানা নাই। কেননা, তখনও পর্যন্ত অনেকেই শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মিশন-ভিশন সম্পর্ক সচেতন ছিল না। জিয়াউর রহমান এবং ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের হোতাদের একটা ধারণা ছিল যে, শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সমর্থনশক্তি কিছুটা জেগে উঠবে হয়তো। কিন্তু সেটি তাদের রাজনীতির জন্যে হুমকি হয়ে পড়বে তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো ধারণা ছিল বলে মনে হয় না। আওয়ামী বিরোধী সকল শক্তির ধারণা ছিল যে, আওয়ামী লীগ ভবিষ্যতে কোনোভাবেই আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না, কেননা, বাংলাদেশের জনগণকে এরইমধ্যে আওয়ামী বিরোধী ভাবাদর্শে গড়ে তোলা গেছে, সাম্প্রদায়িক এবং ভারত বিরোধী করা গেছে সফলভাবে এমনটিই ভাবা হতো। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের মতো হয়তো দুর্বল হতে পারে, নতুবা এটি চিরকালই বিরোধী দলের আসনে বসে চেঁচামেচি করে কাটাবে এমনটিই তাদের ধারণা ছিল। রাষ্ট্রক্ষমতায় এমন সব শক্তিকে বসানো হয়েছে যারা আওয়ামী উত্থানকে প্রতিহত করতে যা যা করা দরকার ছিল- তা তারা করতে মোটেও দেরি করেনি। সুতরাং জিয়াকেন্দ্রিক শক্তি কিছু অতিআত্মবিশ্বাসী ছিল।
এর কারণে ১৯৮১ সালের দিকে বাংলাদেশের রাজনীতি এতোটাই বিভ্রান্ত এবং পথহারা ছিল, আওয়ামী লীগ তো অনেকটাই নেতৃত্বশূন্যই ছিল। তার ওপর এই দলটির বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা এতোটাই তীব্র ছিল যে, এসবকে প্রতিহত করে রাজনীতির মাঠে নতুনভাবে দাঁড়ানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। এর ওপর শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র ১৩ দিনের মাথায় জিয়াউর রহমান নিহত হলে পর্দার অন্তরালে এসব কিসের দ্বন্দ্ব বা কিসের আলামত- তাও বোঝা যাচ্ছিল না।
তেমন একটি ঘোলাটে সামরিক শক্তি নতুনভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠার সময়ে শেখ হাসিনা দলের হাল ধরলেন, নতুন করে সবকিছু গোছাতে লাগলেন, অভিজ্ঞতার অবস্থানটিও তখন তার ছিল যৎসামান্য, দলের রণনীতি, রণকৌশল নির্ধারণ, দেশের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে সামরিক শাসন ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজালকে ছিন্ন করে এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তখন পর্যন্ত বেশ জটিল এবং দুরুহ কাজ ছিল। অধিকন্তু পিতার মতো বরাবরই তিনিও ছিলেন ঘাতকের ষড়যন্ত্রের টার্গেট। তাকে হত্যা করার যড়য়ন্ত্র শুরু হয়েছে তখন থেকেই।
একবার নয়, দুইবার নয়, শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কখনো নিজ বাসভবনে, কখনো জনসভায় আবার কখনো তার গাড়ির বহরে। ক্ষমতায় যাতে শেখ হাসিনা কোনোভাবে যেতে না পারেন এবং ষড়যন্ত্রের গোপন জাল বিছিয়ে রেখেছিল রাষ্ট্রক্ষমতার ভেতরে মুখ লুকিয়ে যারা বেচেছিল। গোটা আশির দশক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। কিন্তু আন্দোলনের কোনো ফসলই তাকে ঘরে তুলতে দেয়নি নেপথ্যের ষড়যন্ত্রকারী মহল। যার ফলশ্রুতিতে ’৯১ এর নির্বাচনে পরাজয়। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করার পরেও এ পরাজয় অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে ১৯৯৪-১৯৯৬ সালে বিএনপিবিরোধী তীব্র আন্দোলন শুরু করেন শেখ হাসিনা। তার আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১২ জুন ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং ২৩ জুন ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে সরা আওয়ামী লীগ আবার ফেরে ক্ষমতায়। পাঁচ বছর পর আবারও নির্বাচনে পরাজয় এবং আবারও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারবিরোধী আন্দোলন, আবারও সেনা সমর্থিত সরকারের ক্ষমতায় আসা, পরে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ে ক্ষমতায় ফেরা এবং বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংস আন্দোলন মোকাবেলা করে টানা দুইবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছেন শেখ হাসিনা।
সব মিলিয়ে মোট ৩৫ বছর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। এর মধ্যে ১৯৮১, ১৯৮৭, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০২, ২০০৯, ২০১২ সালের কাউন্সিলে তিনি সভাপতি পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এবার অষ্টমবারের মতো নির্বাচিত হলেন। এই ৩৫ বছরে দুই বার দলের নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছার কথা বলেছিলেন শেখ হাসিনা। প্রথমবার ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অপ্রত্যাশিত পরাজয় এবং সব শেষ ২০তম জাতীয় সম্মেলনের আগে। কিন্তু দুই বারই কাউন্সিলররা জানিয়ে দিয়েছেন তারা চান না তা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১২ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাংলাদেশে এর আগে কেউ এত বছর সরকারপ্রধান হতে পারেননি। এর বাইরে ১১ বছরেরও বেশি সময় তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। ১৯৮৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর আবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে বিএনপিকে চাপ দিয়ে তাদেরকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন কেবল একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের উদ্দেশ্যে নয়, জাতীয় রাজনীতির হাল ধরতে, সেনাশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে। এর আগে বিদেশে অবস্থানকালে তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। দেশের মাটিতে পা রাখার দিন থেকেই শুরু হয় তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামী জীবন, তিন দশকের অধিক সময় ধরে যা বিস্তৃত। বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে এই দিনটির তাৎপর্য তাই ভুলবার মতন নয়।
১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ হাসিনার দুঃসাহসী সিদ্ধান্তের কারণেই আজ সামরিক শাসনের স্মৃতি পেছনে ফেলে দেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে। আজ বাঙালির শেষ আশ্রয়ের নাম- শেখ হাসিনা।
লেখক: সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ
প্রথম প্রকাশ: ১৭ মে, ২০১৯, বাংলানিউজ২৪.কম